Monday, April 30, 2018

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর আলোচনা

আমি যেদিন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম আবিষ্কার করি, তারপর থেকে তাঁর গল্পগুলো আমার মাথার ভেতরে এমনভাবে গেঁথে যায় যে কোন গল্পটিকে আমি সেরা গল্পের মর্যাদা দেবো তা ভেবে নির্নয় করা মুশকিল হয়ে পড়ে। শ্যামল যে বিপুল পরিমান লিখেছেন তাঁর অল্প কিছু অংশ পড়েই এই মুগ্ধতার জন্ম। তাঁর লেখা আত্মকথন 'জীবন রহস্য' আমার কাছে অসাধারণ এক রচনা। শ্যামলকে নিয়ে আমি দুয়েকবার আলোচনা করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি। তখনই আমার চোখে পড়ে গেল স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা এই আলোচনাটি। শ্যামলকে নিয়ে লেখা সমস্ত আলোচনার মধ্যে এইটাকেই সেরা বলে রায় দিলাম। তাই নিজের সংগ্রহে রেখে দিলাম। লেখাটি পাওয়া হয়েছে গল্পপাঠের সৌজন্যে।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কয়েকটি গল্পের ভূমিকা

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আসার পর যদি সাজেশনে থাকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে সমাজ-সচেতনতা তবে অভিজ্ঞ অধ্যাপক দ্বারা প্রণীত নোট বইয়ের লেখকরা বড়ই অসুবিধায় পড়বেন । কারণ বিরিয়ানি থেকে কাজুবাদাম বা পায়েস থেকে আলাদা আলাদা করে কিশমিশ বের করে নেয়ার মতো আলাদা আলাদা করে সমাজ-সচেতনতা বার করে নেয়া যাবে না শ্যামলের গল্প থেকে । ওর গল্পে ইতিহাস, সমাজ, দর্শন, বিজ্ঞান এই সবকিছু অদ্ভুত মিশে থাকে ।
আর ঐ অপূর্ব মিশ্রণ বাক্যগুলির ভিতরে ঝিলমিল ঝিলমিল রহস্য দেয়। আমার বাল্যে দেখেছি উত্তর কলকাতায় অনেকেই কালীপুজোয় তুবড়ি তৈরি করতেন ঘরে । তুবড়ি বিশারদদের কাছে অনেকে ভাগ জানতে আসতো। অনেক সাধাসাধির পর কোনো তুবড়ি বিশারদ কৃপাপরবশ হয়ে কড়িকাঠের দিকে তেরাচা চোখ রেখে বলতেন--তিন দুই এক এক | এখান থেকেই বুঝে নিতে হতো কতটা সোরা, কতটা গন্ধক, কতটা কাঠকয়লা বা লোহাচূর | প্রকৃত সাহিত্যে ও রকম তিন দুই এক এক চলে না ।

শ্যামলের গল্পে তো নয়ই ; শ্যামলের গল্পের কোনো ফর্মুলা নেই, আবার বর্গীকরণ করাও মুস্কিল। যেমন রহস্য গল্প, হাসির গল্প, প্রেমের গল্প, অভিযানের গল্প ইত্যাদি । কারণ শ্যামলের প্রতিটি গল্পই রহস্য গল্প। মানুষের জীবনের অপা রহস্য। রহস্য সন্ধানের অভিযান, জীবনের কতো সুখ বয়ামে বয়ামে ভরা, বয়ামের অনুসন্ধানেই তো অভিযান। আর ঐ সুখ তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করা, সেটাই তো প্রেম। শ্যামলের গল্পগুলিতে এইসবই মিলেমিশে থাকে । আলাদা করা মুস্কিল।

তুবড়ি বিশারদের কথা মনে পড়ল আবার। কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করল, হাইটটা বাড়াতে চাই, বিশারদ বলল ৪-২ করে দাও । মানে সোরা বাড়িয়ে দিতে হবে । তুবড়ির শব্দ বাড়ানোর জন্য বা তুবড়ির আলোর রং-এ বৈচিত্র্য আনার জন্যও ফর্মুলা আছে। শ্যামলের গল্প সম্পর্কে এটাও বলার, তিনি ছল করে জল আনার মতো জোর করে কোথাও প্রকৃতি বর্ণনা, ডিটেইল আলপনা বা বিপ্লব বন্দনা করেননি।

তার গয়ে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান থাকে। ছোট ছোট ক্যাপসুলে। 'আজকাল ভদ্রলোক বেড়ে যাওয়ায় ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাসেই ভিড় কম ( নেই), বা এ জায়গাটা যখন কলোনি ছিল তখন বিজয় ডাক্তার নেহাৎ বালক ছিল। এখন পিসরাস্তা, মাদার ডেয়ারির ডিপো, ফ্যান, ফোন সবই হয়েছে, এমন-কি লোকাল কাপড়ের দোকানে নাইটি ঝোলে ! ( জ্ঞান অজ্ঞান ) 

প্রথম পদ্ধতিটির একটি বাক্যে বা দ্বিতীয় উদ্ধৃতির শেষ বাক্যে, অর্থনীতি মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক ইতিহাস মিশে রয়েছে । 

শ্যামলের গল্পে জীবনের গভীর গভীর রহস্যের কথা আছে, যাকে দর্শন বলা যায় । কিন্তু সেই বিশেষ গলা খাকারিটা নেই | বক্তৃতার আগে যেরকম থাকে। 

"মিছিল চলে যেতেই সেই চিলটা গঙ্গার আকাশ থেকে উড়ে এসে এল. আই. জি. ফ্ল্যাট বাড়ির কার্নিশে বসল । রোজ এই সময়টায় ও আসে। সঙ্গে কোনো মরা ইঁদুর বা ছুঁচো থাকে ওর নখে ! লোকাল কাকদের যেন কী শেখায় ও রোজ । ইঁদুর ছিঁড়ে খাওয়া ? কে জানে ? ( চোরাস্রোত ) 

"সে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রগুপ্তের নৌবাহিনীর দাঁড়িদের সমস্বর শুনতে কান পেতে রাখে । ভিনটেজ কার র‍্যালি দেখতে দেখতে জগতের তাবৎ বাতিল মোটর গাড়ির ইঞ্জিনে জমাট হর্সপাওয়ার থেকে কোটি কোটি অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনতে পায়'--(আত্মজা ও একটি অস্টিন ১৯২৯)

বেতারে যখন নাটক হয়, তখন মিউজিক শুনেই আগাম বুঝতে পারি এটা দুঃখের না মজার নাকি রহস্য নাটক। অনেক গদ্যেরও এরকম প্রিলিউড থাকে। শ্যামলের নেই। শ্যামল গভীর গভীর কথা বলেন অনায়াস ভঙ্গিতে। যেন চার ফুট দুরত্বে রয়েছেন। ফলে জোরে বলতে হচ্ছে না। 

শ্যামল ষাট পেরিয়েছেন দু-বছর আগে । এই সংকলনের যে গল্পগুলি, তাদের মুখ্য চরিত্রগুলি অধিকাংশই ষাটের এধারে ওধারে । 

ঐ চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে শ্যামল তার এই নিজেকে পুড়িয়ে, নিংড়ে, অপমানিত হয়ে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, নিজের শিল্পের সত্য আবিষ্কার অভিযানের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির কথা বলেছেন । আগের গল্পগুলিতে গোরু, ধান, জমি, কৃষি, এইসব পেয়েছি । এই সংকলনের গল্পে পাচ্ছি — মানুষের আকাঙ্ক্ষা, বিপর্যস্ততা, জীবনের অনিশ্চয়তা, ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের সাযুজ্য, রাগসংগীত এবং গাড়ি । গাড়ি নিয়ে দুটি গল্প আছে। ঘোড়ার মনমেজাজ এবং আত্মজা ও একটি অস্ট্রিন ১৯২৯। অনেকেই শ্যামল জানেন, একসময় নিবিড় জড়িয়েছিলেন চাষবাসে । ওখানে দেখেছেন জমি। জমির সঙ্গে জড়িত দখল, তার সঙ্গে জড়িত আশ্রয় । তার সঙ্গে জড়িত অঙ্কুর আর নবজন্ম। তার সঙ্গে জড়ানো লোভ । শ্যামল দেখেছিলেন এইসঙ্গে চাষী ও বলদ ডোবার জলে মুখের ছায়া দেখে । তারও আগে শ্যামল দেখেছেন শক্ত লোহার নরম হয়ে গলে যাওয়া, ব্লাস্ট ফার্নেসে । শ্যামল ইটখোলা করেছেন। গাড়ির ব্যবসা করেছেন, বাড়ি পাল্টেছেন চল্লিশ বার, চাকরি বার-দশেক । শ্যামল দেখেছেন যুদ্ধ-মন্বন্তর-দ্বীপান্তর-কুইট ইণ্ডিয়া, বেআইনী কমুনিস্ট পার্টি, নকশাল আন্দোলন, বাবু কমুনিস্ট ! শ্যামলের গল্প তাই অনায়াসে শুরু হতে পারে— 'তখন গুণ্ডাদের মন্ত্রী হবার রেওয়াজ ছিল না" । 

শ্যামলের রচনায় ঐসব রাজনৈতিক ঘটনার তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যাবে না তেমন । কারণ তিনি ঐসব ঘটনা-পীড়িত মানুষের প্রবহমানতার কথাই বলতে চান । তার মধ্যে খুব সন্তর্পণে জায়গা করে নেয় ইতিহাস ।

'হাতঘড়িতে নটা বাইশ। বাতাসে নলেন গুড়ের গন্ধ। মোড়ে ফুলকপির সিঙ্গাড়া লেখা লাল সালু । আদর্শ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে শীতের হাওয়ায় এখন রীতিমতো হাতছানি । ডান বগলের ক্রাচ্‌টা আলগা দিয়ে পরিতোষ ডান হাতেই জানলার শিকটা শক্ত করে ধরল। কাগজে দেখেছে কাল ঠিক এই সময়টায় কলম্বিয়ার আগ্নেয়গিরি কাদা বমি করে আশপাশের বিশ হাজার মানুষ মেরে ফেলেছিল । মনে আছে ইরা -- কালও আমি এই সময়ে এখানে এইভাবেই দাঁড়িয়েছিলাম – তখন তো জানি না বারো হাজার মাইল দূরে একটা আগ্নেয়গিরি হাজার হাজার মানুষের জীবন নিয়ে হরিরলুট খেলছে--কাদার সঙ্গে পাথর — আগুনের দলা জুড়ে গ্রামকে গ্রাম ঢেকে ফেলছে।" ( নখ্‌দর্পণ ) কিম্বা'

-- "এ কোনো নখদর্পণ নয় ইরা । যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই পড়ে দেখলাম আমি আর টোটো যখন ল্যাংটো হয়ে দৌঁড়চ্ছি ফাঁকা মাঠে- হাতে হাফ প্যাণ্ট – ঠিক তখন বার্লিন থেকে একটা গুডসি ট্রেন চেকোশ্লোভাকিয়ার পোজনিন-এ এসে থামল । ছাই রং-এর আকাশ, বৃষ্টি হচ্ছে । মালগাড়ি থেকে ইহুদিদের নামিয়ে গোরুভেড়ার মতো মার্চ করিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্যাস চেম্বারে । অথচ আমি আর টোটো নিষ্পাপ আনন্দে ফাঁকা মাঠে দৌঁড়চ্ছি। কী ভয়ঙ্কর ৷" (নখদর্পণ ) কিম্বা -- 

'কানন দেবীর বাড়ির জায়গাটা তখন ধানক্ষেত। বেহালার ট্রাম ডিপো পেরোলে পল্লীগ্রাম । উঠতি হিরোইন ভারতীদেবী । আমি গল্‌ফ ক্লাবের মাঠের কিনারে বল কুড়িয়ে সারাদিনে একটা টাকা পাই। অশুতোষে পড়ি। প্যারাডাইস রেস্তোরাঁয় দুটি লম্বা যুবক ভীড়ে চা খায় আর সিনেমার কথা বলে। অনেক পরে দেখলাম তারা ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেন । নেহরু আর গোলাপ দুজনই তখন টাটকা। তবে তিনি তখন ধুতি-পরা ছেড়ে দিয়েছেন । ব্রিগেডের মিটিং-এ জনতা উত্তাল হয়ে উঠলে হাতের ব্যাটন উঁচিয়ে মাইকে বলেন বইঠ্‌ । বইঠ্‌ । আর অমনি সবাই বসে পড়ে । ( ঘোড়ার মনমেজাজ ) 

কিম্বা। — "এক ঘটনা আর এক ঘটনার খবর না জানলেও সাবার সঙ্গে সবার যোগ আছে এটা বুঝতে পেরেই পরিতোষের সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা সাগরের ভেঙে পড়া সব ঢেউ একই সুতোয় গাঁথা! কী ভয়ঙ্কর ৷ কী আশ্চর্য । তা হলে কি নাদির শাহের মন খারাপের কোনো বিকেল আমার হো হো হাসির এক গোধূলির সঙ্গে গাঁথা ! এইসব জোড় এইসব ঝালাই বাতাসের ছাল তুললেই ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়বে ।"( চোরাস্রোত ) 

শ্যামল ঘোড়ার মনমেজাজ গল্পে বলেছেন — 'পৃথিবীর সব কথা কাহিনীই খুব গোপনে মহাভারতের সঙ্গে যুক্ত।" নিজেদের রেললাইন গল্পের দ্বারকাপ্রসাদের ইঞ্জিনের মালিক হবার ঈপ্সার মধ্যে মানুষের আদি আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতাই থাকে। এই সংকলনের চোরাস্রোত, নখ্‌দর্পণ, অপমানের স্বাদ এই ধারাবাহিকতারই গল্প। শ্যামল বলেছিলেন -- আকাশের নিচে নির্জনে কত মাঠ পড়ে থাকে । প্রান্তরে সাতটা তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। এরাই প্রান্তরের রক্ষক। পুকুর কাটতে গিয়ে বারো হাত নিচে নৌকোর গলুই পাওয়া গেল ! তাহলে একদা এখানে নদী ছিল ? 

এই যে রহস্য, যা মাটি খুঁড়ে পাওয়া যেতে পারে, জলের অতলে, বা ঝিনুকের ভিতরে বা বন্দী ভ্রমরে, জীবনের গভীরেও । 

শ্যামল বলেছেন — "কোন রহস্য থেকে মানুষ সৃষ্টি করে তা আজও রহস্যময় । সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে কোনো অঙ্কে মেলানো যায় না | মিহিরও কোনো অঙ্কে পড়ে না । সে নিজেই নিজের লেখার উৎস আর মিশেল নিয়ে মাথা খাটিয়ে টের পেয়েছে যা ঘটে – তা লিখলে লেখা হয় না । বরং যা ঘটতেও পারে এমনটা কোনো দৈবী পাগলামিতে জারিয়ে নিয়ে কাগজের উপর শব্দ বসালে তবে লেখা হয়৷'' ( আত্মজা ও একটি অস্ট্রিন ১৯২৯ )

এই সংকলনে বিভিন্ন মেজাজের যে গল্পগুলি আছে, তার মধ্যেকার সাধারণ ব্যাপারগুলি হচ্ছে উৎখনন । খোঁড়াখুঁড়ি বা দৈবী পাগলামি । নিজেকে, নিজের ধারাবাহিকতাকে খোঁজা। দশ আঙুলের আকাঙ্ক্ষা আর অ্যাকুতিতে যেমন বালির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে জল ।

নিজেদের রেললাইন গল্পের দ্বারকাপ্রসাদ সরকারি নীলাম থেকে একটা পুরনো ইঞ্জিন কিনে ফেলে। দ্বারকার স্ত্রী অগস্তি প্রাচীন শরীরের বা্তব্যাধি আর জীর্ণতা নিয়ে ঐ ইঞ্জিনে ওঠে। নিজস্ব ইঞ্জিন | দখলের স্বাদু ! মালিকানা। এরপর প্রাচীন ইঞ্জিনটাকে ঠেলে নিয়ে যায় একটি নবীন ইঞ্জিন -- প্ল্যাটফর্ম থেকে দুরে । তারপর অগস্তি ঐ ইঞ্জিন থেকে নামতে পারে না। প্ল্যাটফর্ম নেই। বাঁপায়ের পাতা আন্দাজে নিচের পাদানি খুঁজছে। হাত হ্যাণ্ডেলে । সামান্য ব্যাপার । বন্দী অগস্তির অসহায়তায় পাঠক নিজেকেও দেখতে পান । 

বাংলাদেশের মাড়োয়াড়িদের একটা অন্যরকমের ডায়ালেক্ট হয় । গল্পটিতে সেটিও খুব ভালোভাবে এসেছে। 

উঁইপোকা গল্পের মৃণালিনী ভট্টশালী বাংলাদেশে গিয়েছেন । নিজের শিকড়টা একবার দেখতে চান | কিন্তু শিকড় বলে আলাদা করে কি কিছু আছে ? কচুরিপানারও শিকড় রয়েছে। ভেসে বেড়ায় | জীবনেও ভেসে যাওয়া । সইফুলের হারানো প্রেম জীবনে এসে লাগে | ঘোড়ার মনমেজাজ আসলে ঘোড়ার গল্প নয় । গাড়ির । গাড়ি মানে হর্সপাওয়ার | মানে গতি । সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষা | আকাঙ্ক্ষার কি সীমা আছে। এরই মধ্যে আশ্চর্য কয়েকটি লাইন--| 'পার্টিশন আমাদের হাতে একটি মোয়া দিল । তার নাম কলকাতা । অভাব আর ময়লা দিয়ে পাকালে সেই মোয়া"— 

কিম্বা— 'আরাবল্লীর গুহা-গলতায় গিয়ে দেখলাম ছাইমাখা ল্যাংটা সাধু প্রচণ্ড শীতে উপনিষদ পড়ছে। সামনে গোল্ডফ্লেকের টিন | পূর্বাশ্রমের অভ্যেস । মাঝে মাঝে বই বন্ধ করে হিমেল, নীল আকাশে তাকাচ্ছে | যেদিকটায় ভগবানের ঠিকানা ।" 

এই ধরনের বাক্য পড়ে আমাদের একটা স্মিত হাসি হয় । কৌতুক বোধ করি। এই কৌতুক অসংগতির নয়। আসলে আমাদের পঠন সংস্কারে এই ধরনের বাক্যবন্ধ একটু পূর্বাভাসহীন । হঠাৎ আসে। আগের প্রস্তুতি ও সংলাপের সঙ্গে সঙ্গতিহীন । মুজতবা আলী কখনো বিষয়ান্তরে চলে যান। তখন পাণ্ডিত্যের দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। তখন মুগ্ধতা আসে। ঐ মুগ্ধতা এক ধরনের আনন্দ বা কৌতুক দেয়। কিন্তু শ্যামলের কৌতুকের উৎস অভাবনীয়তা ! হঠাৎ কিছু পেয়ে গেলে একটা বিস্ময়বোধ আসে। ওটাকে অসঙ্গতি ভেবে আপাতঃভ্রম করে পাঠক। তখন ঐ আনপ্রেডিক্‌টেবিলিটি বা অভাবনীয়তা এক ধরনের কৌতুক সৃষ্টি করে ।

শ্যামল ঈশ্বরীতলার রূপেকথার ভূমিকায় লিখেছিলেন – "মানুষকে ভালো ভাবে দেখতে জানলে কঠিন দুঃখেও হাসি পায় | চিরন্তনতার মাপকাঠিতে শেষপর্যন্ত প্রকৃতি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় । তখন সবকিছু সম্পর্কেই একটা হাসির দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়ে যায়। সে হাসির ভিতরে দুঃখের কথা ছিটানো থাকে। আলো পড়লে তা ঝিকমিক করে ওঠে। তাই আমার অনেক গুরুগম্ভীর লেখাতেও হাসি এসে গেছে।'

বলেছিলাম ঘোড়ার মনমেজাজ গল্পটি গাড়ি, শক্তি কিম্বা আকাঙ্ক্ষার । আসলে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির গল্প। কানু নামের একটি আশ্চর্য চরিত্রের বৃহুমুখীনতার গল্প । 

চোরাস্রোতে মানুষের ধারাবাহিকতার দর্শন রয়েছে । মর্কট পুরাণ একটি অশ্চর্য গল্প । মার্কেস্, বোরহেস, বা মিলান কুন্দেরা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা না পড়েও যদি লিখতে পারেন,শ্যামলও ওদের না আঁকড়েও অন্য ফর্মে লিখতে পারেন, অসুবিধে হয় না | 

দুগাগাপুর হল্ট একটি অসাধারণ গল্প। মানুষের জীবনের ভয়ংকর অনিশ্চয়তার কাহিনী । মানুষ কি জানে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কোথায় ? রহস্যে পরিপূর্ণ মানুষ সত্যিই আনপ্রেডিক্‌টেবল্‌। অথচ মানুষ মানুষই। বহু লক্ষ বছর ধরে সংঘ জীবন করা মানুষ কয়েকশো বছর হলো আলাদা আলাদা হয়েছে। তবু সংঘ-জীবনের চিহ্ন রয়ে গেছে মানুষের মধ্যে | মানুষের বিপদে মানুষই বাঁচায়। সুবিমল আশাতীতভাবে টাকা ধার পেল। যাবার কথা নয়, তবু বারবণিতার ঘরে যায়। ওঠার কথা নয়- -উঠে আসে। শেষ ট্রেন পাবার কথা নয়, একটি গার্ড ওকে উঠিয়ে নেয়, এবং সুবিমল যখন ট্রেনের বাইরে মাথা নিয়ে বমি করতে থাকে, তখন সুবিমল টের পেল 'তার মাথা এইমাত্র একটা খটখটে থাম্বা একচুলের জন্য মিস করল । গার্ডের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবু কেমন দুহাতে তার কোমর জড়িয়ে ডিউটি দিচ্ছে ।" 

মানুষের এই মাহাত্ম্য কথার বিবরণ আছে আত্মজা ও একটি অস্ট্রিন ১৯২৯ গল্পে । মিহির ঘোষালের গাড়িটি আটকে পড়েছিল, রাস্তায় যে-সমস্ত মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে আলোছায়ায়, তারা গাড়িটিকে ঠেলে দিয়েছিল । ব্যাপারটা চোঙা ফুঁকে বলার মতো কিছু নয়। তবু উন্মোচনের গুণে অসাধারণ গল্প হয়েছে এটি । মানুষের অন্তর্গত মণিমুক্তো পাই জ্ঞান অজ্ঞান গল্পটিতেও । 

'ভালবাসলে মেঘ হয়" গল্পে এসেছেন একজন সংগীতশিল্পী অশীন রায় | যার ঘরের দেয়ালে প্রধানমন্ত্রির সঙ্গে দাঁড়ানো ছবি রয়েছে, ওয়াশিংটনের নির্জন রাস্তায় হঠাৎ কোকিলের ডাক শুনতে পেয়ে মনে হয় কোকিলের কোন এল. পি, নেই, রয়ালটি নেই। তার সন্দেহ তার মৃত্যুর পর তার রেকর্ড কেউ কিনবে কিনা। নিজেকে নিয়ে নিজের ঘিরে থাকাই তাকে একাকী করে দেয় । শেষকালে দেখি এক রহস্য-মানুষ এসেছেন । যে আরো দুঃখী মানুষদের তালিকা তৈরি করছেন । অশীন আর ততটা একাকী থাকে না । যৌবন-নিকুঞ্জে গল্পটির নামটা পড়েই গানের কলিটি মনে পড়বে। যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি । যৌবন নিকুঞ্জ মানে আমাদের জীবন | জীবন রহস্য । একটি নারায়ণ শিলাকে নিয়ে গল্প। গল্পটি অগোছালো এবং টানহীন । 

বে-আব্রু আরেকটি অতি ভালো গল্প। মানুষের আনপ্রেডিক্‌টেবিলিটির । শ্যামলদা প্রয়াত রাধানাথ মণ্ডলের শোকসভায় বলেছিলেন --রাধানাথ একটুর জন্য মরে গেল। দ্রুত ধাবমান গাড়িটিকে মুহূর্তের জন্য অন্য গাড়ি ছুঁয়ে দিল বলে । আমরাও একটুর জন্য বেঁচে আছি । গল্পের শুরুতে গোলকধাম নামে একটি অধুনা অপ্রচলিত খেলার কথা বলা আছে। যেখানে সাপ-লুডোর মতো ঘর, শৌণ্ডিকালয়ের পাশেই অমৃতলোক, তার পাশেই রসাতল । একটা ঘর এদিক-ওদিক হলেই অমৃতলোকের পরিবর্তে রসাতলে চলে যেতে হয় । শেষকালে বলা আছে – পতনের ঘর এমন পষ্টাপষ্টি থাকার দরুনই গেরস্ত বাঙালিরা অমন পপুলার খেলাটা বাতিল করে দিয়েছে।

'শিয়ালদা কেমন আছে' ও 'বেঁচে থাকার বিশেষ উপায়' গল্পে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদের কথা বলা আছে। 'শীর্ষ সম্মেলনে' আছে কয়েকজন প্রাচীন মানুষের বেঁচে থাকার কথা। 'পারিজাতের ইতিহাস ও ভূগোল' একটি হাল্কা চালে লেখা প্রেম-প্রেম গল্প। সাজানো গোছানো পারিজাত ফ্লাট বাড়ির আভিজাত্য প্রসঙ্গে একটি লাইন : "পুজোর প্রসাদে অনেক খেজুর দেয়" আর গ্রীষ্ম বর্ণনা : 'রোদ চড়চড় করে বাড়ছে । পাড়ায় পাড়ায় মাসভোর রবীন্দ্রজয়ন্তী । পঁচিশে বৈশাখ পেরিয়েও । তারই মহলা চারদিকে । দিকে দিকে নটীর পূজা। সন্ন্যাসী উপগুপ্ত। আর গেরস্থদের বাজারের থলেতে একচেটিয়া নিমপাতা কাঁচা আম সজনে ডাঁটা । তার ভিতর বিয়ের বয়স পেরানো মেয়েরা | বিকেলে গা ধুয়ে চুল বেঁধে, টিপ পরে,--" 

'ঝিঝোঁটি দাদরা'য় পাই হারানো সংগীতের জন্য ব্যাকুলতা, মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে গল্পটির মধ্যে পাই মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছার রহস্যময়তা, সেই যুধিষ্ঠির যা ভেবেছিলেন এবং অবাক হয়েছিলেন।

এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলির মধ্যে মধ্যবিত্ত চরিত্ররাই বেশি । এবং তারা সবাই ষাটের এদিক ওদিক । সুতরাং এ সময়ের শ্যামলদাকেই পাব আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে । যিনি বলেন চুরুট পুড়ে গেলে আগুনের মাথায় দেড় ইঞ্চি ছাই থাকে। সেই ছাই কি লেখার অনুপান হতে পারে না ? যিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবীর কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যিনি বলেন সাহিত্যে রথী এবং মহারথী বিজ্ঞাপনের ভাষা মাত্র। 

অথচ তার দিকেই শিক্ষার্থীর মতো আমাদের প্রজন্মের লেখকরা চেয়ে থাকি আধুনিকতা কী জিনিস জানবার জন্য।

আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি শ্যামলদা সহজে পুরোনো হবেন না। আর শেষ কথাটি হলো ওর কাছে একটি আয়না আছে, পিছনে ধরার, সেলুনে যেরকম, যাতে না-দেখাগুলি দেখা যায় । ওটা আমার চাই ।

Saturday, April 14, 2018

টুকরো ভাবনা : 'আধুনিক'

'আধুনিক' শব্দের সঠিক অর্থ কী? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্য? সমসাময়িক? সাম্প্রতিক? সপ্রতিভ? একসময় উনিশ শতক আধুনিক ছিল, তারপর বিশ শতক, এখন একুশ শতক। আধুনিকতা যুগের পর যুগ পার হয়ে নিজেই অতীত হয়ে যায়। বিশ শতকে যা আধুনিক ছিল একুশ শতকে তা প্রাচীন, উনিশ শতকের আধুনিকতাকে তো মধ্যযুগ বলা চলে।

সাহিত্যে আধুনিকতার কোন মানদণ্ড আছে? আধুনিক শব্দটা সেকেলে হয়ে গিয়েছিল বলে বিশ শতকের সাহিত্যিকরা উত্তরাধুনিক সাহিত্য নামে শব্দবন্ধ ব্যবহার শুরু করেছিল, উত্তরাধুনিকতার পরে কী আর কোন আধুনিক পর্ব এসেছে?

২৩ বছর বয়সে যে উপন্যাস মর্ম স্পর্শ করেছিল- ৪৯ বছর বয়সে যদি সেই উপন্যাসকে বিরক্তিকর মনে হয় তার দায় কী উপন্যাসের নাকি পাঠকের বিবর্তিত মননের? আবার কিছু উপন্যাস ২৩ বছর বয়সে যেমন লেগেছিল এখনো তেমন লাগছে। কালের স্পর্শে ক্ষয়ে যায়নি অনুভূতি। সেটাই কী আধুনিক উপন্যাস? তার মানে আধুনিকতা মানে কালোত্তীর্ণতা?

দিন কয়েক আগে পুর্বে পঠিত প্রিয় কয়েকটি উপন্যাস হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে এই প্রশ্নগুলোর উদয় হলো। যে বয়সে রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেই বয়সে দস্তয়েভস্কির 'ক্রাইম এণ্ড পানিশমেন্ট' পড়েও বুকের ভেতর তোলপাড় করেছিল। কিন্তু 'গোরা' পড়তে এখন পানসে লাগে, 'ক্রাইম এণ্ড পানিশমেন্ট' পানসে লাগে না। এটি ছোট্ট একটি উদাহরণ। এই উদাহরণটি প্রমাণ করছে বুকশেলফে দ্বিতীয়বার পড়ার জন্য জমিয়ে রাখা কয়েকশো উপন্যাস আর কখনোই পড়া হবে না।

তাহলে কী দুবার পড়া যায় না তেমন বই না কিনে ধার করে লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়ে ফেলা সঙ্গত?

শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন': তাৎক্ষণিক পাঠানুভূতি

দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, আরোপিত দুর্ভিক্ষ, আজাদ হিন্দ ফৌজ, সুভাষ বসুর অন্তর্ধান, ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে একাধিক বইপত্র পড়া সত্ত্বেও জানার অনেক বাকী থেকে গেছে। সম্প্রতি 'অসুখী দিন' পড়ে মুখোমুখি হতে হলো অজানা এক বাস্তবতার। জানলাম দেশভাগের প্রাক্কালে শিলং অঞ্চলে বাঙালী খাসিয়ার দ্বন্দ্ব। শিখলাম 'উডখার' নামে নতুন একটি শব্দ বা গালি।

কিছু কিছু উপন্যাস পড়া উচিত অখণ্ড অবসর এবং নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের সুযোগ থাকলেই। শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন' তেমন একটি বই। আমার দুর্ভাগ্য উপরোক্ত দুটিরই অভাব ছিল আমার। এক নাগাড়ে অখণ্ড অবসর নিয়ে পড়তে পারিনি। তাতে করে বড় কোন সমস্যা না হলেও কোন কোন জায়গায় উপন্যাসটিকে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। উপন্যাসটির কাঠামো নির্মিত হয়েছে দুটি স্মৃতি কথা এবং ছোট্ট একটি ডায়েরীর যোগফল দিয়ে। পাঠক যাত্রা শুরু করবেন দুই স্মৃতিচারণের সমান্তরাল প্রবাহ দিয়ে। একই উপন্যাসে দুটি সমান্তরাল চরিত্রের বিবরণ যখন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে তখন তার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পাঠকের পক্ষে একটা প্রবল তাগিদ থাকে। পড়তে পড়তে সেই তাগিদটা আমিও অনুভব করেছিলাম কিন্তু কখনো সেই সংযোগ রেখা স্পর্শ করতে পারছিলাম, কখনো আবার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম।

এভাবে চলতে চলতে ঘটনা যখন বাড়ির উঠোন ছাড়িয়ে দেশের রাজনীতি পেরিয়ে মহাযুদ্ধের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে যেতে বসে তখন পাঠক সেই সংযোগটি পেয়ে যায়। যেখানে দুই স্মৃতিকথায় বর্ণিত দুই চরিত্রের যোগাযোগ ঘটেছিল। তবে সেই সংযোগ ঠিকানাটি একটি জংশনের মতো। যেখানে দুই যাত্রী দুই আলাদা ট্রেনে উঠে যাবে যদিও গন্তব্য তাদের একই স্টেশন।

শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন' পড়তে বসে পাঠক হিসেবে একই গন্তব্যের দুই ট্রেনের যাত্রীর অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। একটি ট্রেনে বাংলাদেশের সাবিনা, যার পিতা সুভাস বোসের আজাদ হিন্দের সৈনিক ছিলেন। অন্য ট্রেনে অনিতা সেন, যার দাদা আজাদ হিন্দের হয়ে যুদ্ধে গিয়ে ফেরেননি।

সাবিনার পিতা এবং অনিতার দাদা যে আজাদ হিন্দ ফৌজের সহযোদ্ধা ছিলেন সেটা পাঠক বইয়ের ফ্ল্যাপেই জেনে যাবেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সাবিনার বাবা ফিরে এলেও তাঁর সহযোদ্ধা নীরু ফেরেনি। কেন ফেরেনি সেই উত্তর অনিতা সেনের স্মৃতিকথায় নেই। সেই পরিণতিটার সন্ধান করে গেছে অনিতা সেন।
নীরুর শেষ পরিণতি জানতেন সাবিনার বাবা। সিলেট থেকে ট্রেনে চড়ে সাবিনা যখন সময় কাটাবার জন্য ১০০ টাকায় কেনা পুরোনো বইটি পড়তে শুরু করেন তখনো কল্পনা করেননি এই বইয়ের সাথে তাঁর পিতার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের গভীরতম যোগাযোগ আছে যে অধ্যায় তাঁর জীবন থেকে বুদবুদের মতো উবে গিয়েছিল।

অনিতার স্মৃতিকথা পাঠ শেষে সাবিনার আসল কাজ শুরু হয়। সাবিনা তার মায়ের মাধ্যমে বাবার কাছ থেকে নীরুর পরিণতির কথা জানতে পারেন। এরপর সাবিনা সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন উপায়ে অনিতা সেনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে বাবার দেয়া নীরুর শেষ পরিণতির তথ্যটি। কিন্তু এত বছর পর অনিতা সেনকে খুঁজে বের করা সম্ভব? হ্যাঁ সেও সম্ভব হয়েছিল। সংবাদকর্মী সাবিনাকে তাঁর মেজভাই অনুরোধ করেছিল বাবার জীবনের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় নিয়ে তাদের পরিবারের সোনালী ইতিহাস লেখার জন্য। অনিতা সেনের স্মৃতিকথা তাঁকে সেই সেই পথটা বাতলে দিল কিছুটা। সেই পথ ধরে অনিতা সেনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে কলকাতা গিয়ে যেসব সুত্র মেলে তাতে জানা যায় অনিতা সেন এখনো জীবিত আছেন। সাবিনা তখনই সিদ্ধান্ত নেন শিলং গিয়ে অনিতা সেনের সাথে দেখা করবেন।

কিন্তু উপন্যাসের শেষ পর্বে শিলং পৌঁছে যাবার পর তার জন্য অপেক্ষা করছিল অন্য এক বিস্ময়। তবে একজন পাঠকের জন্য বইটা পড়ে সেই বিস্ময়ের মুখোমুখি হওয়াটাই সঙ্গত।

পাঠমুগ্ধতার পাশাপাশি উপন্যাসে কিছু তথ্য বিষয়ে একটু সমালোচনা করা যাক। পাঠক হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ

১. অনুমান করা হয়েছে সিলেট স্টেশন এড়িয়ে হিল সেকশন রেলওয়েতে করে শিলং থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন মোয়াজ্জেম হক ও নীরদচন্দ্র সেন। কিন্তু শিলং থেকে চট্টগ্রামের কখনোই কোন রেল যোগাযোগ ছিল না।

২. হিরোশিমাকে একটি দ্বীপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু হিরোশিমা দ্বীপ নয়। উপকূলীয় শহর।

৩. মুক্তিযুদ্ধের আগেকার উত্তাল সময়ে জনপ্রিয় একটি শ্লোগান উল্লেখ হিসেবে করা হয়েছে 'সংগ্রাম সংগ্রাম ১১ দফার সংগ্রাম'। কিন্তু এর চেয়ে 'জয় বাংলা' বা 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা' শ্লোগানটি বেশী জনপ্রিয় ছিল বলে মনে হয়।

৪. শুধুমাত্র মাইজভাণ্ডারী গান শোনার অপরাধে কাশেম মিয়ার মতো অনাহারী পঙ্গু অথর্ব একটা মানুষকে হত্যা করাটা ঠিক বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। জঙ্গী ওহাবীরা হত্যার জন্য আরো ভালো টার্গেট বেছে নিতেই দেখা গেছে। কাশেম মিয়ার হত্যাকাণ্ডটি উপন্যাসের জন্য কেন প্রয়োজন ছিল সেটা বোঝা যায়নি।

৫. অনিতা সেনের ভাবনায় রাশিয়ার বিপ্লবী তানিয়ার আত্মাহুতি দেবার ছোট্ট ঘটনাটি কাজ করে, কিন্তু তানিয়ার ঘটনাটি সেই আমলে এত দ্রুত ভারতে পৌঁছে যাওয়াটা একটু অবিশ্বাস্য ঠেকেছে।

এমন ছোটখাট অসঙ্গতি ছাড়া বইটি পড়তে ভালো লেগেছে। সবশেষে উপন্যাসের একটি বিশিষ্টতার কথা না বললেই নয়।

উপন্যাসটিতে মোয়াজ্জেম হকের চরিত্রের মাধ্যমে দেশভাগের চেনা বেদনার অচেনা কিছু চিত্র আমরা পেয়ে যাই। আছে কিছু মর্মান্তিক সত্য, অপ্রিয় বাস্তবতা। চল্লিশের দশকে যারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সুভাষ বসুর নেতৃত্বে, সেই স্বপ্নবাজদের একদল ছিল ভারতীয়, আর ছোট্ট একটা দল ছিল অভারতীয়, সাবিনার বাবা মোয়াজ্জেম হক ছিলেন অভারতীয় দলে। যার স্বপ্ন সফল কিংবা ব্যর্থ হয়েছিল কিনা সেটা ভাবার জন্য পাঠককে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে। ইংরেজের হাত থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিক, কিন্তু সেই দেশটি পাকিস্তান, যার সূচনাতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে হয়েছিল মোয়াজ্জেম হককে। কেননা তাঁর নেতা পাকিস্তানের কেউ নন, পাকিস্তানে তিনি অবাঞ্ছিত।

যেসব মানুষ স্বাধীন ভারতবর্ষ চেয়ে পাকিস্তানের নাগরিক হতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের সেই স্বপ্নগুলো বুদবুদের মতো মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই মানুষগুলোকে আমাদের কারো মনে নেই। কেননা ওই স্বপ্নভঙ্গের পরপরই বাংলাদেশ পাকিস্তানের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে শুরু করে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন দিয়ে যাত্রা করে যার সমাপ্তি ঘটে আরো অনেক বেশী রক্তক্ষয়ী চেতনা সমৃদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বাপ্নিকদের সামনে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বাধীনতা সৈনিক মোয়াজ্জেম হক। তিনি এই প্রজন্মের কাছে অচেনা। এই অচেনা মানুষকে 'অসুখী দিনে'র মাধ্যমে আমাদের সামনে হাজির করেছেন শাহীন আখতার।



রজনী রঞ্জন সেন এবং: রবীন্দ্র ছোটগল্পের প্রথম ইংরেজি গ্রন্থ ১৯১৩

তথ্যটি অন্ততঃ আমাকে চমকে দিতে পেরেছিল। কেননা চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে আমার সামান্য কিছু পড়াশোনা আছে দাবী করলেও রজনী রঞ্জন সেনের নামটিও আমি কখনো শুনিনি। অথচ শতবর্ষ আগে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে। ১৯০৭ সালের জুন মাসে দুদিনের জন্য চট্টগ্রাম সফরে এলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়িতেই একমাত্র সাহিত্য সভাটি করেছিলেন।

বর্তমানে চট্টগ্রামের কোথাও তাঁর নাম নিশানা না থাকলেও নোবেল কমিটির কাছে তাঁর সেই অনুদিত ছোট গল্পের ইংরেজি পুস্তকটি এখনো সংরক্ষিত আছে এবং অনুবাদক হিসেবে তাঁর নামটিও রবীন্দ্রনাথের কীর্তির পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে নোবেল কমিটির ওয়েব সাইটে।

এসব তথ্য হয়তো কেউ কেউ জানে, আমার কাছে অজানা বলে আমি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেছি তাঁর কাছে যিনি ব্যাপারটা মাটি খুঁড়ে বের করেছেন। রজনী রঞ্জন সেনকে আমাদের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন নিভৃতচারী লেখক ও গবেষক মাসুদ করিম। তিনি কিভাবে রজনী রঞ্জন সেনের খোঁজ পেলেন সেই বিবরণটি লিখেছেন এই ব্লগে-
সেই লেখায় তিনি যেটা দিয়ে উপসংহার টেনেছেন তা হলো-

"আমার অনুসন্ধানের কাজ শেষ, এখন আমি দুটো জিনিস চাই, কেউ আমাকে Nobelbibliotek থেকে রজনী রঞ্জন সেনের বইটি জোগাড় করে দিক, পড়ি, আর কেউ এই কৃতী মানুষটির ভিটেমাটি জন্মমৃত্যু কীর্তির খোঁজখবর নিয়ে জানাক আমাদের।"

গবেষক মাসুদ করিমের এই ইচ্ছেটা পুরণ হবে বলে আশাবাদ রাখি। তাছাড়া রজনী রঞ্জন সেনের মতো একজন কৃতি মানুষের নাম ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়া উচিত নয়।

যদিও রজনী রঞ্জন সেনের ভিটেমাটি কিংবা তাঁর জীবনকর্ম সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, তবু তাঁকে নিয়ে সৃষ্ট হওয়া কিছু আলোচিত বিষয়ের সন্ধান আমরা পেয়ে যাই Satish Barbuddhe সম্পাদিত ২০০৭ এ দিল্লী থেকে প্রকাশিত Indian Literature in English : Critical Views পুস্তকে।

এই পুস্তকে Dr. S L Paul তাঁর সুলিখিত  Rabindranath Tagore's Prose and Drama : An Evaluation of His Literary Contribution to South-Asian Studies প্রবন্ধে রজনী রঞ্জন সেন সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়।

তাতে দেখা যাচ্ছে ১৯০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গল্পের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের ব্যাপারে রজনী সেনকে অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই অনুবাদটি  চট্টগ্রামের মিন্টো প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল কবির নোবেল প্রাপ্তির কয়েক মাস আগে ১৯১৩ সালের শুরুতে। গীতাঞ্জলির পর এটিই ছিল রবীন্দ্র সাহিত্যকর্মের দ্বিতীয় ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ।  এই কপিটি সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে, সুনামের পাশাপাশি সমালোচনারও বিষয় হয়ে ওঠেছিল একসময়।

বইটির প্রকাশ সম্পর্কে Indian Literature in English : Critical Views গ্রন্থে যা বলা হয়েছে-

Tagors first collection of short stories in English translation appeared in 1913, a few months before the announcement of the Nobel Prize. Not much is known about translator Rajani Ranjan Sen, a pleader and a lecturer in law in Chittagong College. But he certainly was not either close to Tagore or a known literary figure in Bengal. Although translations of short stories of Tagore had began to appear from 1902 onwards, Sen was the first to think of putting them together in a book. He asked for Tagore's permission around 1909 and the book came four years later. Despite its limitations, the book played positive role in the projection of Tagore before the western readership. It may be mentioned here that this book was acquired by the Swedish Academy. [ Indian Literature in English : Critical Views , Satish Barbuddhe, page 61-62]

মজার ব্যাপার হলো রবীন্দ্রনাথ রজনী রঞ্জন সেনকে বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশের আগে অনুমতি দিলেও নোবেল প্রাপ্তির দুবছর পর পুনর্মুদ্রনের সময় আপত্তি করেছিলেন। কবির নোবেল প্রাপ্তির বছর দুয়েক পর ১৯১৫ সালে বইটির চাহিদা বৃদ্ধি সাপেক্ষে রজনী রঞ্জন সেন  দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তখন রবীন্দ্রনাথ সেটি প্রকাশে বাধা দিতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়।

তাঁর এই মত পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছিল তাঁর অনুরাগী সাহিত্যিকদের কিছু বিরূপ মন্তব্য। যার মধ্যে একজন ছিলেন বিখ্যাত শিল্পবোদ্ধা সমালোচক Rothenstein, যিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অন্যতর অনুবাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় রমানন্দ চ্যাটার্জি সম্পাদিত মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত পোস্টমাস্টার গল্পের অনুবাদ। কিন্তু রজনী রঞ্জন সেনের অনুবাদটি সম্পর্কে বলেছিলেন - "translation of your stories those recently published are too monstrously ill done for words"

এই কারণে রজনী রঞ্জন সেন যখন দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন, তখন কবি সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোন কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে এই চেষ্টার পেছনে আরো একটি কারণ ছিল আমেরিকান খ্যাতনামা প্রকাশক ম্যাকমিলান।

নোবেল প্রাপ্তির বছর দুয়েক পর ম্যাকমিলানও রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদ প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং সঙ্গত কারণে কবিও চেয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত কোন প্রকাশনী থেকে মানসম্পন্ন অনুবাদ প্রকাশিত হোক। তাই কবি তখন মরিয়া হয়ে নতুন কোন অনুবাদকের সন্ধান করেছিলেন এবং সম্ভবত চেয়েছিলেন ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ছিল তাঁর পছন্দের অনুবাদক। কিন্তু সময় কম ছিল বলে সেটি সম্ভব হয়নি।

শেষমেষ  রজনী রঞ্জন সেনের অনুবাদটিই নোবেল লাইব্রেরিতে স্থায়ী আসন গেড়ে থাকল। সেই অনুবাদ গ্রন্থের প্রিন্টার্স পাতাটি সম্প্রতি নোবেল লাইব্রেরী থেকে পাঠানো হয়েছে মাসুদ ভাইয়ের কাছে।

তবে মাসুদ করিম তাঁর অনুসন্ধান আপাততঃ সমাপ্ত ঘোষণা করলেও তিনি অপেক্ষা করছেন রজনী রঞ্জন সেনের সেই অনুবাদ গ্রন্থটির একটি সম্পূর্ণ পাঠের। যা নোবেল কমিটির কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়তো সম্ভব হবে না। তাই তিনি ভারতের কোন লাইব্রেরীতে সন্ধান করতে চান, যদি সেই দুর্লভ সংগ্রহ কোথাও থেকে থাকে। নিদেন পক্ষে কারো কাছে যদি একটি স্ক্যান কপিও মেলে তাতেও তিনি বাধিত হবেন।

আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে না হলেও ভারতের কোন লাইব্রেরীতে এই গ্রন্থের সন্ধান মিলতে পারে। কিংবা কারো পুরোনো বুকশেলফে, যেখানে অনাদরে পড়ে আছে ধুলিমাখা শতবর্ষ প্রাচীন একটি গ্রন্থ। যেখানে শিরোনামগুলো সাজানো থাকবে এভাবে-

Glimpses of Bengal Life,
(Short Stories from the Bengali of Rabindranath Tagore)
Author :  Rabindranath Tagore
Translated by : Rajani Ranjan Sen
Published by : Minto Press, 1913
Distributed by   : Natesan & Co, Madras 
Length :  240 pages  

Sunday, April 1, 2018

একটি মধ্যবিত্ত সোফাসেট

আমাদের বাসায় যারা এসেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন ড্রইং রুমে এক সেট পুরোনো আমলের কাঠের সোফা আছে। পাঁচ আসনের সোফা সেটে দশটি ফোম বসানো। সেগুন কাঠের সোফাটি এখনো সম্পূর্ণ অক্ষত। আসলে খুব বেশী পুরোনো বলা চলে না। গুনে গুনে ৩২ বছর মাত্র। অর্ধশতকও পূর্ণ হয়নি। এমন ডিজাইনের ফার্নিচার আজকাল কেউ সাজিয়ে রাখে না ড্রইংরুমে। আর্থিক সামর্থ্য আসার পর মানুষ পুরোনো জিনিসপত্র ফেলে দিতে শুরু করে। আমরাও ফেলে দিয়েছি অনেকগুলো। কিন্তু এটা এখনো ব্যবহার অনুপোযোগী হয়নি বলে ফোম আর কাভার  বদলে রেখে দিয়েছি। এই সোফাসেটটা আমাদের পরিবারের কালের সাক্ষী বলা চলে। এর উপর দিয়ে অনেক ঝড়বাদল, অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তবু সে টিকে আছে। তালগাছের মতো একা দাঁড়িয়ে। কেন রেখেছি তাকে? বলছি একটু পরে।

গত দুই দশকে আমাদের আত্মীয় স্বজনে যেসব পরিবার মধ্যবিত্ত ছিল, তাদের সবার চেহারা বদলে গেছে। দাদা কিংবা নানার পরিবারের যে বংশধর, সবাই নানান দিকে ব্যাপক উন্নতি করেছে। তিন দশক আগে যে পরিবারগুলো টেনেটুনে দিন পার করতো, তারা সবাই এখন স্বচ্ছলতার মগডালে উঠে গেছে। কেউ কেউ এত উপরে উঠেছে যে পেছনের কালি ঝুলি মোছামুছি করতে করতে বর্তমানকে এতটা তেল চকচকে পিছলা করেছে তাতে আমার দৃষ্টি হোঁচট খায় মাঝে মাঝে। অতীতের কোন চিহ্ন রাখতে চায় না বাঙালীরা। এটাই মনে হয় স্বাভাবিক আচরণ।

কিন্তু আমি কেন যেন পুরোনোকে পুরোপুরি বাদ দিতে পারি নি। কিছুটা উন্নতি আমিও করেছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু সে উন্নতির পেছনে আমার অতীতের ভূমিকাকে আমি বারবার টেনে আনি। এ আমার মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা। সবাই মধ্যবিত্ত থেকে বের হয়ে যাবার আপ্রান চেষ্টা চালালেও, আমি যেন সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছি। অথবা মধ্যবিত্ত চরিত্র আমাকে ছাড়তে চাইছে না।

সেই যে সোফাসেটের কথা বলেছি, ওটা তার একটা উদাহরণ। নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার পর ড্রইংরুমে দুই সেট সোফার দরকার হয়ে পড়ে। নইলে ঘরটা খালি খালি লাগছিল। এক সেট পুরোনো সোফা রয়ে গেছে, ওটাকে বাদ দেয়া হবে কিনা সেটা নিয়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। ওটা থাকবে সাথে নতুন একটা কেনা হোক। যখন আমি নতুন সোফাসেট অর্ডার দিতে গেছি, তখন শো রুমের চোখ ধাঁধানো বিশাল বপুর হাল ফ্যাশনের সোফাগুলো আমাকে টানতে পারছিল না। আমি একটি মলিন চেহারার সোফাসেট অর্ডার দিলাম। পুরোনো সোফাটার সাথে যেন মানানসই হয়। যদি পুরোনোকে বাদ দিয়ে নতুন দুই সেট কিনি, তাহলে আমার ড্রইংরুমে একটা বড়লোকী ছাপ এসে যায়। এহেন আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়িতে সবাই বড়লোকি ছাপ নিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু ওটা আমি চাই নি। আমি আমার বর্তমান লেভেল থেকে আর এক ধাপও উপরে উঠতে রাজী নই।

সে না হয় বোঝা গেল। কেউ কেউ আরো বেশী উন্নতি চায় না। থেমে যায় এক জায়গায় পৌঁছে। কিন্তু সেই সোফা কাহিনীটা কী?

আদতে এই সোফাটার সাথে আমার বাবার খুব ঘনিষ্ট স্মৃতি জড়িত। বাবা খুব শখ করে কিনেছিলেন অনেক দাম দিয়ে। যখন টাকার অনেক দাম ছিল, যখন অল্প টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত, যখন মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে বস্তাভর্তি বাজার করা যেতো, যখন ১ টাকা দিয়ে দুই মাইল রিকশা চলতো, দেড় টাকা কেজি চাল বিশ টাকা কেজি মাংস খেতো লোকে, যখন ৩ টাকার কলম আর দুই টাকার কাগজ দিয়ে দশটা পরীক্ষা দেয়া যেতো, যখন ৪০০ টাকা দিয়ে দুই বেডের বাসা ভাড়া পাওয়া যেতো, তখন বাবা ৬০০০ টাকা দিয়ে আসল সেগুন কাঠের এই সোফাটি কিনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

সোফা কিনে তাক লাগানোর কথা শুনে আজকাল অবাক হবে অনেকে। সোফা কিনে তাক লাগানোর আগে রঙিন টিভি কিনেও তাক লাগিয়েছিল বাবা। আমাদের যে সকল আত্মীয় স্বজনের চকচকে উন্নতির কথা বললাম, তাদের কারো বাসাতে তখনো এমন সোফাসেট কিংবা রঙিন টিভির প্রবেশ ঘটেনি। তা বলে তারা যে হতদরিদ্র ছিল তাও নয়। কিন্তু টানটান নিন্মমধ্যবিত্ত জীবন সবার। রঙিন টিভি তখন চোখের ক্ষতি করতো বলে প্রায়শ আমরা শুনতাম। তবে সোফাসেট শরীরের কোন ক্ষতি না করলেও বাবার মধ্যে একটা সংকোচ কাজ করেছিল এটা কেনার পর। তাই সোফা যখন কেনা হয় তখন বাবাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল। বাবা যখন প্রভূত আর্থিক উন্নতির সোপানে দাঁড়ানো। তবু আত্মীয় স্বজন যেন মনে কষ্ট না পায়, সে কারণে সোফা কেনার সময় বাবা সবাইকে বলেছিল, তার এক বন্ধু ঢাকা চলে যাবার সময় সোফাগুলো কম দামে গছিয়ে গেছে। সেই মিথ্যাটা আমরা অনেকদিন চালু রেখেছিলাম।

এই সোফাতে বসে বাবা প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়তো, সারাদিন চুমুকে চুমুকে চা খেতো, অতিথি আসলে আদর আপ্যায়ন করে বসাতো, গল্প করতো হরদম। নতুন বাড়িতে ওঠার পর বাবার অবসর যাপনের একটা প্রিয় সঙ্গী ছিল এই সোফাসেট।

এই সোফাসেট কেনার সময় বাবা কী জানতো এটার আয়ু বাবার চেয়ে অনেক বেশী হবে? অত খেয়াল করে কেউ কেনে না। কিন্তু আমি এই বয়সে এসে, পঞ্চাশের কাছাকাছিতে, শোপিস বা ফার্নিচারের মতো জড় পদার্থ যা কিছুই কিনি, মনে মনে বলি, এটার আয়ু আমার চেয়ে বেশী হবে।

আমি আমৃত্যু মধ্যবিত্তই থেকে যাবার চেষ্টা করবো। আমার পুত্র হয়তো চেষ্টা করতে পারে মধ্যবিত্তের শেকল ছিঁড়ে বের হয়ে যেতে। আমার মধ্যবিত্ত বাবাকে ছেড়ে আমি উচ্চতর সিঁড়িতে যেতে চাই না। জীবিত বাবাকে নিয়ে আমি যে আহলাদ করতে পারিনি, অনুপস্থিতিতে আমি সেটা করে যাচ্ছি নিরন্তর। তার একটি হলো এই সোফাসেট। আমি প্রতিদিন তার কাঠের হাতলে হাত বুলিয়ে বাবার স্পর্শ নেই সকলের অলক্ষ্যে। এ আমার অক্ষম ভালোবাসা প্রচেষ্টা।