আমি যেদিন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম আবিষ্কার করি, তারপর থেকে তাঁর গল্পগুলো আমার মাথার ভেতরে এমনভাবে গেঁথে যায় যে কোন গল্পটিকে আমি সেরা গল্পের মর্যাদা দেবো তা ভেবে নির্নয় করা মুশকিল হয়ে পড়ে। শ্যামল যে বিপুল পরিমান লিখেছেন তাঁর অল্প কিছু অংশ পড়েই এই মুগ্ধতার জন্ম। তাঁর লেখা আত্মকথন 'জীবন রহস্য' আমার কাছে অসাধারণ এক রচনা। শ্যামলকে নিয়ে আমি দুয়েকবার আলোচনা করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি। তখনই আমার চোখে পড়ে গেল স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা এই আলোচনাটি। শ্যামলকে নিয়ে লেখা সমস্ত আলোচনার মধ্যে এইটাকেই সেরা বলে রায় দিলাম। তাই নিজের সংগ্রহে রেখে দিলাম। লেখাটি পাওয়া হয়েছে গল্পপাঠের সৌজন্যে।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কয়েকটি গল্পের ভূমিকা
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আসার পর যদি সাজেশনে থাকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে সমাজ-সচেতনতা তবে অভিজ্ঞ অধ্যাপক দ্বারা প্রণীত নোট বইয়ের লেখকরা বড়ই অসুবিধায় পড়বেন । কারণ বিরিয়ানি থেকে কাজুবাদাম বা পায়েস থেকে আলাদা আলাদা করে কিশমিশ বের করে নেয়ার মতো আলাদা আলাদা করে সমাজ-সচেতনতা বার করে নেয়া যাবে না শ্যামলের গল্প থেকে । ওর গল্পে ইতিহাস, সমাজ, দর্শন, বিজ্ঞান এই সবকিছু অদ্ভুত মিশে থাকে ।
আর ঐ অপূর্ব মিশ্রণ বাক্যগুলির ভিতরে ঝিলমিল ঝিলমিল রহস্য দেয়। আমার বাল্যে দেখেছি উত্তর কলকাতায় অনেকেই কালীপুজোয় তুবড়ি তৈরি করতেন ঘরে । তুবড়ি বিশারদদের কাছে অনেকে ভাগ জানতে আসতো। অনেক সাধাসাধির পর কোনো তুবড়ি বিশারদ কৃপাপরবশ হয়ে কড়িকাঠের দিকে তেরাচা চোখ রেখে বলতেন--তিন দুই এক এক | এখান থেকেই বুঝে নিতে হতো কতটা সোরা, কতটা গন্ধক, কতটা কাঠকয়লা বা লোহাচূর | প্রকৃত সাহিত্যে ও রকম তিন দুই এক এক চলে না ।
শ্যামলের গল্পে তো নয়ই ; শ্যামলের গল্পের কোনো ফর্মুলা নেই, আবার বর্গীকরণ করাও মুস্কিল। যেমন রহস্য গল্প, হাসির গল্প, প্রেমের গল্প, অভিযানের গল্প ইত্যাদি । কারণ শ্যামলের প্রতিটি গল্পই রহস্য গল্প। মানুষের জীবনের অপা রহস্য। রহস্য সন্ধানের অভিযান, জীবনের কতো সুখ বয়ামে বয়ামে ভরা, বয়ামের অনুসন্ধানেই তো অভিযান। আর ঐ সুখ তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করা, সেটাই তো প্রেম। শ্যামলের গল্পগুলিতে এইসবই মিলেমিশে থাকে । আলাদা করা মুস্কিল।
তুবড়ি বিশারদের কথা মনে পড়ল আবার। কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করল, হাইটটা বাড়াতে চাই, বিশারদ বলল ৪-২ করে দাও । মানে সোরা বাড়িয়ে দিতে হবে । তুবড়ির শব্দ বাড়ানোর জন্য বা তুবড়ির আলোর রং-এ বৈচিত্র্য আনার জন্যও ফর্মুলা আছে। শ্যামলের গল্প সম্পর্কে এটাও বলার, তিনি ছল করে জল আনার মতো জোর করে কোথাও প্রকৃতি বর্ণনা, ডিটেইল আলপনা বা বিপ্লব বন্দনা করেননি।
তার গয়ে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান থাকে। ছোট ছোট ক্যাপসুলে। 'আজকাল ভদ্রলোক বেড়ে যাওয়ায় ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাসেই ভিড় কম ( নেই), বা এ জায়গাটা যখন কলোনি ছিল তখন বিজয় ডাক্তার নেহাৎ বালক ছিল। এখন পিসরাস্তা, মাদার ডেয়ারির ডিপো, ফ্যান, ফোন সবই হয়েছে, এমন-কি লোকাল কাপড়ের দোকানে নাইটি ঝোলে ! ( জ্ঞান অজ্ঞান )
প্রথম পদ্ধতিটির একটি বাক্যে বা দ্বিতীয় উদ্ধৃতির শেষ বাক্যে, অর্থনীতি মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক ইতিহাস মিশে রয়েছে ।
শ্যামলের গল্পে জীবনের গভীর গভীর রহস্যের কথা আছে, যাকে দর্শন বলা যায় । কিন্তু সেই বিশেষ গলা খাকারিটা নেই | বক্তৃতার আগে যেরকম থাকে।
"মিছিল চলে যেতেই সেই চিলটা গঙ্গার আকাশ থেকে উড়ে এসে এল. আই. জি. ফ্ল্যাট বাড়ির কার্নিশে বসল । রোজ এই সময়টায় ও আসে। সঙ্গে কোনো মরা ইঁদুর বা ছুঁচো থাকে ওর নখে ! লোকাল কাকদের যেন কী শেখায় ও রোজ । ইঁদুর ছিঁড়ে খাওয়া ? কে জানে ? ( চোরাস্রোত )
"সে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রগুপ্তের নৌবাহিনীর দাঁড়িদের সমস্বর শুনতে কান পেতে রাখে । ভিনটেজ কার র্যালি দেখতে দেখতে জগতের তাবৎ বাতিল মোটর গাড়ির ইঞ্জিনে জমাট হর্সপাওয়ার থেকে কোটি কোটি অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনতে পায়'--(আত্মজা ও একটি অস্টিন ১৯২৯)
বেতারে যখন নাটক হয়, তখন মিউজিক শুনেই আগাম বুঝতে পারি এটা দুঃখের না মজার নাকি রহস্য নাটক। অনেক গদ্যেরও এরকম প্রিলিউড থাকে। শ্যামলের নেই। শ্যামল গভীর গভীর কথা বলেন অনায়াস ভঙ্গিতে। যেন চার ফুট দুরত্বে রয়েছেন। ফলে জোরে বলতে হচ্ছে না।
শ্যামল ষাট পেরিয়েছেন দু-বছর আগে । এই সংকলনের যে গল্পগুলি, তাদের মুখ্য চরিত্রগুলি অধিকাংশই ষাটের এধারে ওধারে ।
ঐ চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে শ্যামল তার এই নিজেকে পুড়িয়ে, নিংড়ে, অপমানিত হয়ে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, নিজের শিল্পের সত্য আবিষ্কার অভিযানের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির কথা বলেছেন । আগের গল্পগুলিতে গোরু, ধান, জমি, কৃষি, এইসব পেয়েছি । এই সংকলনের গল্পে পাচ্ছি — মানুষের আকাঙ্ক্ষা, বিপর্যস্ততা, জীবনের অনিশ্চয়তা, ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের সাযুজ্য, রাগসংগীত এবং গাড়ি । গাড়ি নিয়ে দুটি গল্প আছে। ঘোড়ার মনমেজাজ এবং আত্মজা ও একটি অস্ট্রিন ১৯২৯। অনেকেই শ্যামল জানেন, একসময় নিবিড় জড়িয়েছিলেন চাষবাসে । ওখানে দেখেছেন জমি। জমির সঙ্গে জড়িত দখল, তার সঙ্গে জড়িত আশ্রয় । তার সঙ্গে জড়িত অঙ্কুর আর নবজন্ম। তার সঙ্গে জড়ানো লোভ । শ্যামল দেখেছিলেন এইসঙ্গে চাষী ও বলদ ডোবার জলে মুখের ছায়া দেখে । তারও আগে শ্যামল দেখেছেন শক্ত লোহার নরম হয়ে গলে যাওয়া, ব্লাস্ট ফার্নেসে । শ্যামল ইটখোলা করেছেন। গাড়ির ব্যবসা করেছেন, বাড়ি পাল্টেছেন চল্লিশ বার, চাকরি বার-দশেক । শ্যামল দেখেছেন যুদ্ধ-মন্বন্তর-দ্বীপান্তর-কুইট ইণ্ডিয়া, বেআইনী কমুনিস্ট পার্টি, নকশাল আন্দোলন, বাবু কমুনিস্ট ! শ্যামলের গল্প তাই অনায়াসে শুরু হতে পারে— 'তখন গুণ্ডাদের মন্ত্রী হবার রেওয়াজ ছিল না" ।
শ্যামলের রচনায় ঐসব রাজনৈতিক ঘটনার তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যাবে না তেমন । কারণ তিনি ঐসব ঘটনা-পীড়িত মানুষের প্রবহমানতার কথাই বলতে চান । তার মধ্যে খুব সন্তর্পণে জায়গা করে নেয় ইতিহাস ।
'হাতঘড়িতে নটা বাইশ। বাতাসে নলেন গুড়ের গন্ধ। মোড়ে ফুলকপির সিঙ্গাড়া লেখা লাল সালু । আদর্শ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে শীতের হাওয়ায় এখন রীতিমতো হাতছানি । ডান বগলের ক্রাচ্টা আলগা দিয়ে পরিতোষ ডান হাতেই জানলার শিকটা শক্ত করে ধরল। কাগজে দেখেছে কাল ঠিক এই সময়টায় কলম্বিয়ার আগ্নেয়গিরি কাদা বমি করে আশপাশের বিশ হাজার মানুষ মেরে ফেলেছিল । মনে আছে ইরা -- কালও আমি এই সময়ে এখানে এইভাবেই দাঁড়িয়েছিলাম – তখন তো জানি না বারো হাজার মাইল দূরে একটা আগ্নেয়গিরি হাজার হাজার মানুষের জীবন নিয়ে হরিরলুট খেলছে--কাদার সঙ্গে পাথর — আগুনের দলা জুড়ে গ্রামকে গ্রাম ঢেকে ফেলছে।" ( নখ্দর্পণ ) কিম্বা'
-- "এ কোনো নখদর্পণ নয় ইরা । যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই পড়ে দেখলাম আমি আর টোটো যখন ল্যাংটো হয়ে দৌঁড়চ্ছি ফাঁকা মাঠে- হাতে হাফ প্যাণ্ট – ঠিক তখন বার্লিন থেকে একটা গুডসি ট্রেন চেকোশ্লোভাকিয়ার পোজনিন-এ এসে থামল । ছাই রং-এর আকাশ, বৃষ্টি হচ্ছে । মালগাড়ি থেকে ইহুদিদের নামিয়ে গোরুভেড়ার মতো মার্চ করিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্যাস চেম্বারে । অথচ আমি আর টোটো নিষ্পাপ আনন্দে ফাঁকা মাঠে দৌঁড়চ্ছি। কী ভয়ঙ্কর ৷" (নখদর্পণ ) কিম্বা --
'কানন দেবীর বাড়ির জায়গাটা তখন ধানক্ষেত। বেহালার ট্রাম ডিপো পেরোলে পল্লীগ্রাম । উঠতি হিরোইন ভারতীদেবী । আমি গল্ফ ক্লাবের মাঠের কিনারে বল কুড়িয়ে সারাদিনে একটা টাকা পাই। অশুতোষে পড়ি। প্যারাডাইস রেস্তোরাঁয় দুটি লম্বা যুবক ভীড়ে চা খায় আর সিনেমার কথা বলে। অনেক পরে দেখলাম তারা ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেন । নেহরু আর গোলাপ দুজনই তখন টাটকা। তবে তিনি তখন ধুতি-পরা ছেড়ে দিয়েছেন । ব্রিগেডের মিটিং-এ জনতা উত্তাল হয়ে উঠলে হাতের ব্যাটন উঁচিয়ে মাইকে বলেন বইঠ্ । বইঠ্ । আর অমনি সবাই বসে পড়ে । ( ঘোড়ার মনমেজাজ )
কিম্বা। — "এক ঘটনা আর এক ঘটনার খবর না জানলেও সাবার সঙ্গে সবার যোগ আছে এটা বুঝতে পেরেই পরিতোষের সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা সাগরের ভেঙে পড়া সব ঢেউ একই সুতোয় গাঁথা! কী ভয়ঙ্কর ৷ কী আশ্চর্য । তা হলে কি নাদির শাহের মন খারাপের কোনো বিকেল আমার হো হো হাসির এক গোধূলির সঙ্গে গাঁথা ! এইসব জোড় এইসব ঝালাই বাতাসের ছাল তুললেই ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়বে ।"( চোরাস্রোত )
শ্যামল ঘোড়ার মনমেজাজ গল্পে বলেছেন — 'পৃথিবীর সব কথা কাহিনীই খুব গোপনে মহাভারতের সঙ্গে যুক্ত।" নিজেদের রেললাইন গল্পের দ্বারকাপ্রসাদের ইঞ্জিনের মালিক হবার ঈপ্সার মধ্যে মানুষের আদি আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতাই থাকে। এই সংকলনের চোরাস্রোত, নখ্দর্পণ, অপমানের স্বাদ এই ধারাবাহিকতারই গল্প। শ্যামল বলেছিলেন -- আকাশের নিচে নির্জনে কত মাঠ পড়ে থাকে । প্রান্তরে সাতটা তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। এরাই প্রান্তরের রক্ষক। পুকুর কাটতে গিয়ে বারো হাত নিচে নৌকোর গলুই পাওয়া গেল ! তাহলে একদা এখানে নদী ছিল ?
এই যে রহস্য, যা মাটি খুঁড়ে পাওয়া যেতে পারে, জলের অতলে, বা ঝিনুকের ভিতরে বা বন্দী ভ্রমরে, জীবনের গভীরেও ।
শ্যামল বলেছেন — "কোন রহস্য থেকে মানুষ সৃষ্টি করে তা আজও রহস্যময় । সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে কোনো অঙ্কে মেলানো যায় না | মিহিরও কোনো অঙ্কে পড়ে না । সে নিজেই নিজের লেখার উৎস আর মিশেল নিয়ে মাথা খাটিয়ে টের পেয়েছে যা ঘটে – তা লিখলে লেখা হয় না । বরং যা ঘটতেও পারে এমনটা কোনো দৈবী পাগলামিতে জারিয়ে নিয়ে কাগজের উপর শব্দ বসালে তবে লেখা হয়৷'' ( আত্মজা ও একটি অস্ট্রিন ১৯২৯ )
এই সংকলনে বিভিন্ন মেজাজের যে গল্পগুলি আছে, তার মধ্যেকার সাধারণ ব্যাপারগুলি হচ্ছে উৎখনন । খোঁড়াখুঁড়ি বা দৈবী পাগলামি । নিজেকে, নিজের ধারাবাহিকতাকে খোঁজা। দশ আঙুলের আকাঙ্ক্ষা আর অ্যাকুতিতে যেমন বালির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে জল ।
নিজেদের রেললাইন গল্পের দ্বারকাপ্রসাদ সরকারি নীলাম থেকে একটা পুরনো ইঞ্জিন কিনে ফেলে। দ্বারকার স্ত্রী অগস্তি প্রাচীন শরীরের বা্তব্যাধি আর জীর্ণতা নিয়ে ঐ ইঞ্জিনে ওঠে। নিজস্ব ইঞ্জিন | দখলের স্বাদু ! মালিকানা। এরপর প্রাচীন ইঞ্জিনটাকে ঠেলে নিয়ে যায় একটি নবীন ইঞ্জিন -- প্ল্যাটফর্ম থেকে দুরে । তারপর অগস্তি ঐ ইঞ্জিন থেকে নামতে পারে না। প্ল্যাটফর্ম নেই। বাঁপায়ের পাতা আন্দাজে নিচের পাদানি খুঁজছে। হাত হ্যাণ্ডেলে । সামান্য ব্যাপার । বন্দী অগস্তির অসহায়তায় পাঠক নিজেকেও দেখতে পান ।
বাংলাদেশের মাড়োয়াড়িদের একটা অন্যরকমের ডায়ালেক্ট হয় । গল্পটিতে সেটিও খুব ভালোভাবে এসেছে।
উঁইপোকা গল্পের মৃণালিনী ভট্টশালী বাংলাদেশে গিয়েছেন । নিজের শিকড়টা একবার দেখতে চান | কিন্তু শিকড় বলে আলাদা করে কি কিছু আছে ? কচুরিপানারও শিকড় রয়েছে। ভেসে বেড়ায় | জীবনেও ভেসে যাওয়া । সইফুলের হারানো প্রেম জীবনে এসে লাগে | ঘোড়ার মনমেজাজ আসলে ঘোড়ার গল্প নয় । গাড়ির । গাড়ি মানে হর্সপাওয়ার | মানে গতি । সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষা | আকাঙ্ক্ষার কি সীমা আছে। এরই মধ্যে আশ্চর্য কয়েকটি লাইন--| 'পার্টিশন আমাদের হাতে একটি মোয়া দিল । তার নাম কলকাতা । অভাব আর ময়লা দিয়ে পাকালে সেই মোয়া"—
কিম্বা— 'আরাবল্লীর গুহা-গলতায় গিয়ে দেখলাম ছাইমাখা ল্যাংটা সাধু প্রচণ্ড শীতে উপনিষদ পড়ছে। সামনে গোল্ডফ্লেকের টিন | পূর্বাশ্রমের অভ্যেস । মাঝে মাঝে বই বন্ধ করে হিমেল, নীল আকাশে তাকাচ্ছে | যেদিকটায় ভগবানের ঠিকানা ।"
এই ধরনের বাক্য পড়ে আমাদের একটা স্মিত হাসি হয় । কৌতুক বোধ করি। এই কৌতুক অসংগতির নয়। আসলে আমাদের পঠন সংস্কারে এই ধরনের বাক্যবন্ধ একটু পূর্বাভাসহীন । হঠাৎ আসে। আগের প্রস্তুতি ও সংলাপের সঙ্গে সঙ্গতিহীন । মুজতবা আলী কখনো বিষয়ান্তরে চলে যান। তখন পাণ্ডিত্যের দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। তখন মুগ্ধতা আসে। ঐ মুগ্ধতা এক ধরনের আনন্দ বা কৌতুক দেয়। কিন্তু শ্যামলের কৌতুকের উৎস অভাবনীয়তা ! হঠাৎ কিছু পেয়ে গেলে একটা বিস্ময়বোধ আসে। ওটাকে অসঙ্গতি ভেবে আপাতঃভ্রম করে পাঠক। তখন ঐ আনপ্রেডিক্টেবিলিটি বা অভাবনীয়তা এক ধরনের কৌতুক সৃষ্টি করে ।
শ্যামল ঈশ্বরীতলার রূপেকথার ভূমিকায় লিখেছিলেন – "মানুষকে ভালো ভাবে দেখতে জানলে কঠিন দুঃখেও হাসি পায় | চিরন্তনতার মাপকাঠিতে শেষপর্যন্ত প্রকৃতি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় । তখন সবকিছু সম্পর্কেই একটা হাসির দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়ে যায়। সে হাসির ভিতরে দুঃখের কথা ছিটানো থাকে। আলো পড়লে তা ঝিকমিক করে ওঠে। তাই আমার অনেক গুরুগম্ভীর লেখাতেও হাসি এসে গেছে।'
বলেছিলাম ঘোড়ার মনমেজাজ গল্পটি গাড়ি, শক্তি কিম্বা আকাঙ্ক্ষার । আসলে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির গল্প। কানু নামের একটি আশ্চর্য চরিত্রের বৃহুমুখীনতার গল্প ।
চোরাস্রোতে মানুষের ধারাবাহিকতার দর্শন রয়েছে । মর্কট পুরাণ একটি অশ্চর্য গল্প । মার্কেস্, বোরহেস, বা মিলান কুন্দেরা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা না পড়েও যদি লিখতে পারেন,শ্যামলও ওদের না আঁকড়েও অন্য ফর্মে লিখতে পারেন, অসুবিধে হয় না |
দুগাগাপুর হল্ট একটি অসাধারণ গল্প। মানুষের জীবনের ভয়ংকর অনিশ্চয়তার কাহিনী । মানুষ কি জানে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কোথায় ? রহস্যে পরিপূর্ণ মানুষ সত্যিই আনপ্রেডিক্টেবল্। অথচ মানুষ মানুষই। বহু লক্ষ বছর ধরে সংঘ জীবন করা মানুষ কয়েকশো বছর হলো আলাদা আলাদা হয়েছে। তবু সংঘ-জীবনের চিহ্ন রয়ে গেছে মানুষের মধ্যে | মানুষের বিপদে মানুষই বাঁচায়। সুবিমল আশাতীতভাবে টাকা ধার পেল। যাবার কথা নয়, তবু বারবণিতার ঘরে যায়। ওঠার কথা নয়- -উঠে আসে। শেষ ট্রেন পাবার কথা নয়, একটি গার্ড ওকে উঠিয়ে নেয়, এবং সুবিমল যখন ট্রেনের বাইরে মাথা নিয়ে বমি করতে থাকে, তখন সুবিমল টের পেল 'তার মাথা এইমাত্র একটা খটখটে থাম্বা একচুলের জন্য মিস করল । গার্ডের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবু কেমন দুহাতে তার কোমর জড়িয়ে ডিউটি দিচ্ছে ।"
মানুষের এই মাহাত্ম্য কথার বিবরণ আছে আত্মজা ও একটি অস্ট্রিন ১৯২৯ গল্পে । মিহির ঘোষালের গাড়িটি আটকে পড়েছিল, রাস্তায় যে-সমস্ত মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে আলোছায়ায়, তারা গাড়িটিকে ঠেলে দিয়েছিল । ব্যাপারটা চোঙা ফুঁকে বলার মতো কিছু নয়। তবু উন্মোচনের গুণে অসাধারণ গল্প হয়েছে এটি । মানুষের অন্তর্গত মণিমুক্তো পাই জ্ঞান অজ্ঞান গল্পটিতেও ।
'ভালবাসলে মেঘ হয়" গল্পে এসেছেন একজন সংগীতশিল্পী অশীন রায় | যার ঘরের দেয়ালে প্রধানমন্ত্রির সঙ্গে দাঁড়ানো ছবি রয়েছে, ওয়াশিংটনের নির্জন রাস্তায় হঠাৎ কোকিলের ডাক শুনতে পেয়ে মনে হয় কোকিলের কোন এল. পি, নেই, রয়ালটি নেই। তার সন্দেহ তার মৃত্যুর পর তার রেকর্ড কেউ কিনবে কিনা। নিজেকে নিয়ে নিজের ঘিরে থাকাই তাকে একাকী করে দেয় । শেষকালে দেখি এক রহস্য-মানুষ এসেছেন । যে আরো দুঃখী মানুষদের তালিকা তৈরি করছেন । অশীন আর ততটা একাকী থাকে না । যৌবন-নিকুঞ্জে গল্পটির নামটা পড়েই গানের কলিটি মনে পড়বে। যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি । যৌবন নিকুঞ্জ মানে আমাদের জীবন | জীবন রহস্য । একটি নারায়ণ শিলাকে নিয়ে গল্প। গল্পটি অগোছালো এবং টানহীন ।
বে-আব্রু আরেকটি অতি ভালো গল্প। মানুষের আনপ্রেডিক্টেবিলিটির । শ্যামলদা প্রয়াত রাধানাথ মণ্ডলের শোকসভায় বলেছিলেন --রাধানাথ একটুর জন্য মরে গেল। দ্রুত ধাবমান গাড়িটিকে মুহূর্তের জন্য অন্য গাড়ি ছুঁয়ে দিল বলে । আমরাও একটুর জন্য বেঁচে আছি । গল্পের শুরুতে গোলকধাম নামে একটি অধুনা অপ্রচলিত খেলার কথা বলা আছে। যেখানে সাপ-লুডোর মতো ঘর, শৌণ্ডিকালয়ের পাশেই অমৃতলোক, তার পাশেই রসাতল । একটা ঘর এদিক-ওদিক হলেই অমৃতলোকের পরিবর্তে রসাতলে চলে যেতে হয় । শেষকালে বলা আছে – পতনের ঘর এমন পষ্টাপষ্টি থাকার দরুনই গেরস্ত বাঙালিরা অমন পপুলার খেলাটা বাতিল করে দিয়েছে।
'শিয়ালদা কেমন আছে' ও 'বেঁচে থাকার বিশেষ উপায়' গল্পে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদের কথা বলা আছে। 'শীর্ষ সম্মেলনে' আছে কয়েকজন প্রাচীন মানুষের বেঁচে থাকার কথা। 'পারিজাতের ইতিহাস ও ভূগোল' একটি হাল্কা চালে লেখা প্রেম-প্রেম গল্প। সাজানো গোছানো পারিজাত ফ্লাট বাড়ির আভিজাত্য প্রসঙ্গে একটি লাইন : "পুজোর প্রসাদে অনেক খেজুর দেয়" আর গ্রীষ্ম বর্ণনা : 'রোদ চড়চড় করে বাড়ছে । পাড়ায় পাড়ায় মাসভোর রবীন্দ্রজয়ন্তী । পঁচিশে বৈশাখ পেরিয়েও । তারই মহলা চারদিকে । দিকে দিকে নটীর পূজা। সন্ন্যাসী উপগুপ্ত। আর গেরস্থদের বাজারের থলেতে একচেটিয়া নিমপাতা কাঁচা আম সজনে ডাঁটা । তার ভিতর বিয়ের বয়স পেরানো মেয়েরা | বিকেলে গা ধুয়ে চুল বেঁধে, টিপ পরে,--"
'ঝিঝোঁটি দাদরা'য় পাই হারানো সংগীতের জন্য ব্যাকুলতা, মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে গল্পটির মধ্যে পাই মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছার রহস্যময়তা, সেই যুধিষ্ঠির যা ভেবেছিলেন এবং অবাক হয়েছিলেন।
এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলির মধ্যে মধ্যবিত্ত চরিত্ররাই বেশি । এবং তারা সবাই ষাটের এদিক ওদিক । সুতরাং এ সময়ের শ্যামলদাকেই পাব আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে । যিনি বলেন চুরুট পুড়ে গেলে আগুনের মাথায় দেড় ইঞ্চি ছাই থাকে। সেই ছাই কি লেখার অনুপান হতে পারে না ? যিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবীর কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যিনি বলেন সাহিত্যে রথী এবং মহারথী বিজ্ঞাপনের ভাষা মাত্র।
অথচ তার দিকেই শিক্ষার্থীর মতো আমাদের প্রজন্মের লেখকরা চেয়ে থাকি আধুনিকতা কী জিনিস জানবার জন্য।
আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি শ্যামলদা সহজে পুরোনো হবেন না। আর শেষ কথাটি হলো ওর কাছে একটি আয়না আছে, পিছনে ধরার, সেলুনে যেরকম, যাতে না-দেখাগুলি দেখা যায় । ওটা আমার চাই ।