Sunday, June 24, 2012

এমন ঘন ঘোর বরিষায়, কোনো কাজ করিতে মন নাহি চায়

এমন দিনে-১
সারারাত ধরে বৃষ্টির গান। একই তালে, একই লয়ে। এতটুকু বিরক্তি আসে না। রাতের নিশ্ছিদ্র ঘুমের জন্য বর্ষা সঙ্গীতের চেয়ে ভালো কিছু নেই। বর্ষার গানে কিছু একটা আছে, কী যেন এক অপার্থিব সুর বাজতে বাজতে প্রবল ঘুম ডেকে আনে, চোখ মুদে আসে বালিশে মাথা রাখামাত্রই। ঘুমের অতলে ডুবে যেতে যেতেও সেই সুরের রেশ কাটে না।

গত রাত থেকে অবিরাম ঝরছে, ঝরেই যাচ্ছে ক্লান্তিহীন। ভোরের পাতলা আলোতে চোখ মেলেও সেই রিমিঝিমি সঙ্গীতের সুর কানে বাজে। চোখটা আধেক খুলে আবারো চাদর জড়িয়ে গুটিশুটি ঘুম। আলস্য ঋতু বরষা, এমন দিনে কে সাত সকালে বিছানা ছাড়তে চায়? ছেলে বুড়ো ছাত্র চাকুরে ব্যবসায়ী রিকশাওয়ালা ফেরীঅলা সবাই যার যার আবাসে জড়োসড়ো হয়ে শেষদফা ঘুমের রাজ্যে। দিন কাটবে আজ জানালার পাশে বসে, সর্ষে তেল মাখানো, চানাচুর মোড়ানো, ঝালমুড়ির তেজে। পাশে রাখা ধোঁয়া ওঠা চায়ের মগ।

এমন দিনে-২
তুমুল বৃষ্টিতে শহর ভেসে যাচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে। প্যান্ট গুটিয়ে, জুতো হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌঁড়ে বন্ধ দোকানের ছায়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আধভেজা। সাথে ছাতা নেই। রাস্তায় জনমানব নেই, যানবাহন নেই। সমস্ত শহর ঘুমিয়ে। অফিসে যেতে হচ্ছে। বাধ্যতামূলক যাত্রা। চাকরী নয় শাস্তি। গত রাত থেকে অঝোরে ঝরছে। রিকশা নেই। টেক্সী নেই। বাস নেই। সবাই ঘুমে। নগরে যেন আমিই একা জেগে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। দোকানের ফুটো টিনের ছায়ায়। আধভেজা শরীরে শীত। সিগারেটের তৃষ্ণা। দোকানপাট বন্ধ। ধারে কাছে হোটেল নেই। একটা দুটো পর্দাঘেরা রিকশা যায়। ভেতরে ভাগ্যবান যাত্রী। কতদূর হাঁটলে একটা রিকশা মিলবে। কতোটা ভিজলে অফিসে পৌঁছানো যাবে।

আজকের কাজটা জরুরী? তেমন না, কিন্তু চাকরীটাই জরুরী। এটা বাঁচলে জীবনে অনেক বর্ষা মিলবে। হে কপাল, একটা রিকশা যোগাড় করো।


এমন দিনে-৩

টিনের চালে বৃষ্টি ঝরে। সবচেয়ে কাংখিত বৃষ্টির সুর, যে সঙ্গীত কোন রেকর্ড যন্ত্রে হুবহু ধারণ করা যায় না। ছবি দেখে কল্পনায় শুনে নিন সেই বর্ষা সঙ্গীত নস্টালজিয়ার সালাদ মাখিয়ে

যারা এই পোষ্ট পড়েছেন তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে যিনি জীবনে একবারও মনে মনে দাবী করেননি - "তুমুল বর্ষন দিবসে অফিস, ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছু ফাঁকি দেবার অধিকার চাই?"

Saturday, June 16, 2012

সীমান্ত পারাপার

ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হোসনা বেগম একটা গাছের নীচে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। অল্পের জন্য মাথায় আঘাত পাওয়া থেকে বাঁচলো দুই সপ্তাহের টুকু। মাথা কামানো হয়েছে তার গত সপ্তাহে। সেই উপলক্ষে খানাপিনার আয়োজন করার কথা থাকলেও টাকার অভাবে পারেনি। আজকে রাতে একটা মুরগী জবাই করে স্বামী আর তিন সন্তানকে খাওয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মুরগীটা জবাই করে কেটেকুটে চুলায় তুলে দেয়া হয়েছিল। মশলার সুঘ্রান মৌ মৌ করছিল তাদের ছনের বেড়ার ঘরটা।

চোদ্দ বছরের মনি বাপের সাথে লাকড়ি কাটতে গিয়েছিল। ৫ আর ৭ বছরের রীতা, মিতা খেলা করছিল উঠানে। স্বামী জাগির হোসেন লাকড়ি বিক্রি করে সংসার চালায়। কদিন থেকে বাতাস গরম। যদিও মংডু শহর থেকে দূরে বাস তাদের, কিন্তু এই পাড়ায়ও কানাঘুষা। যে কোন সময় আঘাত আসতে পারে পাহাড়ের ওই পাশের গ্রাম থেকে। অনেকদিন থেকে ওরা এই পাড়ার দখল নেবার চেষ্টা করছে। এখানে ওরা ঘর তৈরি করে আছে ঠিকই, কিন্তু জায়গার মালিক সরকার। দখল করে ঘরবাড়ি করে মালিক হয় কেউ কেউ। বলা যায় জোর যার জায়গার  মালিক সে। এটাই এখানকার নিয়ম।

অদূরেই নাফ নদী। ওটা পেরুলে বাংলাদেশ। অনেকে এখান থেকে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ চলে গেছে চুপি চুপি। তারাও যাবে ভাবতেছিল। ওখানে ভিক্ষা করে খেলেও বাচ্চাগুলো নিরাপদ থাকবে। এই অনিশ্চয়তা ভালো লাগে না আর। কিন্তু কোন ঝামেলা ছাড়া শান্তির সময় কে দেশ ছাড়ে। এখানে তাদের কোন জমিজমার মালিকানা না থাকলেও, এটাই তাদের জন্মভুমি, এটাই তাদের দেশ। নিজের দেশ ছেড়ে কেউ সাধে বিদেশ যায় না। মুরগীর সুঘ্রান পেতে পেতে এই কথাগুলো ভাবছিল হোসনা বেগম। আজকের দিনটা বড় সুলক্ষণ। সকাল থেকেই গরম কম, একটু বৃষ্টিও হয়েছিল দুপুরের দিকে।

জাগির হোসেন সন্ধ্যে নামার আগেই ভাত চায়। আলোতেই সব খাওয়া সেরে ফেলতে হয়। জাগির ফিরেছে মনিকে নিয়ে। সবাই খাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। অথচ মুরগীটা সেদ্ধ হয়নি এখনো। বুড়ো ধাড়ি মুরগী। আরেকটু সেদ্ধ হতে হবে। বাচ্চারাও আজকে আগেভাগে খাবার জন্য উসখুশ করছে।। বিকেলেই ভাত রান্না হয়ে গেছে। এখানে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বলে না ঘরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসা আলোতে কেবল শোবার কাজটা করে। বাকী সব কাজ দিনের আলোতে।

রান্নাও শেষ সূর্যও ডুবে গেল। দ্রুত হাতে সবার পাতে ভাত আর মাংস বেড়ে দিয়ে নিজেও একটা প্লেট নিয়ে বসলো। টুকু দুধ খাবার জন্য কান্না করছে। কিন্তু পেটে ভাত না পড়লে বুকে দুধ আসে না। তাই সে দ্রুত ভাত গিলতে শুরু করে।

হঠাৎ দূর থেকে অনেক মানুষের গুঞ্জন হৈ চৈ ভেসে আসে। ব্যাপার কি। আতংকে বুকটা হিম হয়ে আসে। ওরা আসছে না তো? এদিকে আসবে আসবে শোনা যাচ্ছিল কদিন থেকে। আজকেই সেই দিন না তো? ওহ খোদা! এইসব ঘরবাড়ি কিছুই থাকবে না। সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে। জাগির হোসেন লাফ দিয়ে উঠলো ভাত রেখে। হ্যাঁ দূরে মশাল হাতে অনেক লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। আর দেরী করা যাবে না। "মনি, রীতা, মিতা তোর উঠ, চল পালাই, ভাত খাওয়া রাখ। আগে জান বাচাই।"

কিন্তু বাচ্চারা মুরগী আর ভাত রেখে উঠতে চায় না। ওরা ভাত মাংস ঝোল গোগ্রাসে গিলতে থাকে যত দ্রুত সম্ভব। অনেকদিন পর পেটপুরে খাবার মতো একটা তরকারী পেয়েছে। এটা জানের বিনিময়েও ছাড়া যাবে না। হোসনা বেগম টুকুকে কোলে জড়িয়ে নিয়ে বলে, "তোমরা আসো আমি আগে ছুট লাগাই। নইলে পরে দৌড়াতে পারবো না এটাকে কোলে নিয়ে।"

সবকিছু ফেলে রেখে ছুটতে থাকে হোসনা। জান বাজি রেখে ছোটে। কোলের ছোট্ট টুকু চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে আধো অন্ধকারে ছুটতে থাকে সে। নদীর কাছে, ঘাটের কাছে পৌঁছাতেই হবে যে কোন উপায়ে। অনেক দেরি করে ফেলেছে। আরো কয়দিন আগেই পালানো উচিত ছিল। এখন ঘাটে কি নৌকা পাবে? আরো কতো মানুষ যাবে এই দিকে। ভাবতে ভাবতে ছুটতে থাকে। পেছনে বারবার তাকিয়ে খুঁজছে স্বামী আর বাকী তিন সন্তানকে। ওরা আসতে দেরি করছে কেন? তখনি হোঁচট খেয়ে পড়লো। টুকুর মাথাটা বাঁচলো বলে শুকরিয়া করলো বিধাতার কাছে।

আবার উঠে ছুটতে শুরু করলো। ঘাটের কাছে পৌঁছে দেখে একটা ট্রলারে মানুষ তোলা হচ্ছে। ওপারে যাবে। সে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে তাকিয়ে ব্যর্থ চোখে খুঁজলো স্বামী সন্তানদের। ওরা পরে আসুক। আমি আগে এই বাচ্চাটাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাই। ওই পারে একসাথে হওয়া যাবে পরে। ট্রলার ছেড়ে দিল। ভটভট করে এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার চিরে। সীমান্ত প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দেবার জন্য বাতি নেবানো। এই ছোট্ট ট্রলারে কমসে পঞ্চাশজন মানুষ উঠেছে। গাদাগাদি অবস্থা।

হোসনা বেগম এক কোনায় বসে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্ত বাচ্চাটা দুধ না পেয়ে চিৎকার শুরু করে। আশেপাশের মানুষজন বিরক্ত হয় বাচ্চাটার তীক্ষ্ণ গলায়। ধমক দিল কে যেন। অবোধ বাচ্চা এসব কি শুনে? আরেকজন হিংস্র হয়ে হোসনাকে বলে বসে, "মাগী, এখন তোরে শুদ্ধা নদীত ফালাই দিয়ুম"। হোসনা ফোঁস করে উঠতে গিয়ে চুপ মেরে যায়। পরিস্থিতি অনুকুলে না এখানে। প্রাণের ভয়ে মানুষ খুব হিংস্র হয়ে যায়, মানবতাবোধ উঠে যায়। সে বাচ্চাটাকে গলা টিপে ধরে চুপ করাতে চায়। খানিকপর বাচ্চাটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

তীরের কাছাকাছি আসলে বাতি দেখা গেল ওই পাশের গ্রামের। ওটাই বাংলাদেশ। ওখানে যে কোন একটা নিরিবিলি জায়গায় নামিয়ে দেবে ওদের ট্রলারটা। ঘাটের দিকে বিজিবি আছে যাওয়া যাবে না। আরো উত্তরে গিয়ে একটা বিরান চরের মতো জায়গায় ট্রলার তীরে ভিড়লো। নোঙর ফেলে তক্তা লাগানো হলো কাদাময় তীরের সাথে। কিন্তু কোত্থেকে জানি হঠাৎ ভুতের মতো উদয় হলো ১৫-২০ জনের একটা সশস্ত্র দল। মিশমিশে কালো রঙ। টর্চ মারলো ট্রলারে। সব যাত্রী মিলে আর্ত চিৎকার শুরু করলে ট্রলার চালক বুঝলো ডাকাত পড়েছে। সে দ্রুততার সাথে নোঙর তুলে পেছন দিকে চালিয়ে দিল  ট্রলার। কিন্তু ডাকাতরা তাদের নৌকা নিয়ে তাড়া শুরু করলো ট্রলারকে। ট্রলার মাঝ নদীর দিকে যাওয়া শুরু করলে, যাত্রীরা আরেক আতংকে পড়ে যায়। আবার ওই পাড়ে? এপারের এত কাছে এসে কেউ ওপারে ফিরে যেতে চায় না। শুরু হলো গন লাফ দেয়া। সবাই ট্রলার থেকে লাফিয়ে সাঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা করছে। মরলে মরবে তবু বার্মার ফিরবে না। এই অবস্থায় হোসনা বেগম দিশেহারা বোধ করলো। এই নৌকায় থাকলে সেও মরবে, বাচ্চাটাও মরতে পারে। তার চেয়ে বাচ্চাটাকে খোলের একপাশে রেখে দিলে হয়তো বিধাতার করুণায় বেঁচে থাকবে বাচ্চাটা। সে সাঁতরে কুলে উঠতে পারলে বাচ্চার খবর নেয়া যাবে পরে। আপাততঃ তাকে প্রাণে বাঁচতে হবে। প্রাণ আর বাচ্চা, দুটোর মধ্যে সে প্রাণটাকে বেছে নিল। লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে সেও সাঁতার দিল তীরের দিকে। ট্রলারটা কিছুদূর পিছিয়ে চলতে শুরু করলো অনুকুর কোন ঘাটের দিকে। চালক আর তার সহকারী বাদে কেউ নেই আর। তাই এখন বিজিবি ধরলেও সমস্যা নাই। তবু তীরে ভেড়ার আগে সরে যেতে পারলে ভালো হয়। এই ট্রলারের মালিক বদি মেম্বারকে সবাই জানে, এটা মাঝনদীতে ফেলে গেলেও চুরি করবে না কেউ।

মাঝরাতের পর টহলে বেরিয়েছে মেজর সাইফুল। সাথে বিজিবির সৈনিকদল। শাহপরী দ্বীপের অদূরে একটা ট্রলারকে ভাসতে দেখে সন্দেহ লাগলো। ওটাকে সিগনাল দিয়ে ডাকছে তবু কোন সাড়া নেই। নিজেদের নৌকা নিয়ে কাছে গিয়ে দেখলো জনমানবহীন একটা ট্রলার। কোন কারণে এর যাত্রী চালক সবাই পালিয়েছে। একটু অবাক হলো সাইফুল। সে সার্চ করতে নির্দেশ দিলে টর্চ জ্বালিয়ে একজন নীচে নামলো। নীচে ইঞ্জিন রুমে গিয়ে চিৎকার দিল, "স্যার স্যার। একটা বাচ্চা"।

সত্যি সত্যি হাতে করে একটা মাথা কামানো বাচ্চা হাতে নিয়ে উপরে উঠে এল সৈনিকটি। এত ছোট বাচ্চাকে ফেলে পালিয়ে গেছে বাবামা? কি নির্মম! বাচ্চাটিকে নিয়ে কি করা যায়, মুশকিলে পড়া গেল। এরকম ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। বাচ্চাটি এই দেশের নাকি ওই দেশের সেটা বোঝাও মুশকিল। কিন্তু মানবতা তো জাতি ধর্ম বর্ন মানে না। সে পাশের গ্রামের এক জেলের কাছে হস্তান্তর করলো বাচ্চাটিকে।  সাত সন্তানের জনক হয়েও ঘোলাপাড়ার জেলে কবির আহমদ বাচ্চাটির দায়িত্ব নিয়ে নিল। তার বউকে বাচ্চাটার দেখাশোনা করার জন্য দিল।

ওদিকে হোসনা বেগম তীরে ওঠার পর যখন হুশ ফিরলো, তখন বাচ্চাটির কথা মনে হতেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। সে পাগলের মতো ছুটতে শুরু করলো আবার। যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে বাচ্চার কথা। কিন্তু কেউ বলতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল শুকিয়ে যায়। কেমন মা সে, কি করে বাচ্চাটাকে ফেলে নদীতে লাফ দিল সে। নিজেকে শাপান্ত করতে লাগলো সে। ভুলে গেল তার ফেলে আসা স্বামী সন্তানের কথা। কেবল টুকু টুকু করে চিৎকার করছে রাস্তায়। দুদিন পেরিয়ে গেলেও সে বাচ্চাটির কোন খোঁজ পেল না। তৃতীয় দিন কি মনে করে সে ঘাটের কাছে গেল। ওখানে কতো লোক আসা যাওয়া করে। নিশ্চয়ই কেউ সেই বাচ্চার খবর দিতে পারবে।

কিন্তু ঘাটের কাছে গিয়েই ভুল করে ফেললো। ধরা পড়ে গেল বিজিবির একটা দলের হাতে। ওদের জেরার মুখে সে স্বীকার করলো যে ওই পারের বাসিন্দা সে। তাকে ধরে অন্যন্যদের সাথে লাইনে দাড় করিয়ে দেয়া হলো। এই চল্লিশজনকে পুশব্যাক করা হবে সীমান্তের ওপারে। সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। হোসনা অনেক মিনতি করে, তার বাচ্চার কথা বলে। বাচ্চাকে খুজে পেলে তাকে নিয়ে চলে যাবে বলে কথা দেয়। কিন্তু কিছুতেই মন গলাতে পারে না। ধমক খেয়ে লাইনে ফিরে যায় মাথা নীচু করে। নীরবে কাঁদে সে। বাচ্চাটা মরেই গেছে বোধহয়।

আরো উনচল্লিশ জনকে নিয়ে হোসনা বেগমের ফিরতি নৌকাটা যখন নাফ নদীর ওই পাড়ে যাচ্ছিল, তখন সাড়ে তিন মাইল দক্ষিনের ঘোলাপাড়ায় তার জানের টুকু চার হাত পা নেড়ে নতুন সংসারের নতুন মানুষদের চিনে নেবার চেষ্টা করছিল। তার মা হোসনা বেগমের সাথে হয়তো আর কোনদিনই দেখা হবে না।

সংবাদ সুত্রঃ
http://www.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=238218

Tuesday, June 5, 2012

তৃতীয় মাত্রা

১.
আমরা যেসব মানুষকে পছন্দ করি, তাদের প্রায় সবকিছু মেনে নেই। এমনকি সে অন্যায় করলে তাতেও আপত্তি করি না। আবার সেই মানুষের উপর আমাদের একটা প্রত্যাশাও তৈরী হয়ে যায়। প্রত্যাশিত গুনাবলী তার মধ্যে আছে কিনা জানি না তবু আশা করে বসি সে আমার প্রত্যাশামতো আচরণ করবে। যদি মনে মনে করা প্রত্যাশার সাথে মিল পাওয়া না যায় তখনই ধাক্কা লাগে।

২.
আমার পছন্দের মানুষকেও ঘৃনা করি সময়ে সময়ে ভুল আচরণের কারণে। খুব প্রিয় বন্ধু/বান্ধবী যখন রাগের সময় বলে বসে আই হেট ইউ, তখনকার জন্য সেটা সত্য। আবার যখন মেজাজ ঠান্ডা হয় তখন হেইট থাকে না তার মনে, কিন্তু হেইট করা বন্ধুর কলিজায় ওটা দগদগে ঘা করে দিয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিক সময়ে কেবল সরি না বলে আলগা কিছু ভালোবাসার মলম প্রয়োগ করা উচিত যাতে সেই ক্ষত কিছুটা হলেও চাপা পড়ে।

৩.
বিশ্বাস ও সন্দেহ দুটোই বিপরীত ধারণা। এরা একে অন্যকে যখন তখন খুন করতে পারদর্শী। তাই এই দুয়ের সহাবস্থান সম্পর্কের জন্য নিরাপদ নয়।

৪.
সম্পর্ক মানে প্রেম নয়, সম্পর্ক মানে বন্ধুতা নয়, সম্পর্ক মানে আত্মীয়তা নয়। এই তিনটাই সম্পর্কের আওতাভুক্ত কিন্তু প্রত্যেকটির ভিত্তিমূল আলাদা। যদি ভিত্তিটা মজবুত থাকে তবে সন্দেহের তীরবিদ্ধ হয়েও সম্পর্ক অবিচল থাকতে পারে।

৫.
সীমাবদ্ধতা বেশীরভাগ সক্ষম মানুষের অসহায়ত্ব।

৬.
নাই বলেই আমি বুঝি থাকাটা কতো আনন্দের।

৭.
তৃতীয় মাত্রাটা নতুন আবিষ্কার। এটা নতুন একটা জগত তৈরী করে। ওই জগতে নিরুপদ্রপে অন্য একটা জীবন যাপন করা যায়। যে জীবন প্রথম দ্বিতীয় মাত্রার মানুষের পক্ষে অসম্ভব, তৃতীয় জীবনে তা খুব সহজ।

Monday, June 4, 2012

বইবাজি

সাধ সাধ্যের বর্ডার লাইনে যাদের বসবাস তাদের জন্য কোন শখই সহজপাচ্য থাকে না। বইকেনা ব্যাপারটাও আমার জন্য সহজ ছিল না। সাধারণত কলেজ পড়ুয়া বয়স থেকে বইপত্রের রোমাঞ্চকর জগত ব্যাকুল হয়ে ডাকতে থাকে স্থায়ী আসন গাড়ার জন্য। স্থায়ী আসন মানে বই কিনে একের পর এক ভাঁজ করে বুক শেলফে সাজিয়ে রাখা। সেই শখটা আমাকে ডাক দিতে শুরু করেছিল কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটির শুরুতেই যখন পরিবারের সাধসাধ্যের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধটা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। ফলে বাবা-মার হোটেলে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা সহ সব মৌলিক অধিকারের বন্দোবস্ত থাকলেও 'আউট বই' কেনার কোন বাজেট ছিল না। বই কেনার জন্য বিকল্প ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হতো। যেভাবে দিন মজুরেরা এক দিনের আয় দিয়ে আজকের খাবারটুকু ম্যানেজ করে সেভাবে বই কেনার ব্যবস্থা হতো কয়েকদিনের রিকশা ভাড়া কিংবা বাজার খরচ থেকে বাঁচিয়ে। 

একটু পেছনে যাই।

আগ্রাবাদ কলোনী স্কুলের দক্ষিণ কোনার ছোট্ট লাইব্রেরী ঘরটা যেদিন ছাত্রদের জন্য খুলে দেয়া হলো সেদিন আমার জগতে নতুন একটা পৃথিবী যুক্ত হলো। তখন আমি ক্লাস সেভেনে। লাইব্রেরী কার্ডে প্রথম যে বইটির নাম উঠলো, সেটি ছিল 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স'। কার্ডে নাম লিখে যত্নের সাথে বইটা যখন হাতে নেই, সেই অনুভুতির রোমাঞ্চ এখনো স্পষ্ট আমার কাছে। তালাবদ্ধ আলমীরা থেকে একটা বই আমার হাতে লোভনীয় একটা কেকের মতো লাগছিল। একেকটা বই হলো একেকটা এডভেঞ্চার। যে কোন স্কুলে 'আউট বই'য়ের এর একটা লাইব্রেরী অতি অপরিহার্য অঙ্গ। নিজের হাতে বই যোগাড় ওটাই প্রথম হলেও বাবার হাত দিয়ে বই কেনা শুরু হয়েছিল আরো দুই ক্লাস আগে। সময়কে দুবছর পিছিয়ে নেই।

ক্লাস ফাইভে কি সিক্সে বাবা আমাকে বইয়ের দোকান চিনিয়েছিল প্রথম। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের দোতলায় সিঁড়ির পাশেই এল শেপের বড়সড় একটা দোকান ছিল। সেই দোকানে কয়েকটা অনুজ্জ্বল টিউবলাইটের আলোয় কিছু বই কেমন একটা ঝিমধরা ঘ্রান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো কাঠের তাকগুলোতে। ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত সেই তাকগুলোর মাত্র তিন চার তাক আমার নাগালে। তার মধ্যেই আমার এডভেঞ্চারের রাজ্য। ওই দোকানটি আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। যদি আমাকে নস্টালজিক স্মৃতির কোন প্রতিযোগিতা করতে বলা হয়, তাহলে আমি সেই দোকানটির কথাই বলবো সবার আগে। যার নাম ছিল, বইঘর। আমার সর্বকালের সেরা বইয়ের দোকান। ছেলেবেলার প্রিয় জিনিসগুলো কেন যেন কখনোই হারে না।

সেই দোকানটিতে অদ্ভুত একটা নীরবতা কাজ করতো। যেরকম নীরবতা থাকে প্রাচীন উপাসনালায়গুলোতে, ঠিক সেরকম নীরব প্রাচীনগন্ধী এক নীরবতার আশ্রয় ছিল বইঘরে। আমি সেই নীরবতাকে ভালোবাসতাম। কৈশোরে বা তারুণ্যের সূচনায় যতবার নিউমার্কেটে গিয়েছি অবশ্যই বইঘরে একবার পা দিয়েছি। বই না কিনলেও বইয়ের ঘ্রান নিয়ে ফিরে এসেছি। বইঘর থেকে কেনা প্রথম দুটো বই, আমার স্কুলের এক সহপাঠি পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। আমার সেই প্রথম কোন বই হারানো। বন্ধুটি বই ফেরত দিচ্ছে দেবে করতে করতে একসময় স্কুলই ছেড়ে চলে যায়। আমি শোকটা ভুলতে পারিনি বহুকাল। তারো প্রায় দুই যুগ পর একদিন সেই বন্ধুটির সাথে রাস্তায় দেখা। দুজনে হাত মিলিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে আমার মনে পড়ে গেল সেই বই দুটোর কথা। ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, বইদুটো এখনো আছে কিনা। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না। এখন আমার হাজার বইয়ের মেলা, তবু শৈশবের সেই বই দুটোর শোক ভুলতে পারি না।

বই কেনা আমার জন্য কেন সহজ ছিল না সেটা বলছি। যখন সত্যিকার অর্থে বই কেনার নেশায় পেয়ে বসেছে তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু, সেই সাথে অভাবের দিনেরও। সামর্থ্য ছিল না নতুন বই কেনার। বই কেনা প্রায় বিলাসিতা তখন। তাই খুঁজে খুঁজে পুরোনো এডিশানের বই কিনতাম সস্তায়। বইয়ের এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগতো। বর্তমানমূল্য বলে কিছু ছিল না। যে দামে প্রকাশিত, সেই দামেই বইটা কেনা যেতো। মনে আছে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ৫ টাকা দামের বই একই দামে কিনেছিলাম কারেণ্ট বুক সেন্টার থেকে ১৯৮৮ সালে। 'বইঘর' ছাড়াও তখন যাওয়া শুরু করেছি নিউমার্কেটের/আশেপাশের আরো কয়েকটা দোকানে। কারেণ্ট বুক সেন্টার তাদের অন্যতম। 'লাইসিয়াম' নামের একটা দোকান ছিল একতলায়। বিজ্ঞানের বইসহ বিদেশ থেকে প্রকাশিত বইপত্র পত্রিকা পাওয়া যেত। রিডার্স ডাইজেস্টের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু উচ্চমূল্যের জন্য কিনতে পারতাম না। ভাবতাম যদি কোনদিন বড়লোক হই তবে অবশ্যই রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকাটির প্রত্যেকটা সংখ্যা কিনে ফেলবো। 'লাইসিয়াম' বাদে আরো দুটি দোকান 'মনীষা', আর 'উজালা'য় মাঝে মধ্যে উঁকি দিতাম। 'কারেন্ট বুক সেন্টার' ছিল নিউমার্কেটের রাস্তার উল্টোদিকে জলসা সিনেমার নীচে । সবচেয়ে বেশী বই কালেকশান ওই দোকানেই। মননশীল বই পছন্দে নিউমার্কেট এলাকার পরে আন্দরকিল্লা। যদিও আন্দরকিল্লা মূলত পাঠ্যবইয়ের আড়ত, তবু ওখানেও কয়েকটা ভালো দোকান খুঁজে পেয়েছিলাম। 'কথাকলি' ছিল অন্যতম। ছোট্ট দোকানটিতে মজার সব বই। কালজয়ী উপন্যাস থেকে গুরুগম্ভীর তত্ত্বের বই সবকিছু ছিল। তারপর খোঁজ পাই 'বুক সিন্ডিকেট' নামে প্রাচীন একটা দোকান। জামে মসজিদের উল্টোদিকে দোতলায়। সেখানেও বিরল কিছু বই পাওয়া যায়। জামে মসজিদ মার্কেটে 'সুপ্রীম' নামের একটা দোকানেও ভালো কালেকশান ছিল। বই কেনার চেয়ে বইয়ের ঘ্রান নিতেই যেন দোকানগুলোতে ঢুঁ মারা হতো বেশী।

ভার্সিটিতে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ছিলাম বোধহয়। সেবার হাত একদম খালি। বই কেনা দূরে থাক, বইয়ের দোকানে যাবার বাসভাড়াও নেই। আমার বাসা আগ্রাবাদে। বইয়ের দোকানগুলো নিউমার্কেট আর আন্দরকিল্লায়। বাবার কাছে হাত পাতার মতো অবস্থা নেই। দুপুরে খাবার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কি করা যায়। তাকের ওপর সাজিয়ে রাখা ইন্টারের পরিত্যক্ত বইগুলোর দিকে চোখ গেল। ফিজিক্সের একটা বই আ্ছে প্রায় নতুন। হোয়াইট প্রিন্টের বইটা বেশ ভারী। দেড়শো টাকায় কেনা। একাডেমিক বইপত্রের প্রতি আমার আজন্ম বিরাগ। পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই কটকটিওয়ালার ঝুড়িতে যায়। এটা যায়নি চেহারা সুন্দর বলে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেললো মাথায়। বইটা নামিয়ে একটা পলিথিনে ভরে চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সোজা আন্দরকিল্লা। জামে মসজিদের উল্টোদিকের ফুটপাতে পুরোনো বইয়ের দোকান। সেখানে গিয়ে দরদাম করে দেড়শো টাকার ফিজিক্স বইটা বিশ টাকায় গছিয়ে দিলাম। কী আনন্দ, বিশ টাকার মূল্য অনেক তখন।  হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট এসেছি। উজালা বইঘরে ঢুকে খুজতে খুজতে হঠাৎ একটা বইয়ের দিকে চোখ গেল। বাংলাদেশের ছোটগল্প। গত একশো বছরের কালেকশান। এমন লোভ লাগলো এখুনি কিনে ফেলতে চাই। কিন্তু দাম দেখে থমকে গেলাম। চল্লিশ টাকা। নিরাশ হয়ে বইটি রেখে দোকানের বাইরে চলে আসি। কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে নড়তে পারছি না। যদি কেউ এসে বইটা নিয়ে যায়। অনেকদিন আগের পুরোনো সংস্করন, বাজারে পাওয়া যাবে না এখন। ছোট্ট একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। নিউমার্কেটে শাড়ির দোকানে চাকরী করে এক আত্মীয়। তার কাছে যাওয়া যায়? এক দোকান কর্মচারীর পকেটে নগদ বিশ টাকা কি থাকবে? অবাক হবার কিছু নেই। আশির দশকের সেই সময়ে পকেটে পাঁচ টাকা থাকলেও নিজেকে স্বচ্ছল মনে হতো। সাহস করে তার কাছে গিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম সমস্যার কথা। সেই মহানুভব আত্মীয় কোত্থেকে যেন ২০ টাকার বন্দোবস্ত করে দিল এবং আমি বইটা কিনে বাসায় ফিরতে পারলাম। কী যে অসাধারণ সেই অনুভূতি!

আরো কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম একটা পুরোনো বইয়ের দোকান। অমর বই ঘর। নূপুর সিনেমার পাশেই দোতলায় ঘুপচিঘরের মধ্যে দোকানটা। আহ তখন সেই দোকানে ঢুকলে মনে হতো আমি উনিশ শতকের কোন পুরোনো নগরীতে চলে গেছি। যে নগরীতে আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত বইতে ছাওয়া। একবার ঢুকলে দু ঘন্টার কমে বেরুতে পারতাম না। কঠিন এক নেশা। লোভ হতো রিডার্স ডাইজেস্টের প্রতি। এমনকি পুরোনো সংখ্যা হলেও। এই পত্রিকাটির পুরোনো সংখ্যাগুলোও একেকটা ক্লাসিক। অমর বইঘরে পুরোনোগুলো বিক্রি করতো অর্ধেক দামে। তাও সামর্থ্যে কুলোতো না আমার। তারপর আরো কবছর পর পেয়ে যাই আরেকটা খনি। নূপুর সিনেমার অন্যপাশে একটা মিষ্টির দোকান ছিল, সেই দোকানটার আড়ালে দেখি একটা বইয়ের দোকান হা করে বসে আছে, লোকজন কেউ নেই। আমি দোকানটায় ঢুকে রীতিমত হতভম্ব। দোকানটি খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বই বিক্রি করে। কিন্তু হতভম্ব হয়েছি বিরল সব ইংরেজী বই থরে থরে সাজানো দেখে। সাথে আছে রিডার্স ডাইজেস্টের পুরোনো বেশ কিছু কপি। ইংরেজী বইয়ের অনেক দাম বলে কখনো কেনার সাহস করিনি। কেবল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে গিয়েই পড়তাম। দোকানী কাছে এসে অভয় দিয়ে বললো, এই বইগুলো বিশেষ মূল্যে বিক্রি করছেন। ইংরেজী বই আর ম্যাগাজিনগুলো এক মিশনারীর কাছ থেকে সংগৃহিত, যিনি দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম বাস করছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যার বিশেষ ভূমিকা ছিল। পাকিস্তানী সেনাদের হুমকির মুখেও বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি তিনি। তাঁর নিজের লেখা বইও আছে এ ব্যাপারে। ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে সম্ভবত কিছু বই বিক্রি করে দিয়েছেন। ঠিক কারণটা মনে নেই। রিডার্স ডাইজেস্টগুলো পাঁচ টাকা মূল্যে বিক্রি করবেন বললেন। আমি সেদিনের মতো চলে এলাম। পরে টাকা যোগাড় করে বিরাট সংখ্যক ইংরেজী বই কিনে ফেলেছিলাম। কথা ছিল বইয়ের মালিকের সাথে একদিন দেখা করবো। একজন বিদেশী নাগরিক হিসেবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। একদিন দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল। দোকানীর কাছেই ওই ভদ্রলোকের যোগাযোগের সুত্রটা ছিল। দোকান বন্ধ হবার সাথে সেই সুত্রটাও হারিয়ে গেল। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো তাঁর নামটাও ভুলে গিয়েছি।

শহরের পরিধি বেড়েছে গত দুই দশকে। সেই হিসেবে বইয়ের দোকান তেমন বাড়েনি চট্টগ্রামে। গত ক'বছরে মাত্র কয়েকটা নতুন দোকান যুক্ত হয়েছে। বিশদ বাঙলা, বাতিঘর, নন্দন সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারেন্ট বুক সেন্টারে যাওয়া কমে গেছে অনেক। নিউমার্কেট এলাকার ঘিঞ্জি আর যানজট পেরিয়ে ওখানে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু কারেণ্ট বুক সেন্টার আমার বই সংগ্রহের অন্যতম প্রিয় জায়গা হয়ে থাকবে সবসময়। কারেন্ট বুক সেন্টারের শাহীন ভাইয়ের আন্তরিকতার কথাও ভোলার মতো নয়। বই নিয়ে এরকম সুরসিক আড্ডাবাজ মানুষ পাওয়া ভার। বাবার তৈরী করা এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরে রেখেছেন এখনো।

একটা সময় গেছে যখন বই কিনে গোগ্রাসে গেলার অনেকদিন পর আরেকটা বই কিনতে পারতাম। এখন বই কেনা হয় অনেক, কিন্তু পড়ে শেষ করা যায় না। বেড়ে যাচ্ছে আধপড়া বইয়ের সংখ্যা। আজকাল সবচেয়ে বেশী অভাববোধ করি সময়ের। শেষবেলায় অনেকগুলো না পড়া বই রেখে যেতে হবে হয়তো।



বাড়িওয়ালী

কোন দেয়ালেই ছবিটা মানাচ্ছিল না। যেখানেই ঝুলাই মনে হয় ছবিটা টেরা চোখে তাকিয়ে আছে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটাতেও ফিট করা গেল না। ছবিটাতে সবুজ ত্বকের একটা বাচ্চা ছেলে কেমন একটা অদ্ভুত  দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগে না। অথচ যখন আর্ট গ্যালারীতে অনেক ছবির ভিড়ে সাজানো ছিল বোঝা যায়নি। এই একলা ঘরে ছবিটা সামনে রেখে বসতে কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে।

আমি তিনতলা একটা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকি। বিয়ে থা করিনি বলে স্বাধীন জীবনযাপন। বাড়িওয়ালা লোকটা ভালোই ছিল কিন্তু তার স্ত্রী দজ্জালের দজ্জাল। লোকমুখে শোনা যায় গত বছর বাড়িওয়ালা যখন হঠাৎ এক ভোরে মারা গেল, তখন তার লাশটাও ঠিকমতো কেউ দেখতে পারেনি বাড়িওয়ালীর শীতল চাউনির কারণে। নিন্দুকেরা বলে লোকটাকে বাড়িওয়ালী গলা টিপে হত্যা করেছে। সেই ঘটনার পর থেকে আমি বাড়িওয়ালীকে এড়িয়ে চলি। বাসাটা ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম অনেকবার। কিন্তু এত সস্তায় এরকম নিরিবিলি একটা ঘর কোথাও পাবো না। আমি অবশ্য সারাদিনই বাইরে থাকি, বাড়িওয়ালীর মুখোমুখি হই মাসে একবার ভাড়া দেবার সময়। সেই সাক্ষাতেও চেষ্টা করি কোন কথা না বলে থাকতে। কিন্তু বাড়িওয়ালী খনখনে গলায় তার চিরায়ত উপদেশ বিতরণ করতে ছাড়ে না। উপদেশ দেবার সময় বাড়িওয়ালীর চোখে কোন কোমলতা থাকে না। কেমন একটা রাগী কমলা দ্যুতি চোখ থেকে ঠিকরায়। গা টা শিউরে ওঠে আমার।

এই বাড়িওয়ালীই গতমাসে ভাড়া নেবার সময় আমার ঘরে উঁকি দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিল, 'এ কেমন ঘর একটা পেইন্টিংও নেই। শুনেছি কবি-সাহিত্যিকগন রুচিবান হয়। আপনার দেখি রুচির র-ও নেই'। আমি পেইন্টিং এর উচ্চমূল্যের কথা বলাতে ঝামটা মেরে বলে উঠে বলেছিল জীবনে কোনদিন আর্ট গ্যালারীতে গিয়েছি কিনা। তারপর আমাকে একটা আর্ট গ্যালারীর নাম দিয়ে বলে ওখানে একটা ছবি আছে যেটা সর্বোচ্চ ডিসকাউন্টে কেনা যাবে। রুচি বদলানোর চ্যালেঞ্জ নিতেই ছবিটা কিনতে হলো।

কিন্তু একটা কৌতুহল বাকী থেকে গেল। ছবিটার শিল্পী কে ছিল অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারিনি। ছবিটা যেখান থেকে কেনা হয়েছে সেটা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন আর্ট গ্যালারী। আটত্রিশ বছর এই শহরে বাস করলেও সেই আর্ট গ্যালারির খবর পেয়েছি মাত্র দুদিন আগে। এই গ্যালারির আদি ব্রিটিশ মালিক মরে ভুত হয়ে গেছে চল্লিশের দশকেই। তারপর পাকিস্তান আমল ঘুরে বাংলাদেশ আমল হয়ে কমপক্ষে পাঁচবার হাত বদল হয়ে বর্তমান মালিকের কাছে এসেছে। তাই এই ছবির ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান মালিকের কাছ থেকেও কিছুই জানা গেল না। জানার মধ্যে এটুকুই জানা গেছে আর্ট গ্যালারীর সবচেয়ে পুরোনো ছবি হলেও এই ছবিটা আগে কেউ কিনতে আকর্ষণ বোধ করেনি। উপযুক্ত ক্রেতার অভাবে ছবিটা এত বছর অবিক্রিত অবস্থায় রয়ে গেছে।

শতবর্ষ প্রাচীন পেইন্টিং হলেও এর উপর বয়সের কোন ছাপ পড়েনি। ফ্রেমগুলো পুরোনো হয়ে রং চটে একাকার হয়ে গেলেও মূল ছবিটাতে কোন ছাপ নেই। ওটা থেকে এমন একটা রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে যা দেখে মনে হয় মাত্র গতকাল আঁকা। ছবির ফ্রেমটা ছিল মোটা কাঠের। পোকায় খেয়ে ঝুরঝুর করে ফেলেছিল বলে বাড়িতে আনার পর সেটা থেকে কাঠগুলো খসিয়ে ছবিটাকে আলাদা বের করে নিয়েছি। আপাততঃ স্কচটেপ দিয়ে আলমারির পাল্লার সাথে সেঁটে রেখেছি। ছবিটা আসলে এমন এক রকমের কাগজের উপর আঁকা যা প্রাথমিক স্পর্শে কাপড়ের মতো মনে হয়। সেই জন্যই হয়তো সস্তা মিলেছে। কিন্তু কাগজে আঁকা ছবি এতকাল টেকার কথা না। তাহলে? কেউ একজন মিথ্যে বলছে আমাকে। বাড়িওয়ালী নাকি দোকানী? কিছু একটা গোলমাল আছে ছবিটাতে। ছবিটা এত পুরোনো হতেই পারে না। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম। এতকাল পড়া রহস্যগল্পগুলোর সুত্র ধরে শার্লক হোমস হবার চেষ্টা করছিলাম।

কারেন্ট চলে গেল হঠাৎ। হাতের কাছে মোমটোম নেই। দোকানে যেতে হবে। বিছানা থেকে উঠতে যেতেই ছবিটার দিকে চোখ গেল। এই অন্ধকারেও হাসছে সবুজ বালকটা। কেমন কুৎসিত হাসি। দাঁতগুলো বেরিয়ে গেছে। সবুজ মুখের লাল ঠোটে কালতে তরমুজের বিচির মতো দাঁত। ড্রাকুলার চেয়েও ভয়ংকর লাগছে। পান খেয়েছে নাকি রক্ত? কোথাও এক ফোঁটা আলো নেই, তবু অন্ধকারে ছবিটা দেখা যাচ্ছে কি করে?

আরো আশ্চর্য, আমি দোকানে যাবো ঠিক করেছি, কিন্তু ছবির বালকটা ইশারা করে বলছে কোন দরকার নেই!! নীচে নামতে গেলে নাকি বিপদ। বাড়িওয়ালী দোতলার অন্ধকার সিড়িতে বটি  নিয়ে দাড়িয়ে আছে। টুকরো টুকরো করে কেটে রক্ত খাবে। এই ছবি কথা বলে!!! কথাটা শোনামাত্র আমার রক্তে ভয়ের বান ডাকলো। সারা শরীরে কে যেন সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে রক্ত বের করে নিচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এমন সময় দমাদম শব্দ হলো দরোজায়। কেউ যেন দা দিয়ে কোপাচ্ছে দরজার উপর। দরোজাটা এমনিতে নড়বড়ে। সেই সাথে বাড়িওয়ালির ত্রাহি চীৎকার 'আগুন আগুন'। কোথায় আগুন? নিশ্চয়ই এটা কোন প্রতারনা অথবা আমাকে ঘর থেকে বের করার ফন্দী। দরোজার দমাদম আওয়াজ থামছেই না।

চোখ খুলে গেল আমার। দেখলাম জানালা দিয়ে কমলা রঙের আলো আসছে। আর আগুনের হলকা। সত্যি সত্যি আগুন লেগেছে সামনের বস্তিতে। বাড়িওয়ালীর চিৎকার আর দরজায় আঘাত তখনো চলছে। আমি শিরশির অনুভুতি নিয়ে দরোজা খুলতেই আমাকে এক হেঁচকায় টেনে বাইরে নিয়ে গেল বাড়িওয়ালী। আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না, বাধাও দিতে পারছি না। সিড়ি দিয়ে একরকম টেনে হিঁচড়ে আমাকে গেটের বাইরে নিয়ে এল সে। যে কোন সময় আগুন বস্তি ছাড়িয়ে এ বাড়িতেও ধরে যাবে। প্রচণ্ড গরমে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ওই গরমেও শীতের কাঁপুনি দিল গায়ে যখন বাড়িওয়ালী আমার একদম কাছ ঘেষে কেমন ফিসফিস করে বললো, "আশ্চর্য মানুষ!! এমন মরন ঘুম মানুষের হয় নাকি? আরেকটু হলেই তো ঝলসে যেতেন। আপনাকে যে আমার খুব দরকার!"  কথাগুলো বলার সময় খেয়াল করলাম তার চোখ দুটো দিয়ে কমলা রং ঠিকরে বেরুচ্ছে। আসলে প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখা ওটা। তার ডানহাতটা আমার বামহাতের কবজি প্রায় মুচড়ে চ্যাপটা করে দিচ্ছে। আমি হাত ছাড়াতে চাইলে সেই চোখ দুটো এমন কামনার চোখে তাকালো আমি অনড় হয়ে গেলাম।

আগুন নিবে গেলে ঘরে ফিরে এলাম। আগুন লাগার পর কারেন্ট চলে গিয়েছিল, এখনো আসেনি। যতদূর দেখা যায় আমাদের বাড়িটার তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু টেবিলের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম, ছবিটা নেই! অন্ধকারে হাতড়ে টেবিলের আশেপাশে কোথাও ছবিটা পেলাম না। সকালে উঠে আবারো খুজলাম। নেই ছবিটা কোথাও। আশ্চর্য! রীতিমত হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? এই আগুনের মধ্যে চোর আসার কথা না। চোর এসে শুধু ছবিটা নিয়ে গেল? ঘড়িটা পর্যন্ত টেবিলে রয়ে গেছে।

পরদিন রাতে গরম লাগছিল বলে ছাদের দিকে দরোজাটা খোলা রেখে শুয়ে পড়লাম। গরমকালে কারেন্ট চলে গেলে প্রায়ই এরকম করি। কারেন্ট গেছে সেই দশটায় এখনো আসেনি। ঘুম আসছে না, তবু অন্ধকারে শুয়ে আছি। হঠাৎ ছাদের ওপাশে একটা মূর্তি দেখে তড়াক করে উঠে বসলাম। চোর? আবার এসেছে? ছবিটার কথা মনে হতে হিংস্র হয়ে উঠলাম। ড্রয়ার থেকে ছুরি বের করে বেরুলাম আস্তে। মূর্তিটা তখনো ঠায় দাড়িয়ে। আমি পেছন থেকে খেয়াল করলাম লুঙ্গি পরা খালি গা একটা ছেলে। কৈশোর পেরিয়েছে কি পেরোয়নি তেমন। 'চোর' বলে  ঝাপটে ধরে যাবো তখুনি আমার হাত থেকে ছুড়িটা কেড়ে নিল কেউ। তাকিয়ে দেখি বাড়িওয়ালী। রাত পোষাক পরে ছাদে চলে এসেছে। এই পোষাকে কেউ বাইরে আসে না। আবছা আলোয় যা দেখা যাচ্ছে তাতে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ভয় বা শিহরণ কোনটা হচ্ছে বুঝলাম না। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রবল কামনার চোখে। দুই হাতে আমাকে পেচিয়ে শূন্যে তুলে ফেললো প্রায়। দুহাতের সাঁড়াশি চাপ থেকে মুক্তি পেতে হাঁসফাঁস করছি। ছাদের কোনে তাকালাম ছেলেটা পেছন ফিরে দাড়িয়ে আছে নির্বিকার। এদিকে কি হচ্ছে তার ধারণা নেই। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। এরকম কঠিন বাঁধনে আর কোন নারী আমাকে জড়ায়নি। আমার পেছনে ছাদের কোমর সমান দেয়ালটা। প্রেমের ঠেলায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার বাড়িওয়ালীর মুখটা ঠোটমুখ ছাড়িয়ে গলায় এসে ঠেকলো, কিন্তু গলায় চুমুর বদলে বিশাল একটা কামড়!! এটাকে মরণ কামড় বলে বুঝতে দেরী হলো না। এই পিশাচনীর উদ্দেশ্য বুঝে আমি চীৎকার করে জোরে একটা ঝটকা দিয়ে আত্মরক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে অনেক বছর আগে শেখা একটা জুডোর কায়দা প্রয়োগ করলাম। সেই কায়দায় আমার মাথার উপর দিয়ে বাড়িওয়ালী উড়ে গিয়ে সামনের রাস্তায় পড়লো দপ করে।

ছাদের অপর কোনায় দাঁড়ানো ছেলেটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি তখনো এত হতবাক যে নড়াচড়া করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত বেরুচ্ছে তখনো। দেরী করা ঠিক হবে না। পুলিশী ঝামেলা হতে পারে। জিনিসপত্র গুছিয়ে সেই রাতেই পালালাম বাড়িটা ছেড়ে। পেছনে রয়ে গেল এক অমীমাংসিত রহস্য।