ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হোসনা বেগম একটা গাছের নীচে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। অল্পের জন্য মাথায় আঘাত পাওয়া থেকে বাঁচলো দুই সপ্তাহের টুকু। মাথা কামানো হয়েছে তার গত সপ্তাহে। সেই উপলক্ষে খানাপিনার আয়োজন করার কথা থাকলেও টাকার অভাবে পারেনি। আজকে রাতে একটা মুরগী জবাই করে স্বামী আর তিন সন্তানকে খাওয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মুরগীটা জবাই করে কেটেকুটে চুলায় তুলে দেয়া হয়েছিল। মশলার সুঘ্রান মৌ মৌ করছিল তাদের ছনের বেড়ার ঘরটা।
চোদ্দ বছরের মনি বাপের সাথে লাকড়ি কাটতে গিয়েছিল। ৫ আর ৭ বছরের রীতা, মিতা খেলা করছিল উঠানে। স্বামী জাগির হোসেন লাকড়ি বিক্রি করে সংসার চালায়। কদিন থেকে বাতাস গরম। যদিও মংডু শহর থেকে দূরে বাস তাদের, কিন্তু এই পাড়ায়ও কানাঘুষা। যে কোন সময় আঘাত আসতে পারে পাহাড়ের ওই পাশের গ্রাম থেকে। অনেকদিন থেকে ওরা এই পাড়ার দখল নেবার চেষ্টা করছে। এখানে ওরা ঘর তৈরি করে আছে ঠিকই, কিন্তু জায়গার মালিক সরকার। দখল করে ঘরবাড়ি করে মালিক হয় কেউ কেউ। বলা যায় জোর যার জায়গার মালিক সে। এটাই এখানকার নিয়ম।
অদূরেই নাফ নদী। ওটা পেরুলে বাংলাদেশ। অনেকে এখান থেকে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ চলে গেছে চুপি চুপি। তারাও যাবে ভাবতেছিল। ওখানে ভিক্ষা করে খেলেও বাচ্চাগুলো নিরাপদ থাকবে। এই অনিশ্চয়তা ভালো লাগে না আর। কিন্তু কোন ঝামেলা ছাড়া শান্তির সময় কে দেশ ছাড়ে। এখানে তাদের কোন জমিজমার মালিকানা না থাকলেও, এটাই তাদের জন্মভুমি, এটাই তাদের দেশ। নিজের দেশ ছেড়ে কেউ সাধে বিদেশ যায় না। মুরগীর সুঘ্রান পেতে পেতে এই কথাগুলো ভাবছিল হোসনা বেগম। আজকের দিনটা বড় সুলক্ষণ। সকাল থেকেই গরম কম, একটু বৃষ্টিও হয়েছিল দুপুরের দিকে।
জাগির হোসেন সন্ধ্যে নামার আগেই ভাত চায়। আলোতেই সব খাওয়া সেরে ফেলতে হয়। জাগির ফিরেছে মনিকে নিয়ে। সবাই খাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। অথচ মুরগীটা সেদ্ধ হয়নি এখনো। বুড়ো ধাড়ি মুরগী। আরেকটু সেদ্ধ হতে হবে। বাচ্চারাও আজকে আগেভাগে খাবার জন্য উসখুশ করছে।। বিকেলেই ভাত রান্না হয়ে গেছে। এখানে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বলে না ঘরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসা আলোতে কেবল শোবার কাজটা করে। বাকী সব কাজ দিনের আলোতে।
রান্নাও শেষ সূর্যও ডুবে গেল। দ্রুত হাতে সবার পাতে ভাত আর মাংস বেড়ে দিয়ে নিজেও একটা প্লেট নিয়ে বসলো। টুকু দুধ খাবার জন্য কান্না করছে। কিন্তু পেটে ভাত না পড়লে বুকে দুধ আসে না। তাই সে দ্রুত ভাত গিলতে শুরু করে।
হঠাৎ দূর থেকে অনেক মানুষের গুঞ্জন হৈ চৈ ভেসে আসে। ব্যাপার কি। আতংকে বুকটা হিম হয়ে আসে। ওরা আসছে না তো? এদিকে আসবে আসবে শোনা যাচ্ছিল কদিন থেকে। আজকেই সেই দিন না তো? ওহ খোদা! এইসব ঘরবাড়ি কিছুই থাকবে না। সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে। জাগির হোসেন লাফ দিয়ে উঠলো ভাত রেখে। হ্যাঁ দূরে মশাল হাতে অনেক লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। আর দেরী করা যাবে না। "মনি, রীতা, মিতা তোর উঠ, চল পালাই, ভাত খাওয়া রাখ। আগে জান বাচাই।"
কিন্তু বাচ্চারা মুরগী আর ভাত রেখে উঠতে চায় না। ওরা ভাত মাংস ঝোল গোগ্রাসে গিলতে থাকে যত দ্রুত সম্ভব। অনেকদিন পর পেটপুরে খাবার মতো একটা তরকারী পেয়েছে। এটা জানের বিনিময়েও ছাড়া যাবে না। হোসনা বেগম টুকুকে কোলে জড়িয়ে নিয়ে বলে, "তোমরা আসো আমি আগে ছুট লাগাই। নইলে পরে দৌড়াতে পারবো না এটাকে কোলে নিয়ে।"
সবকিছু ফেলে রেখে ছুটতে থাকে হোসনা। জান বাজি রেখে ছোটে। কোলের ছোট্ট টুকু চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে আধো অন্ধকারে ছুটতে থাকে সে। নদীর কাছে, ঘাটের কাছে পৌঁছাতেই হবে যে কোন উপায়ে। অনেক দেরি করে ফেলেছে। আরো কয়দিন আগেই পালানো উচিত ছিল। এখন ঘাটে কি নৌকা পাবে? আরো কতো মানুষ যাবে এই দিকে। ভাবতে ভাবতে ছুটতে থাকে। পেছনে বারবার তাকিয়ে খুঁজছে স্বামী আর বাকী তিন সন্তানকে। ওরা আসতে দেরি করছে কেন? তখনি হোঁচট খেয়ে পড়লো। টুকুর মাথাটা বাঁচলো বলে শুকরিয়া করলো বিধাতার কাছে।
আবার উঠে ছুটতে শুরু করলো। ঘাটের কাছে পৌঁছে দেখে একটা ট্রলারে মানুষ তোলা হচ্ছে। ওপারে যাবে। সে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে তাকিয়ে ব্যর্থ চোখে খুঁজলো স্বামী সন্তানদের। ওরা পরে আসুক। আমি আগে এই বাচ্চাটাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাই। ওই পারে একসাথে হওয়া যাবে পরে। ট্রলার ছেড়ে দিল। ভটভট করে এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার চিরে। সীমান্ত প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দেবার জন্য বাতি নেবানো। এই ছোট্ট ট্রলারে কমসে পঞ্চাশজন মানুষ উঠেছে। গাদাগাদি অবস্থা।
হোসনা বেগম এক কোনায় বসে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্ত বাচ্চাটা দুধ না পেয়ে চিৎকার শুরু করে। আশেপাশের মানুষজন বিরক্ত হয় বাচ্চাটার তীক্ষ্ণ গলায়। ধমক দিল কে যেন। অবোধ বাচ্চা এসব কি শুনে? আরেকজন হিংস্র হয়ে হোসনাকে বলে বসে, "মাগী, এখন তোরে শুদ্ধা নদীত ফালাই দিয়ুম"। হোসনা ফোঁস করে উঠতে গিয়ে চুপ মেরে যায়। পরিস্থিতি অনুকুলে না এখানে। প্রাণের ভয়ে মানুষ খুব হিংস্র হয়ে যায়, মানবতাবোধ উঠে যায়। সে বাচ্চাটাকে গলা টিপে ধরে চুপ করাতে চায়। খানিকপর বাচ্চাটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
তীরের কাছাকাছি আসলে বাতি দেখা গেল ওই পাশের গ্রামের। ওটাই বাংলাদেশ। ওখানে যে কোন একটা নিরিবিলি জায়গায় নামিয়ে দেবে ওদের ট্রলারটা। ঘাটের দিকে বিজিবি আছে যাওয়া যাবে না। আরো উত্তরে গিয়ে একটা বিরান চরের মতো জায়গায় ট্রলার তীরে ভিড়লো। নোঙর ফেলে তক্তা লাগানো হলো কাদাময় তীরের সাথে। কিন্তু কোত্থেকে জানি হঠাৎ ভুতের মতো উদয় হলো ১৫-২০ জনের একটা সশস্ত্র দল। মিশমিশে কালো রঙ। টর্চ মারলো ট্রলারে। সব যাত্রী মিলে আর্ত চিৎকার শুরু করলে ট্রলার চালক বুঝলো ডাকাত পড়েছে। সে দ্রুততার সাথে নোঙর তুলে পেছন দিকে চালিয়ে দিল ট্রলার। কিন্তু ডাকাতরা তাদের নৌকা নিয়ে তাড়া শুরু করলো ট্রলারকে। ট্রলার মাঝ নদীর দিকে যাওয়া শুরু করলে, যাত্রীরা আরেক আতংকে পড়ে যায়। আবার ওই পাড়ে? এপারের এত কাছে এসে কেউ ওপারে ফিরে যেতে চায় না। শুরু হলো গন লাফ দেয়া। সবাই ট্রলার থেকে লাফিয়ে সাঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা করছে। মরলে মরবে তবু বার্মার ফিরবে না। এই অবস্থায় হোসনা বেগম দিশেহারা বোধ করলো। এই নৌকায় থাকলে সেও মরবে, বাচ্চাটাও মরতে পারে। তার চেয়ে বাচ্চাটাকে খোলের একপাশে রেখে দিলে হয়তো বিধাতার করুণায় বেঁচে থাকবে বাচ্চাটা। সে সাঁতরে কুলে উঠতে পারলে বাচ্চার খবর নেয়া যাবে পরে। আপাততঃ তাকে প্রাণে বাঁচতে হবে। প্রাণ আর বাচ্চা, দুটোর মধ্যে সে প্রাণটাকে বেছে নিল। লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে সেও সাঁতার দিল তীরের দিকে। ট্রলারটা কিছুদূর পিছিয়ে চলতে শুরু করলো অনুকুর কোন ঘাটের দিকে। চালক আর তার সহকারী বাদে কেউ নেই আর। তাই এখন বিজিবি ধরলেও সমস্যা নাই। তবু তীরে ভেড়ার আগে সরে যেতে পারলে ভালো হয়। এই ট্রলারের মালিক বদি মেম্বারকে সবাই জানে, এটা মাঝনদীতে ফেলে গেলেও চুরি করবে না কেউ।
মাঝরাতের পর টহলে বেরিয়েছে মেজর সাইফুল। সাথে বিজিবির সৈনিকদল। শাহপরী দ্বীপের অদূরে একটা ট্রলারকে ভাসতে দেখে সন্দেহ লাগলো। ওটাকে সিগনাল দিয়ে ডাকছে তবু কোন সাড়া নেই। নিজেদের নৌকা নিয়ে কাছে গিয়ে দেখলো জনমানবহীন একটা ট্রলার। কোন কারণে এর যাত্রী চালক সবাই পালিয়েছে। একটু অবাক হলো সাইফুল। সে সার্চ করতে নির্দেশ দিলে টর্চ জ্বালিয়ে একজন নীচে নামলো। নীচে ইঞ্জিন রুমে গিয়ে চিৎকার দিল, "স্যার স্যার। একটা বাচ্চা"।
সত্যি সত্যি হাতে করে একটা মাথা কামানো বাচ্চা হাতে নিয়ে উপরে উঠে এল সৈনিকটি। এত ছোট বাচ্চাকে ফেলে পালিয়ে গেছে বাবামা? কি নির্মম! বাচ্চাটিকে নিয়ে কি করা যায়, মুশকিলে পড়া গেল। এরকম ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। বাচ্চাটি এই দেশের নাকি ওই দেশের সেটা বোঝাও মুশকিল। কিন্তু মানবতা তো জাতি ধর্ম বর্ন মানে না। সে পাশের গ্রামের এক জেলের কাছে হস্তান্তর করলো বাচ্চাটিকে। সাত সন্তানের জনক হয়েও ঘোলাপাড়ার জেলে কবির আহমদ বাচ্চাটির দায়িত্ব নিয়ে নিল। তার বউকে বাচ্চাটার দেখাশোনা করার জন্য দিল।
ওদিকে হোসনা বেগম তীরে ওঠার পর যখন হুশ ফিরলো, তখন বাচ্চাটির কথা মনে হতেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। সে পাগলের মতো ছুটতে শুরু করলো আবার। যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে বাচ্চার কথা। কিন্তু কেউ বলতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল শুকিয়ে যায়। কেমন মা সে, কি করে বাচ্চাটাকে ফেলে নদীতে লাফ দিল সে। নিজেকে শাপান্ত করতে লাগলো সে। ভুলে গেল তার ফেলে আসা স্বামী সন্তানের কথা। কেবল টুকু টুকু করে চিৎকার করছে রাস্তায়। দুদিন পেরিয়ে গেলেও সে বাচ্চাটির কোন খোঁজ পেল না। তৃতীয় দিন কি মনে করে সে ঘাটের কাছে গেল। ওখানে কতো লোক আসা যাওয়া করে। নিশ্চয়ই কেউ সেই বাচ্চার খবর দিতে পারবে।
কিন্তু ঘাটের কাছে গিয়েই ভুল করে ফেললো। ধরা পড়ে গেল বিজিবির একটা দলের হাতে। ওদের জেরার মুখে সে স্বীকার করলো যে ওই পারের বাসিন্দা সে। তাকে ধরে অন্যন্যদের সাথে লাইনে দাড় করিয়ে দেয়া হলো। এই চল্লিশজনকে পুশব্যাক করা হবে সীমান্তের ওপারে। সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। হোসনা অনেক মিনতি করে, তার বাচ্চার কথা বলে। বাচ্চাকে খুজে পেলে তাকে নিয়ে চলে যাবে বলে কথা দেয়। কিন্তু কিছুতেই মন গলাতে পারে না। ধমক খেয়ে লাইনে ফিরে যায় মাথা নীচু করে। নীরবে কাঁদে সে। বাচ্চাটা মরেই গেছে বোধহয়।
আরো উনচল্লিশ জনকে নিয়ে হোসনা বেগমের ফিরতি নৌকাটা যখন নাফ নদীর ওই পাড়ে যাচ্ছিল, তখন সাড়ে তিন মাইল দক্ষিনের ঘোলাপাড়ায় তার জানের টুকু চার হাত পা নেড়ে নতুন সংসারের নতুন মানুষদের চিনে নেবার চেষ্টা করছিল। তার মা হোসনা বেগমের সাথে হয়তো আর কোনদিনই দেখা হবে না।
সংবাদ সুত্রঃ
http://www.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=238218