Sunday, April 30, 2023

প্রকৃতির দাসত্ব বনাম প্রকৃতির শত্রু

কাজ যখন আনন্দদায়ক হয়, তখন কেউ কাজ থেকে ছুটি চায় না। বরং ছুটি শেষ করে কাজে ফিরতে আনন্দ পায়। আমরা অধিকাংশ সময় ব্যয় করি নিরানন্দ কাজে। তাই সপ্তাহের প্রথমদিন থেকেই ভাবতে শুরু করি উইকেণ্ড কবে আসবে। আমাদের প্রাণ আনচান করে ছুটির খোঁজে।  

শৈশবের শিক্ষাজীবন থেকে শুরু হয় আমাদের নিরানন্দকাল। যে বিষয় কিংবা বই পছন্দ নয়, সে বই আমাদের জোর করে হজম করতে হয়। বদহজম করতে করতে শিক্ষাজীবন শেষ হয়। শিক্ষাজীবন শেষ করে যে পেশা আমার পছন্দ নয় সে পেশায় আমাদের ঢুকে যেতে হয়। দিনরাত অপছন্দের কাজ করে মাস শেষে বেতনটা পকেটে পুরে সুখী মানুষের ভান করতে হয়। নিজের পছন্দমত কাজ করে আয় উপার্জন করে সুখে জীবন কাটিয়েছে তেমন লোক আমি অন্তত দেখিনি।


আদিমযুগে মানুষ এতটা নিরানন্দ সময় কাটায়নি। যাযাবার শিকারীরা তাদের কাজের মধ্যেই আনন্দ উত্তেজনা বিনোদন সবকিছু পেতো। শিকারের খোঁজ করতে করতে, খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে আদিম মানুষ সারা পৃথিবীতে বংশবিস্তার করেছিল। সেই শিকারের যুগ শেষে মানুষ যখন প্রথম চাষাবাদ করতে শেখে তখন থেকে মানুষের মধ্যে দাসত্বের সূচনা হয়। মানুষকে প্রথম দাস বানিয়েছিল জমির ফসল। ফসলের দাসত্ব করার জন্য মানুষ প্রথম ঘর বাঁধতে বাধ্য হয়। পৃথিবীতে স্থায়ী গ্রামের সূত্রপাত হয় ফসলের দাসত্ব করতে গিয়ে। ফসলকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মানুষ ছুটে বেড়ানোর স্বাধীনতা হারিয়েছিল। ইউভাল নোয়াহ হারারির এই তত্ত্বটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। 



কিন্তু সেই ফসলের দাসত্ব খারাপ কোন ব্যাপার ছিল না। ওটা ছিল আধুনিক সভ্যতার প্রথম উন্মোচন। কিন্তু ফসল দাসত্বের বিবর্তনে মানুষ যে বাণিজ্যের দাসে পরিণত হতে শুরু করেছিল, সেখান থেকেই সভ্যতার সংকট শুরু। ফসল বিক্রি করার অধিকার পেতে, কিংবা অন্যের ফসল দখল করার তাগিদে গিয়ে পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধের জন্ম হয়। অস্ত্র এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবনের অধিকাংশই ছিল দূরের জিনিসে হাত বাড়ানোর তাগিদে। নতুন নতুন জমির খোঁজ নিয়ে সেটা অধিকার করাই ছিল আবিষ্কারের যুগের আসল কথা। জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্বায়ন সবকিছুই একই লক্ষ্যে ছুটছে। সেই লক্ষ্যটা হলো বাণিজ্য। আধুনিক সভ্য উচ্চশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে শিল্প- সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান এবং পেশাজীবি কিছু মানুষকে বাদ দিলে বাকী সবাই আসলে বাণিজ্যের দাসত্ব করে। তিনি রাজা-উজির যাই হন না কেন, যত বড় চাকরিই করুক না কেন আখেরে তিনি আসলে বাণিজ্যের দাসত্বই করে যাচ্ছেন। সারা পৃথিবীর সবগুলো যুদ্ধ বিগ্রহ গোলমালের পেছনে কোন না কোনভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কেউ পণ্য বিক্রি করার মতলবে আছে, কেউ মতবাদ বিক্রি করার তালে আছে। অধিকাংশ মানুষ নিজের অজ্ঞাতেই বাণিজ্যের দাসত্ব করে যাচ্ছে। মানুষের বাণিজ্যিক দাসত্বের বয়স অন্তত দশ হাজার বছর। এখনো সেই দাসত্ব সদর্পে বিদ্যমান। 


একুশ শতকে এসে সেই দাসত্বে নতুন সংযোজন হতে যাচ্ছে। মানুষ এবার প্রযুক্তির দাসত্বের সূচনা করেছে। বিশ শতক পর্যন্ত মানুষ প্রযুক্তিকে দাস বানিয়ে একের পর এক উদ্ভাবন করে গেছে। একুশ শতক থেকে মানুষ প্রযুক্তির দাসে পরিণত হতে শুরু করেছে স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে। প্রযুক্তির উপর যেটা এতদিন নির্ভরশীলতা ছিল, এখন সেটা দাসত্বে পরিণত হয়েছে। প্রচুর মানুষ ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে কাজটি করেন মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলানো। ওই স্ক্রিন হাতে না থাকলে মানুষের দম আটকে আসে।  হাটে মাঠে ঘাটে অফিস আদালতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রান্নাঘর বাথরুম সবখানে এই সাড়ে  ইঞ্চির রঙিন পর্দা মানুষকে দখল করে রেখেছে। এখন তার সাথে যুক্ত হবে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। নতুন প্রযুক্তির মহাযুগ। আগামী কয়েক যুগ মানুষ হয়তো এই নতুন প্রভুর দাসত্ব করবে।


বিশ্বব্যাপি সর্বগ্রাসী এই দাসত্ব চক্রের বাইরে অল্প কিছু মানুষ আছে যারা কিছুটা স্বাধীন। যাদের বড় অংশ হলো আদিবাসী। এখনো পৃথিবীর যেখানে আদিবাসী আছে তাদের জীবন আধুনিক মানুষের মতো নিরানন্দ নয়। এমনও জাতি আছে যারা যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু চাষ করে। বাকীটা সময় স্বাধীন আনন্দে কাটায়। দেড়শো বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গলে এক অভিযানে গিয়ে এক বৃটিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন এই পার্বত্যবাসীরা যে কোন উন্নত ইউরোপীয়ানের চেয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করে। কথাটা এই যুগেও সমান সত্য। অথচ সভ্য মানুষেরা এইসব আদিবাসীদের কোণঠাসা করতে করতে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে। নিজের মতো করে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। কোন না কোন রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত অদ্ভুত ভৌগলিক রাজনৈতিক অধিকারবোধে  তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সীমানাভুক্ত করে। 


অথচ কারো দাসত্ব না করে পৃথিবীতে একমাত্র স্বাধীন জীবন কাটাতে পারতো সেই আদিবাসী মানুষেরাই। প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির দাসত্ব করে জীবন কাটাতে পারতো।  প্রকৃতির দাসত্বই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দাসত্ব। যেখানে আধুনিক মানুষ নেই সেখানকার প্রকৃতিই সবচেয়ে সুন্দর। প্রকৃতির স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ সন্তান আধুনিক মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতি ধ্বংস ডেকে আনছে। মানুষ ছাড়া জগতের সব প্রাণী প্রকৃতির দাসত্বই করে।


No comments: