একদম গোড়া থেকে না হলেও নোবেল পুরস্কার নিয়ে মাঝে মাঝে কিছু কৌতুককর ব্যাপার ঘটেছে। যার কিছু কিছু মর্মান্তিক কৌতুক। নোবেল পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনীতি চলে শান্তি পুরস্কার ঘোষণায়। তামাশার ব্যাপার হলো শান্তি পুরস্কারের একটা অংশ পেয়েছেন অশান্তির জনকেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উইনস্টন চার্চিলও শান্তিতে নোবেল পেয়ে যেতেন, নেহাত লোকলজ্জার খাতিরে বাধ্য হয়ে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয়েছিল।
১৯৩৮ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসে ঘোষণা করলেন এই পুরস্কার দেয় ইহুদীরা, সুতরাং জার্মান কোন নাগরিক এই পুরস্কার নিতে পারবে না। সে বছর একজন জার্মান বিজ্ঞানী রিচার্ড কুন নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি পুরস্কারটা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হলেন। পরের সাত বছর অবশ্য জার্মান দূরে থাকুক, গোটা পৃথিবীতে কেউ নোবেল পুরস্কার পায়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায়।
রাশিয়ানদের কাছে নোবেল পুরস্কার ব্যাপারটার সাথে প্রেম আর বিদ্বেষ দুটোই ছিল। ১৯৫৮ সালে যখন বরিস প্যাস্টারনাককে নোবেল দেয়া হলো তখন রাশিয়ান সরকার ক্ষেপে ছিল বলে তিনি ভয়ে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আবার ১৯৬৫ সালে মিখাইল শোলোকভকে যখন দেয়া হলো তখন রাশিয়ানরা উৎসব করেছিল। কিন্তু ১৯৭০ সালে সোলজেনেৎসিন পুরস্কার পাওয়ার পর রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ সেটাকে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিল। তবে পাবলো নেরুদাকে যখন নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো তখন রাশিয়ান সরকারের শীর্ষ কর্তারা তাঁকে অভিনন্দিত করেছিলেন। বলেছিলেন,তিনি আমাদেরই লোক। রাশিয়ানদের এই নোবেল রসিকতা অবশ্য রাজনীতির মেরুকরণের খেলা।
অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার হোর্হে লুই বোর্হেস নিজের কপাল নিজেই পুড়িয়েছিলেন। রসিকতা করতে গিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কার হারিয়েছিলেন। সত্তর দশকের গোড়া থেকেই তিনি প্রতিবছর মনোনয়ন তালিকায় ছিলেন এবং যে বছর তিনি পুরস্কারের জন্য চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত হতে যাচ্ছিলেন সে বছরই তিনি ভুলটা করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর- পুরস্কারের চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের এক মাস আগে বুয়েনাস আয়ার্সের এক সরকারী অনুষ্ঠানে চিলির কুখ্যাত স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোচেটের সাথে দেখা হয়েছিল তাঁর। সেখানে তিনি পিনোচেটের উপস্থিতিতে একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন- “হে মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এটা আমার জন্য বিরাট সৌভাগ্য যে আমি আপনার কাছে আসার সুযোগ পেয়েছি….আর্জেন্টিনা, চিলি এবং উরুগুয়েতে আজ স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে….. কমিউনিজমের মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে পতিত হওয়া একটা মহাদেশে এটা সম্ভব হয়েছে আপনার জন্য….”
এরকম আরো অনেক স্তুতির মধ্যে পিনোচেট ভেসে গিয়েছিলেন। বোর্হেসকে তিনি মেডেল দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতে এই স্তুতি মূলত বোর্হেসের একটা রসিকতা ছিল মাত্র। কিন্তু সুইডিশ একাডেমির সদস্যরা সেই রসিকতা ধরতে পারেননি। সেই ঘটনার পর থেকে বোর্হেসের নামটা পুরস্কারের সম্ভাব্য তালিকা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল। সে বছর বোর্হেসের বদলে তড়িঘড়ি করে মার্কিন সাহিত্যিক সল বেলোকে নোবেল পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বোর্হেস অবশ্য একবার দুঃখ করে বলেছিলেন প্রতি বছর এই পুরস্কারের জন্য তিন মাস ধরে টেনশানে থাকা আর ভালো লাগে না। তিনি কৌতুক করতে গিয়ে পুরস্কারের সুযোগ হারিয়ে টেনশান মুক্ত হয়েছিলেন সেটাই লাভ।
কিন্তু আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কারের প্রতিক্রিয়ায় ১৮ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখে তার বন্ধু রোদেনস্টাইনকে যা বলেছিলেন সেটা মনে হয় সবচেয়ে সেরা:
“আমাকে যে নোবেল পুরস্কারের মতো একটা বিশাল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে, এই সংবাদ পাওয়ামাত্র আপনার আপনার কথা মনে পড়ল- ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা সহ। আমি নিশ্চিত যে আমার বন্ধুদের মধ্যে আপনিই এই সংবাদে সবার চেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন। তবে তা হলেও এটা আমার পক্ষে শাস্তিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালো। এর ফলে জনতার উত্তেজনা এমন ঘূর্ণবার্ত্যার মতো আবিল হয়ে উঠছে যে সেটা আমার পক্ষে অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কুকুরের লেজে একটা টিনের কৌটো বেঁধে দিলে সে যেমন শব্দ ছাড়া নড়তে পারে না। যেখানে যায় শব্দটা তাকে তাড়া করে বেড়ায়, আর চারধারে দর্শকদের ভিড় জোটায়, আমার অবস্থাটা তার চেয়ে খুব একটা ভালো নয়। গত কদিন ধরে চিঠি আর টেলিগ্রামের ভিড়ে আমি দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে বসেছি। যারা সারা জীবনে আমার একটা লাইনও পড়েনি তারাই হৈ চৈ আরম্ভ করেছে বেশি। আসলে তারা সম্মান জানাচ্ছে আমার সম্মানটাকে, আমাকে নয়। একমাত্র যা আমাকে তৃপ্তি দিচ্ছে তা হল, এই উপলক্ষে আমার স্কুলের ছেলেদের অবিমিশ্রিত আনন্দ।”
রবীন্দ্রনাথের রসবোধ তাঁর সাহিত্যবোধের চেয়ে মোটেও কম কিছু না।
সূত্র:
-Imperfect Encounter: Letters of William Rothenstein and Rabindranath Tagore, Harvard University Press,1972
-The Specter of the Nobel Prize- El País, Madrid, October 8, 1980
-The Nobel Prize: A History of Genius, Controversy and Prestige- Burton Feldman Arcade; 1st edition (October 9, 2012)
No comments:
Post a Comment