Tuesday, July 9, 2013

ফেসবুকিং

মধ্য বয়সে এসে এমন একটা ক্যাচালে জড়িয়ে পড়বেন স্বপ্নেও ভাবেননি খবিরউদ্দিন। বিশ বছর ধরে সরকারী চাকুরী করে যা কামিয়েছিলেন তা দিয়ে শহরে দুইটা বাড়ি তৈরী করে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। আরো দশ বছর এই চাকরীতে আরাম করে কাটানো যাবে।

কিন্তু একদিন খবির উদ্দিনের টেবিলে একটা কম্পিউটার বসানো হলো ইন্টারনেট সহকারে। তিনি জীবনে কোনদিন কম্পিউটার ধরেননি, ভাবতেন এটা কেবল অপারেটরের কাজ। বুড়ো বয়সে কম্পিউটার নিয়ে কাজ কি? তিনি না জানেন টাইপ, না চেনেন প্রোগ্রাম। কিন্তু সরকারের হুকুম। দেশটা ডিজিটাল হচ্ছে, টেবিলে টেবিলে কম্পিউটার এখন। খবিরউদ্দিনের টেবিল কেমনে খালি থাকে? মুশকিলে পড়ে গেলেন খবিরউদ্দিন। কম্পিউটার বসলো। তবে কম্পিউটার বসানোর পর থেকে ওটা বসেই থাকতো। ওটায় কোন কাজই নাই তাঁর। কালো বোরকা পরে টেবিলের উপর জড়োসড়ো।

একদিন বড় সাহেব অফিসে উঁকি দিতে আসলেন। সবাই তটস্থ, যার যার টেবিলের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে দ্রুত। খবিরুদ্দিনের তেমন কাজ থাকে না, বসে বসে পত্রিকা পড়েন সারাদিন। পত্রিকা পড়ে খবরাখবর সংগ্রহ করে সময় সময় বড় সাহেবের কাছেও গালগল্প করেন। বড় সাহেবের পত্রিকা পড়ার সময় নাই। মন্ত্রী সচিবের গুঁতো সামলাতে হিমশিম। বলা চলে বড় সাহেবের জন্য খবিরউদ্দিনই দেশের সবগুলো হট নিউজের সুত্র। তাই বড় সাহেবকে আসতে দেখে পত্রিকার গভীরে ডুবে যায় আরো। বড় সাহেব সমস্ত অফিসে চক্কর দিয়ে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়-

-খবিরউদ্দিন সাহেব
-জী স্যার!
-কি করেন?
-স্যার, মিচ্যুয়াল ফাণ্ডের ইন্টারেস্ট রেটে বড় একটা ছাড় দিয়েছে, এইমাত্র পড়লাম
-কোথায় পড়লেন?
-এই তো স্যার, এই পত্রিকায়
-আপনার কম্পিউটার কি নষ্ট?
-না স্যার, একদম নতুন এখনো, আমি তো ব্যবহার করি না তেমন
-ব্যবহার করেন না কেন? টেবিলে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে কি জন্য?
-স্যার.....মানে.. ওখানে তো আমার কাজ নেই...তাই
-পত্রিকা পড়াও তো আপনার একটা কাজ
-জী স্যার
-পত্রিকা কম্পিউটারে পড়েন না কেন?
-কম্পিউটারে স্যার, কি করে পত্রিকা পড়ে আমি ঠিক জানি না
-জানার চেষ্টা করলেই জানবেন
-আচ্ছা স্যার
-কাল থেকে অফিসে পত্রিকা নেয়া বন্ধ। কম্পিউটারে বিনামূল্যে পত্রিকা পড়া যায়।
-জী স্যার

বিপদে পড়ে গেলেন খবিরউদ্দিন। কম্পিউটারে পত্রিকা পড়া শিখতে তো তার বছরখানেক লেগে যাবে। এত জটিল সব বোতাম, সারা জীবনেও মনে হয় এতসব মুখস্থ হবে না। তিনি তাঁর জুনিয়র সহকারীকে ডেকে কম্পিউটারে পত্রিকা খোলার ব্যবস্থা করতে বললেন। সহকারী এসবে চটপটে। সে দুমিনিটে হাজির করে দিল পত্রিকাটা। আশ্চর্যের আশ্চর্য খবির উদ্দিন। এত কামেল জিনিস তার টেবিলে আছে অথচ তিনি ব্যবহারই করেননি এতদিন! সেদিন থেকে খবির উদ্দিন উঠে পড়ে লাগলেন কম্পিউটার নিয়ে। কয়েক মাস পরে তো রীতিমত সিদ্ধহস্ত হয়ে গেলেন কম্পিউটারে ইন্টারনেট খোলাখুলিতে। পত্রিকার পাশাপাশি তিনি অন্যন্য সাইটগুলো ভিজিট করেন, এমনকি ইউটিউব আর ফেসবুকের মতো জিনিসও খবিরউদ্দিনের আয়ত্বে চলে আসে।

মেয়েটার সাথে ফেসবুকেই পরিচয়। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও মেয়েটার সাথে ঘনিষ্টতায় জড়িয়ে যান। সুখ দুঃখের যাবতীয় আলাপ করেন। একদিন দেখা গেল খবিরউদ্দিন তার জীবনের গোপনতম কথাটিও মেয়েটাকে বলতে শুরু করেছেন। যা কোনদিন তার বউয়ের কাছেও ফাঁস করেনি। অবশ্য পুরাতন প্রেমের কাহিনী বউয়ের কাছে শেয়ার করার মতো সাহস সব পুরুষের থাকে না। কিন্তু মেয়েটা কেন যেন তাঁর গোপন জগতের অধিকারী হয়ে গেল। মেয়েটারও কাহিনী আছে। সেও অবলীলায় তার কাহিনী খবিরউদ্দিনের কাছে বলতে থাকে। দুজনের গোপন কথা শেয়ার করতে গিয়ে খবিরউদ্দিনের মনে হঠাৎ করে রোমাঞ্চ খেলে যায়। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকেন মেয়েটা তার সাথে পরকীয়া করছে। পরকীয়া মানে নিষিদ্ধ ক্রিয়া। যে কোন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের দুর্বার আগ্রহ। খবিরউদ্দিনেরও তাই হলো। তিনি পত্রিকা পড়া ভুলে এখন ফেসবুকে পড়ে থাকেন। সারাদিন চ্যাট করেন। মেয়েটাও প্রতিদিন তাঁর জন্য বসে থাকে। এতকিছু হলেও মেয়েটার ছবি দেখেননি কখনো। ছবি দেখার কথা মাথায় আসেনি তার। তার ছবিও মেয়েটা কোনদিন দেখতে চায়নি। এরকম অসম বয়সে ছবি দেখাদেখি ব্যাপারটা কেমন যেন। তবু একদিন মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। ছবি পাঠালো মেয়ে। অপূর্ব মেঘলা চুলের একটা মেয়ে। দেখেই বুকের ভেতর রিনিঝিনি বৃষ্টি শুরু হলো। নস্টালজিক হতে হতে অনেক পেছনে চলে গেলেন খবিরউদ্দিন। আরো বছর বিশেক আগে........। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক চিরে।

প্রতিদিন কাজের চেয়ে মেয়েটার সাথে গোপন আড্ডায় বেশী সময় ব্যয় হতে থাকে খবির উদ্দিনের। মনে মনে অপরাধবোধ কাজ করে। এমন একটা মেয়েকে নিয়ে তিনি কেন এত আবেগ দেখাচ্ছেন। মেয়েটাকে প্রতিদিন না দেখলে কেমন যেন লাগে বুকের মধ্যিখানে। ছুটির দিনগুলো তাঁর সময় কাটে না। বাজারে গেলে ইচ্ছে করে মাছ সবজির থলেটা ছুড়ে ফেলে কাজের ছুতোয় অফিসে ছুটে যান। কিন্তু খোলার দিনেই তাঁর কাজ থাকে না, ছুটির দিনে কেমনে যায় অফিসে? তবু বাজারের থলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে মাছ তরকারী কেনার সময়ও মন পড়ে থাকে মেয়েটার কাছে। বুড়ো বয়সের প্রেম বড় জ্বালা দেখি। তাঁর আবারো তরুণ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে।

একদিন ফোন নাম্বার বিনিময় হয়। ফোনের কন্ঠ শুনে খবিরউদ্দিনের বুকের জ্বালা ক্রমশঃ উর্ধমূখী হতে থাকে। এবার শায়লাকে মুখোমুখি দেখার তৃষ্ণা জাগে তার। হ্যাঁ মেয়েটার নাম শায়লা শারমিন। সে আদর করে শাশা ডাকেন আজকাল। খবিরউদ্দিন অনেক জোরাজুরি করেন দেখা হবার জন্য কিন্তু শাশা বলে সেটা ঠিক হবে না। ওরা একই শহরে বাস করে, অথচ কেউ কাউকে দেখবে না, এটা মানতে পারেন না খবিরউদ্দিন। কিন্তু জোর করার সাহসও পান না। যদি শায়লা ভুল বোঝে?

বড় সাহেবের সাথে বড়লোকী এক দাওয়াতে যেতে হলো বিষুদবার সন্ধ্যায়। অথচ প্ল্যান ছিল বড় সাহেব চলে গেলে অফিসে বসে শায়লার সাথে কিছুক্ষণ ফোনপ্রেম করবে। কিন্তু নাছোড় লোকটা তাকে নিয়েই পার্টিতে গেল। পার্টিটা বিশাল একটা জায়গা জুড়ে। মেরিনার্স ক্লাবের লনটা যেন একটা সবুজ পার্ক। সেখানে নানান গাছের ঝোপঝাড়ের পাশে টেবিল সাজানো। বাগানজুড়ে আলোক সজ্জা। বড় সাহেব পার্টিতে ঢুকে জুটে গেল বড় সাহেবদের সাথে। খবিরউদ্দিন একটা মাঝারি এক্সিকিউটিভ ধরনের লোকের টেবিলে বসলেন। বিশাল গোলাকার টেবিল। এক টেবিলে বারো জনের বসার ব্যবস্থা। সেখানে আরো কয়েকজন বসে গল্প করছে। খাবার দিতে দেরী আছে কিন্তু সবাই আগেভাগে টেবিলগুলো দখল করে বসে গেছে। খবিরের খুব বোরিং লাগছে, এখানে তার পরিচিত কেউ নেই। হঠাৎ ইচ্ছে হলো শায়লার সাথে কথা বলতে। ফোন করলো শায়লার মোবাইলে।

মিউজিক বাজছে মৃদুলয়ে। অচেনা পশ্চিমা কোন সঙ্গীত। এসব ভালো বোঝেন না খবিরউদ্দিন। মিউজিকের পাশাপাশি মোবাইল টোনও যুক্ত হয়েছে। এদিক সেদিন বেজে উঠছে টুংটাং মোবাইল রিংটোন। কোনটা মোবাইল কোনটা মিউজিক আলাদা করা যাচ্ছে না সবসময়। এই টেবিলেও বাজছে কোন একজনের মোবাইল। খারাপ লাগছে না শুনতে। কি ব্যাপার ফোন ধরছে না কেন শায়লা। অনেকক্ষণ পর ধরলো।

প্রায় ফিসফিস করে খবির বললো- হ্যালো!
ওপাশ থেকেও ফিসফিস শব্দ এলো-হ্যালো!
খবির ফিসফিস করে বললো- আই মিস ইউ শাশা!
ওপাশ থেকে বললো-আমি একটা পার্টিতে এসেছি, পরে কথা বলি?
এপাশ থেকে খবির বললো- আমিও একটা পার্টিতে
ওপাশ থেকে বললো- তাহলে তুমিও পার্টি শেষ করো, তারপর কথা বলবো
এপাশ থেকে খবির বললো-পার্টিতে আমার কাজ নেই, তাই তোমার সাথে কথা বলি
ওপাশ থেকে বললো-কাজ আমারো নেই, কিন্তু এরকম ফিসফিস করে কথা বলতে পারবো না। বিশ্রী লাগে। আমার টেবিলের উল্টোদিকে এক হাঁদারাম মোবাইল নিয়ে প্রায় টেবিলের নীচে ঢুকে যাচ্ছে।

খবিরউদ্দিন খেয়াল করলেন ফিসফাস করতে করতে মাথাটা তিনি একটু বেশীই নীচে করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শায়লার সামনের লোকটাও একই ভঙ্গি করলো? ব্যাপার কি? হঠাৎ চোখে পড়লো খবিরউদ্দিনের সোজা টেবিলের উল্টোদিকে বসা মোবাইল কানে মাঝবয়েসী মহিলাটাও ফিসফিস করে কথা বলছে। চোখ বড় বড় করে মহিলার দিকে তাকালো খবির। শায়লা ওপাশ থেকে বললো- হ্যালো রাখছি, বুড়ো হাঁদাটা এখন আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। খবির দেখলো মহিলা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো।

জমে গেলেন খবির উদ্দিন। ফেসবুকের তরুণী শায়লা আর এই মাঝবয়েসী মহিলা একই মানুষ? মহিলার দশাসই চেহারার সাথে কন্ঠের কোন মিল নেই। খবিরউদ্দিন ঢোক গিলতে লাগলেন এবং ধরা পড়ার আগেই টেবিলটা ছেড়ে পালাবার পথ খুঁজতে থাকলেন। বড় সাহেবের গাছে গিয়ে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে পার্টি থেকে কেটে পড়লেন।

পরদিন থেকে খবিরউদ্দিনকে ফেসবুকে দেখা গেল না আর। সবকিছুর জন্য সরকারের ডিজিটাল প্ল্যানটাকে শাপশাপান্ত করে দায়ী করলেন খবিরউদ্দিন। বড় সাহেবকে বললেন কম্পিউটারে পত্রিকা পড়ে পড়ে তার চোখের বারোটা বেজে যাচ্ছে। বড় সাহেব ব্যাপারটা আমলে নিলেন। অতএব কম্পিউটারটা আবারো বোরকার আড়ালে চলে গেল। খবিরউদ্দিন চলে গেলেন কাগুজে পত্রিকার আড়ালে।

No comments: