Sunday, October 23, 2016

তোমার স্রোতের ঘুর্ণিপাকে

চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে। সূর্য ঘুরছে ছায়াপথের কক্ষপথে। ছায়াপথ ঘুরছে আরো বহুকোটি নীহারিকার সাথে। আমরাও কী ঘুরছি কাউকে প্রদক্ষিণ করে? আমি জানি না। কিন্তু এটা দেখতে পাচ্ছি সময়ের কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসছে অথবা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছে।

কালচক্রে প্রতিদিন তুমি কক্ষপথের অদৃশ্য ছায়া মাড়িয়ে আমার সন্নিকট হয়ে যাচ্ছো তোমারই অজান্তে। আর তোমার নৈকট্য আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে চোরা স্রোতের জোয়ারে। আমি ভেসে যাচ্ছি উচ্ছ্বাসের প্লাবনে। ডুবতে ডুবতে আমি ভেসে উঠছি, আবার ভাসতে ভাসতে ডুবে যাচ্ছি। তোমার স্রোতে ডুবতেও আনন্দ, ভাসতেও আনন্দ।

অথচ এই আনন্দ উদযাপনে আমি নিতান্তই নিঃসঙ্গ। যেন আমি তোমাকে আমি দেখিনি কখনো, তুমিও আমাকে দেখোনি। দেখা না দেখার সেই আলো ছায়ার আড়ালে আমি ঘোর পাওয়া মানুষের মতো ভেসে যেতে থাকি। আমার এই ভাসানবিলে তুমি কখনো সাঁতার কাটবে না জেনে আমি দাঁড় তুলে আপন নৌকায় বসে কোজাগরী পূর্নিমায় মেঘ বিষাদে নিজেকে আড়াল করে রাখি।

আর তখন সেই নিস্তব্ধ রাতে হেমন্তের কুয়াশা ভেদ করে বুকের ভেতর কিশোর কুমার  আপন মনে গাইতে থাকে https://www.youtube.com/watch?v=kUAP0hIqzZ4

Friday, October 7, 2016

উনিশ শতকে তিব্বত কাঁপানো চট্টগ্রামের এক জেমস বণ্ডের গল্প

চট্টগ্রামে জন্ম হলেও তাঁর নামও জানে না এখানকার মানুষ। হয়তো খুব অল্প সংখ্যক গবেষক জানেন। যাঁর কথা বলছি তাঁর প্রাথমিক পরিচয় একজন স্কুল হেড মাস্টার। তবে যেরকম গল্প আপনারা স্পাই থ্রিলারে পড়ে রোমাঞ্চিত হন এই বাঙালী হেড মাস্টারের গল্প তার চেয়ে বহুগুন বেশী চমৎকৃত করবে। এরকম হেড মাস্টার এই দেশে দ্বিতীয়জন জন্মেছেন বলে মনে হয় না, জন্মালেও আমাদের জানা ইতিহাসে তার কোন নজির পাইনি। ইনি চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও তাঁর কর্মস্থল স্কুলের অবস্থান ছিল সুদূর অবাঙালী অঞ্চল দার্জিলিং এ। ভারতবর্ষ তখন একটি মাত্র দেশ। স্বাধীন হতে আরো প্রায় পৌনে এক শতক বাকী। ঘরকুনো বাঙালীদের কাছে তখন দার্জিলিংও অনেক দূরের দেশ।

সেই হেড মাস্টারের নাম শরত চন্দ্র দাস। জন্মেছিলেন ১৮৪৯ সালে চট্টগ্রামের ধলঘাট ইউনিয়নের অখ্যাত এক গ্রাম আলমপুরে। চট্টগ্রামে স্কুল পড়াশোনা শেষ করে কোলকাতার প্রেসিডেন্সিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার আগে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হন। তারপর হাওয়া বদলের জন্য তাকে যে দার্জিলিং ভ্রমণে যেতে হয়, সেটা তাঁর জীবনের বাঁকও চুড়ান্তভাবে বদলে দেয় একদম নতুন একটি পথে।

শরতচন্দ্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে বৃটিশ সরকারের অনুরোধে(এই অনুরোধ কতোটা পূর্বপরিকল্পিত সেটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে) দার্জিলিং এ সদ্য প্রতিষ্ঠিত ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের হেড মাস্টারের পদে যোগ দেন ১৮৭৪ সালে। বোর্ডিং স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিকিম দার্জিলিং এর সম্ভ্রান্ত ভুটিয়া পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। অনেকের হয়তো জানা আছে যে দার্জিলিং, সিকিম, ভূটান, তিব্বত এই অঞ্চলগুলোর বৌদ্ধ ধর্মের আচার সংস্কৃতি প্রায় সবকিছু একরকম এবং এরা প্রত্যেকে একই সাংস্কৃতিক বোধ লালন করে। তাদের সবারই ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু তিব্বতমূখী। যেখানে দালাই লামা প্রধান ধর্মগুরু।

ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়ে শরতচন্দ্র তিব্বতী ভাষা সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হন। সিকিম রাজার জ্যৈষ্ঠপুত্র ছিল তাঁর ছাত্রদের একজন যিনি পরবর্তীতে সিকিমের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই সম্পর্ক সুত্রে শরতচন্দ্র দার্জিলিং থেকে সিকিম ভ্রমণ করেন এবং রাজপরিবারের ঘনিষ্টতা অর্জন করেন। সেখানেই তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে কয়েকজন তিব্বতী লামার সাথে। একজন তিব্বতী লামাকে তিনি নিজের সহকারী হিসেবে স্কুলে চাকরীভুক্ত করান। তিব্বত তখনো নিষিদ্ধ একটি দেশ। বাইরের কোন দেশের নাগরিকের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইউরোপীয়ানরা বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করার চেষ্টা করে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসে। প্রাকৃতিকভাবেও তিব্বত খুবই দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত। তবে হিমালয় পর্বত পেরিয়ে তিব্বত গমনের যে কঠিন যাত্রাপথ তার চেয়েও বেশী কঠিন তিব্বতের নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল।

তিব্বতী ভাষা ও সংস্কৃতি তাঁকে এত বেশী আকৃষ্ট করেছিল যে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে কোন উপায়ে সেই দুর্গম পথে তিব্বত ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন ১৮৭৮ সালে। বৃটিশ সরকার তাঁকে প্রাথমিকভাবে নিরুৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে বিশেষ পদ্ধতিতে অনুমতি দেয় যদি তিনি নিজ দায়িত্বে যেতে পারেন। শরতবাবু তাঁর তিব্বতী সহকারীর মাধ্যমে তিব্বতের উচ্চপর্যায়ের একটা অনুমতি পত্র সংগ্রহ করে আনেন। সেই অনুমতিপত্র দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে দুর্গম পর্বতমালা পেরিয়ে তিব্বতে পৌঁছান এবং ছয় মাস অবস্থান করেন। তবে ফিরে আসার আগে আবারও তিব্বত ভ্রমণের অনুমতিও নিয়ে আসেন। (এটাও পরিকল্পিত হবার সম্ভাবনা)

তাঁর এই সফলতা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, কেননা তখনো আর কোন ভারতীয় বা ইউরোপীয় এতটা বিশ্বাস নিয়ে তিব্বতী কতৃপক্ষের কাছে স্থান পায়নি। ফলে দ্বিতীয় যাত্রার মধ্যে বৃটিশ সরকার তাঁর অভিযানের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িত হয়ে যায়। এবারে তার ভ্রমণ প্রস্তুতি এবং সরকারী নির্দেশাবলী দেখে খুব পরিষ্কার বোঝা যায় ইংরেজ সরকার তাঁকে তিব্বত সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য এসপিওনাজ এজেণ্ট হিসেবে নিয়োগ করেছে।

দ্বিতীয় যাত্রায় তিনি খোদ রাজধানী লাসায় পৌঁছে প্রধান লামার আতিথ্য গ্রহন করেন। এবার তাঁর মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকার মানচিত্র, পথনির্দেশ এবং নানান স্থাপনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা (যে তথ্য দিয়ে আরো কয়েক বছর পর তিব্বতে অভিযান চালিয়েছিল বৃটিশ সরকার)। তিনি লাসায় প্রায় অন্তরীণ থেকে তিব্বতী ভাষা সংস্কৃতি অধ্যয়নের পাশাপাশি বৃটিশ সরকার নির্দেশিত কর্মসমূহ সম্পাদন করতে থাকেন।

কয়েক মাস পর লাসায় এক দুরারোগ্য মহামারী ছড়িয়ে পড়লে তিনি এক রাতে লাসা ছেড়ে ভারতের পথে পাড়ি জমান। তিনি লাসা ত্যাগের কয়েকদিন পরেই তিব্বতী কতৃপক্ষ কোন ভাবে তাঁর মিশন সম্পর্কে জেনে যায় এবং তাঁকে আটক করার জন্য সীমান্তে পরোয়ানা পাঠায়। কিন্তু তার আগেই তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে দার্জিলিং পৌঁছে যান। পরে লাসায় তাঁকে আশ্রয় দানকারী প্রধান লামা এবং আরো অনেক তিব্বতীকে কঠিন শাস্তি এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বরণ করতে হয়।

শরতচন্দ্র দাসের এই অভিযান যত না তাঁর ব্যক্তিগত অর্জনের সাফল্য তার চেয়ে বেশী ছিল বৃটিশ সরকারের ভবিষ্যত এক সামরিক রাজনৈতিক সাফল্যের সুত্রপাত। অভিযানের পুরস্কার হিসেবে তাঁকে ভিক্টোরিয়ার প্রাসাদ থেকে ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক C.I.E. তে ভুষিত করা হয় এবং রায় বাহাদুর খেতাব দেয়া হয়। চট্টগ্রাম শহরে বিশাল একটা এলাকা দান করা হয় যেখানে তিনি একটি দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই দেবমন্দিরের সুত্রে এলাকাটির নাম হয়েছে দেবপাহাড়। চট্টগ্রাম কলেজের উল্টোদিকে দেবপাহাড় আমাদের অনেকেরই খুব পরিচিত।

শরতচন্দ্র দাস ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষে কাজ করে তিব্বতীদের কাছে ঘৃণার আসনে অধিষ্ঠিত হলেও বাকী বিশ্বে তাঁর মূল অবদান হলো জ্ঞানার্জনে। তিনি তিব্বত থেকে দুর্লভ অনেক পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি সংগ্রহ করেন, গবেষণা করেন, ঐতিহাসিক অনেক উপাত্ত উপস্থাপন করেন এবং তা দিয়ে মূল্যবান কিছু বই রচনা করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো তিব্বত ইংলিশ ডিকশেনারী তৈরী করা, যা এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বে সমাদৃত। তাঁর লেখা একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শতকে রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি সহ বিশ্বখ্যাত প্রকাশনী থেকে। এখনো তাঁর বই ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর বুকশেলফে খুঁজে পাওয়া যাবে। তাঁর তিব্বত অভিযান নিয়ে লেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইটির নাম Journey to Lhasa and Central Tibet. বইটি ১৮৮৫ সালে মুদ্রিত হলেও বৃটিশ সরকার রাজনৈতিক গোপনীয়তার জন্য বইটির প্রকাশ কয়েক বছর বন্ধ রেখেছিল।

শরতচন্দ্র দাস তিব্বতের রাজনৈতিক স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করলেও তিব্বতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আমৃত্যু যে বহাল ছিল তা তাঁর আত্মজীবনী এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার। তিনি তাঁর দার্জিলিং এর বাড়ির নাম রেখেছিলেন লাসা ভিলা। তাঁর সেই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহন করেছেন অনেক বিশ্বখ্যাত মানুষ। যার একজনের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার।

জাপানের বৌদ্ধ মংক Ekai Kawaguchi কাওয়াগুচি হলেন জাপানের প্রথম তিব্বত ভ্রমণকারী এবং প্রধান তিব্বত বিশেষজ্ঞ। এই কাওয়াগুচির গুরু ছিলেন শরতচন্দ্র দাস। তিনি জাপান থেকে তিব্বত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে কোলকাতা হয়ে দার্জিলিং এ শরতচন্দ্রের আতিথ্য এবং শিষ্যত্ব অর্জন করেন। শরতচন্দ্রের পরামর্শ নিয়ে তিনি তিব্বত ভ্রমণে যান এবং তিন বছর অবস্থান করেন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। সেইসব অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত Three Years in Tibet বইটির শুরু হয় গুরু শরতচন্দ্র দাসের ছবি ও তাঁর বিবরণ দিয়ে।

শরতচন্দ্র দাসের কর্ম ও জীবন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচুর গবেষণা করার অবকাশ আছে। চট্টগ্রামের কেউ হয়তো করবে সেই কাজটা। শরতচন্দ্রের কথা বলতে গেলে তাঁর একজন ভাইয়ের কথাও বলতে হয় যিনি এই অভিযানের কিছু অংশের সাক্ষী ছিলেন এবং তাঁর অভিযান সংক্রান্ত বই সম্পাদনা করেছিলেন। তাঁর নাম নবীনচন্দ্র দাস। তিনিও মোটামুটি সুপরিচিত একজন কবি ছিলেন।

এবং একটি কাকতাল। ভুলে যাওয়া শতবর্ষ আগের শরতচন্দ্র দাসকে নিয়ে এই সারসংক্ষেপটুকু লেখার শেষ সময়ে কাকতালীয় ঘটনাটি ঘটে। তাঁর সম্পর্কে আরো সাম্প্রতিকতম কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা দেখতে গিয়ে চোখ আটকে গেল নিউইয়র্ক টাইমসের গত ২০ মার্চ ২০১৬ সংখ্যার একটি শিরোনামে The Indian Spy Who Fell for Tibet.

হ্যাঁ এই Indian Spy হলেন আমার বর্তমান আলোচনার চাটগাইয়া জেমস বণ্ড শরত চন্দ্র দাস। তাঁকে চট্টগ্রামবাসী ভুলে গেলেও পাশ্চাত্য যে ভোলেনি তার প্রমাণ নিউইয়র্ক টাইমসের এই ফিচারটি। ফিচারটির লিংক মন্তব্যে জুড়ে দেয়া হবে।

তথ্যসুত্র-
- Autobigraphy Incident of my early life - Sarat Chandra Das
- Journey to Lhasa and Central Tibet - Sarat Chandra Das
- Bengali Pundits in Himalaya - Sarat Chandra Das
- উইকিপিডিয়া
- বাংলাপিডিয়া
- NY Times 20 March 2016
- Journal of Asiatic Society