নকল কথা:
মানুষ কেন লেখে? এই ভাবনার যে উত্তরটা আমি নিজের কাছ থেকে পাই তা হলো - মানুষের চুলকায় বলে লেখে। কথা কি অশ্লীল হলো? চুলকানি কি অশ্লীল হতে পারে? যেমন চুদুরবুদুর? চুদুরবুদুর অশ্লীল নয় বলে ঘোষণা এসেছে। আমার পড়াশোনা কম, ডিকশেনারি উল্টাই না বহুদিন। তাছাড়া দিনরাত যেসব শব্দ নিয়ে কারবার তা কেউ ডিকশেনারীতে খোঁজে না। তবে বুঝি চুলকানি শব্দটা কখনো কখনো সেমি অশ্লীল। ধরেন কারো কথা শুনে আমার ইচ্ছে হলো তার পাছায় একটা গদাম লাথি দিতে, অথচ ভদ্রতার খাতিরে দিতে পারছি না, সেক্ষেত্রে বলি- "কি রে ভাই, চুলকায় নাকি?"
আসলে সবারই কোন না কোন চুলকানি আছে, এই চুলকানি শরীরের না, মগজের। মানুষের মগজের গ্রে এরিয়াতে হরকে কিসিমের চিন্তাভাবনায় ভরপুর। যার যখন যে চিন্তা চুলকায় সে তখন ওই বিষয়ে লেখে। যার চুলকানীর সাথে কীবোর্ডের সম্পর্ক ভালো, তার লেখা তত ভালো হয়। কীবোর্ডের সাথে মগজের সম্পর্কটা ভালো না আমার, তবু লিখি হাত চালু রাখার জন্য। হাত চালু রাখা মানে হলো বাংলা টাইপের স্পীড ধরে রাখা। স্কুল বয়সে যেরকম হাতের লেখা ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন দুই পাতা লিখতে হতো, সেরকম।
মগজের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে না পারলেও আঙুলের সাথে কীবোর্ডের একটা ভালো বোঝাপড়া হয়েছে গত পাঁচ বছরে। ফলে ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে আর অসুবিধা হয় না। দেশে কোনদিন যদি মোল্লারা ক্ষমতায় আসে, আফগান স্টাইলে আমাকেও ধরে নিয়ে সিলিং এর সাথে পা বেঁধে জিজ্ঞেস করা হবে, কেন ব্লগ লিখিস? জ্ঞান হারাবার আগে আমার প্রথম উত্তর হবে - চুলকায় বলে লিখি।
আমাদের পাড়ায় এক বক্তা ছিল যিনি মঞ্চে উঠে প্রথমেই বলে নিতেন, "ভাই আমি কম কথার মানুষ, বেশী কথা পছন্দ করি না। আমার বক্তব্য অতি সংক্ষিপ্ত হবে, আজে বাজে কথা বলে আমি আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। মাত্র দুটি বাক্যে আমার বক্তৃতা শেষ করবো। আজকাল কেউ কেউ মাইকের সামনে দাড়ালে থামতেই চাই না। মানুষের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা ভাবনা নাই। তাই আমি আপনাদের বেশীক্ষণ বিরক্ত করবো না। অতি সামান্য কথায় আমার বক্তৃতা শেষ করে দিব..........." কমসে পনেরো মিনিট ত্যানা পেঁচানোর পর তিনি তার 'সংক্ষিপ্ত' বক্তৃতা শুরু করতেন। আমিও চামে কয়েকটা চাপা মেরে দিলাম। এবার আসল কথায় আসি।
আসল কথা:
আমি ধর্মভীরু মানুষ। মানে ধর্মকে ডরাই, তার চেয়ে বেশী ডরাই যারা ধর্মের ডাণ্ডা হাতে নিয়ে ঘুরে। ক্লাস নাইনে থাকতে কলোনীর মিল্লাত ভাই বললেন, "এসো নামাজ পড়ি"। তারপর আমি টুপি নিয়ে মিল্লাত ভাইয়ের সাথে মসজিদে যাতায়াত শুরু করলাম। আমাদের দলের সবাই মোটামুটি মসজিদে হাজির। খেয়াল করলাম নামাজের পর দোতলায় আরেকটা আসর বসতে শুরু করেছে যেখানে যাবার জন্য মিল্লাত ভাই ব্যাপক জোরাজুরি করতেন। এত সুন্দর মানুষ, অনুরোধ ফেলতে ইচ্ছে করে না। তাই আছরের পর মিলাদে দাওয়াত দিলে ঠিক মোনাজাতের সময় হাজির হয়ে জিলিপিগুলো সংগ্রহ করে আবার মাঠে খেলতে চলে আসি। আমাদের মসজিদে যাতায়াতে মিল্লাত ভাই খুশী হলেও তাদের দোতলার সেশানে আগ্রহ সৃষ্টি করাতে না পেরে তিনি হতাশ। এবং হতাশা বিরক্তিতে রূপান্তরিত হলো যখন দেখলো মসজিদে যাওয়া দলের চেয়ে জিলাপি সংগ্রহের দলে লোক ভারী হয়ে গেছে দেখে। একদিন জুমার নামাজে প্রকাশ্যে বলে ফেললেন, এই ব্যাটা মসজিদে আসে ঠিক, কিন্তু সে হলো 'কমিনিষ্ট'। তখনো আমি ঠিক জানতাম না 'কমিনিষ্ট' কি জিনিস। কলেজে ওঠার পর বুঝেছি ওই শব্দটা হবে কমিউনিষ্ট। আরো বড় হয়ে বুঝেছি কমিউনিষ্ট হওয়া কত শক্ত কাজ। আদতে আমি কখনোই কমিউনিষ্ট ছিলাম না, তবু কেন জানি মোল্লারা আমাকে কমিউনিষ্ট ডাকতে পছন্দ করতো। তিনটা উল্লেখযোগ্য 'কমিনিষ্ট' অভিজ্ঞতার কথা লিখবো আজ-
১.
আমার এক বন্ধুর সাথে মেসে থাকতো পাড়ার মসজিদের ব্যাচেলর ইমাম। আমি বন্ধুর সাথে আড্ডা মারতে গেলে কোন কোন সময় হুজুরও অংশগ্রহন করতো তাতে। একবার কথা উঠলো সাইক্লোন নিয়ে। নানা কথার পর দুয়েক পাতা বিজ্ঞান পড়া আমি দুম করে জ্ঞান জারি করলাম, "আজকাল আমেরিকা রাশিয়া চেষ্টা করতেছে বোমা মেরে সাইক্লোন ধ্বংস করে দিতে"।
আমার কথা শেষ করা মাত্র হুজুর লাফ দিয়ে উঠে বললেন, "নাউজুবিল্লাহ!!! তুমি এসব কি কথা বলতেছো, সাইক্লোন-ঝড়-তুফান এগুলো আল্লাহর কুদরত, এগুলোয় বোমা মারবে মানুষ? কি রে মিজান তোর বন্ধু কি কমিনিষ্ট নাকি?"
২.
আরেকবার এশার নামাজ পড়তে গেছি হঠাৎ মুসল্লি হয়ে। বাদে এশা হুজুর কিছু বয়ান করতে চাইলেন মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে। বেশীরভাগ মানুষ এই সব শোনে না। কয়েকজন বাদে সবাই চলে গেল। আমিও কেন যেন রয়ে গেলাম শয়তানের প্ররোচনায়। হুজুর বলছেন, শ্রোতারা শুনছেন। এক পর্যায়ে কথা উঠলো ছবি নিয়ে। ছবি তোলা হারাম, ছবি রাখা হারাম, যে বাসায় ছবি থাকবে সে বাসায় ফেরেশতা ঢুকবে না।
শ্রোতারা সবাই মাথা নাড়ছেন ভক্তি ভরে, যদিও জানি তাদের প্রত্যেকের বাসার টিভিতে দিনভর নাচগান চলে।
হুজুর উত্তেজিত স্বরে বলছেন, "যাদের বাড়িতে ছবি থাকবে তাদের কোন ইবাদত আল্লাহর আরশে পৌঁছাবে না, কারণ ওই বাড়িতে ফেরেশতা ঢুকতে পারবে না। সুতরাং ওই বাড়ির বাসিন্দাদের নিশ্চিত দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে!!!"
আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। আমার বাসায় বিশাল সব পোট্রেট ছবিতে দেয়াল ভর্তি। বছরে উনপঞ্চাশ বার জুমার নামাজ পড়েও যদি দোজখবাসী হতে হয়, তার আগে একটা প্রতিবাদ করে যাই।
বললাম, "হুজুর পত্রিকার ছবি দেখলেও কি ফেরেশতা ফিরে যাবে নাকি?"
হুজুর হুংকার দিয়ে বললেন, "আলবত!"
তখন আমি বললাম, "হুজুর তাইলে আপনার এত বছরের কোন ইবাদতই তাইলে আল্লাহর আরশে পৌঁছে নাই। বাকীদের কথা বাদই দিলাম, আপনারে তো প্রতিদিন পত্রিকা হাতে দেখি। এখানে কার বাসায় পত্রিকা নাই?"
কথা শেষ না হতেই একটা গুঞ্জন উঠে গেল তৎক্ষনাৎ। লোকজন পারলে আমার মুখে আইকা গাম লাগিয়ে দেয়। কথাটা বলে কেমন একটা বিমলানন্দ পেলাম। হুজুর বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। মনে মনে হয়তো আমার জন্য হাবিয়া দোজখে সিট বরাদ্দ চাইলো। তবে কথা আর বাড়ালেন না। বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে বসতে বসতে বিড়বিড় করে বলছিল ....কমিনিষ্ট কমিনিষ্ট।
৩.
পাড়ার এক আংকেল মারা গেছেন। তার বাসায় মিলাদে দাওয়াত। পাড়ার বিশ ত্রিশজন মুরব্বীর সাথে বসে আছি। হুজুর এলেন। পাশের মসজিদের হুজুর। মিলাদ শুরু করার আগে হুজুর বললেন, "আপনারা মান্যগন্য লোকেরা হাজির আছেন, মরহুম এ আহমদ সম্পর্কে কিছু কথা বলবো মিলাদের আগে।"
শুরু হলো কথা। মরহুমকে নিয়ে দুই কথার পর হুজুর চলে গেলেন বেগানা নারীদের দিকে, ডিশ দেখে দেখে কিভাবে লোকজন নেংটো হয়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে বেপর্দা নারী, ঘরের ছাদে ছাদে শয়তানের জাল। শান্তিচুক্তি করে সরকার দেশকে বিক্রি করে দিয়েছে, জেহাদ ছাড়া মুক্তি নাই, আমেরিকা মুতে ভাসিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি জাতের কথাবার্তা।
আমার প্রায়ই ঝামেলা লেগে যায় হুজুরদের সাথে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিলাম মুখে টেপ লাগিয়ে বসে থাকবো। এত মুরব্বীর সামনে মুখ খারাপ করার কোন মানে হয় না। তাই দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে ঝিমাতে লাগলাম। বিছানায় ঘুম আসতে আমার ঝামেলা হলেও সভা-সমিতি-সেমিনার-মিলাদ-মাহফিল-খুতবা ইত্যাদিতে আমাকে মড়ার ঘুমে টানে এখানেও হেলান দেয়া মাত্র তলিয়ে যেতে থাকলাম। ভদ্রতার জন্য জোর করে চোখ খোলা রাখতে গিয়ে দেখি এই যাত্রায় আমি একা না, পাশের বিল্ডিং এর ইদ্রিস চাচাও ইতিমধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেছে। ফলে আমি আরো ভরসা পেয়ে নিশ্চিন্তে ঢলে পড়লাম দেয়ালে মাথাটা রেখে। কিছুক্ষণ পর ধড়মড় করে জেগে উঠলাম ভয়ংকর এক হুংকারে।
হুজুর গর্জন করে বলছে, "যারা আল্লাহর মজলিসে এসে ঘুমিয়ে পড়ে তারা নিশ্চয়ই শয়তানের দোসর এবং কমিনিষ্ট!!!"
কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলেও আমি নির্লজ্জের মতো হেসে আঙুল দিয়ে দেখালাম ইদ্রিস চাচার দিকে, তিনি তখনো অবিরাম নাক ডেকে চলছেন আসর জমিয়ে। চাচা সম্ভবতঃ ঘুমের ডেল্টা লেভেল পার হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে।
ইদ্রিস চাচা পাড়ার সবচেয়ে জাদরেল মুরব্বী এবং এই মসজিদের সবচেয়ে নিয়মিত মুসল্লী। হুজুর ওনাকে না দেখে কেবল আমার দিকে নজর দিয়েছিল বলেই সেই গর্জন। এবার আর কথা না বাড়িয়ে টুপ করে বসে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো। আর আমি আরেক দফা ঘুম যাবো কিনা ভাবতে লাগলাম।
No comments:
Post a Comment