"সময়টা একদিন আমারও
আসবে। সেই চিরচেনা দুঃসময়। যদি বেঁচে থাকি। তাঁদের মতো সফল আমি হবো না। যদিও বর্তমান
দেখে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হবে আমি তাঁদের চেয়েও সফল মানুষ।
তাঁরা তাঁদের কাজ ঠিকভাবেই
শেষ করেছেন। সবগুলো সন্তানকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে জীবিকার সন্ধান দিয়ে বৈবাহিক দায়িত্ব
পর্যন্ত সম্পন্ন করেছেন। তারা সমাজের শ্রেষ্ঠ কেউ নন, কিন্তু সন্তান পালন পরিবর্ধনে
সফল মানুষ সর্বাংশেই। অবসরে প্রাপ্ত অর্থের সাথে কিছু ঋন যোগ করে দোতলা একটি বাড়ি করে
সেই বাড়িতেই এখন বসবাস। নীচতলার অংশটি ভাড়া দিয়ে তাঁরা দোতলায়। একজন ৬৫ আরেকজন ৫৮।
বর্ননা শুনে এই বয়স্ক দম্পতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হবার কথা। কিন্তু 'শুনে'
আমরা যতটা সুখী, তারা 'হয়ে' ততটা সুখী নন।
সুখী নন তাদের বয়স বেড়ে
গেছে বলে, শরীর অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে বলে, একই সাথে আয়ের উৎস ক্ষুদ্র হয়ে গেছে, আর্থিক
সঙ্গতিতে পড়েছে টান, বেড়েছে সন্তানের উপর নির্ভরতা। তাঁরা দুজন সব দায়িত্বের সাথে সমস্ত
বাজেটও শেষ করে ফেলেছেন সন্তানদের ভবিষ্যত গড়তে। তাদের হাতে আর কোন আর্থিক সংঙ্গতি
নেই। দুই চাকরীজীবি পুত্র সংসার নিয়ে তাঁদের সাথে আছে সত্য। ঘরভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ
আর সন্তানদ্বয়ের প্রদত্ত ভাতা দিয়ে সংসারের বাজার খরচ সুন্দর চলে যায় এও সত্য। কিন্তু
সবটা নয়। বাড়ি ভাড়া আর সন্তানদের দেয়া টাকা দিয়ে বাজার খরচ চললেও স্ত্রীর চিকিৎসার
খরচ চলে না, ওষুধের বাজেট কুলোয় না। সফল অবসর তাঁর কাছে বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। অবসরের সংজ্ঞা
বদলে গেছে এখন। অবসর মানে আয় নেই, এক গাদা খরচ। অবসর মানে ডাক্তার আর এক গাদা অসুখ।
অবসর মানে মাসে মাসে বেড়ে যাওয়া ওষুধের লিষ্টি, অবসর মানে সীমাহীন অসহায় দিনযাপন।
আফজালুর রহমান আর আয়েশা
আক্তারের অবসর জীবন এখন আয়ু ফুরোনোর প্রতীক্ষায় কাটানো দুঃসহনীয় সময়।
কিন্তু আমার তো এখনো অনেক
পথ বাকী। জীবিকার বয়স ২০ বছর হয়ে গেলেও জীবনে মাত্র যাত্রা শুরু করেছি। আমার সন্তানেরা
বয়সে এখনো অনেক কনিষ্ঠ। সন্তান তুলনায় বাবার চেয়ে কমপক্ষে ৭ বছর পিছিয়ে আছি। আমার ৪৬
বছর বয়সে আমার সন্তান ক্লাস টুতে পড়ছে, আর বাবার ওই বয়সে আমি ক্লাস নাইনে। তারো ১৫
বছর পর বাবা পৃথিবী ছেড়েছেন, তখন আমি মাষ্টার্স শেষ করে চাকরীজীবন শুরু করে দিয়েছি।
যদি সবকিছু ঠিক থাকে, যদি
আরো পনের বছর টিকে যাই তাহলে আমার পুত্র-কন্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, কিন্তু আমার কোন
কাজই সমাপ্ত হবে না। আমার জীবিকা ততদিন অক্ষুন্ন থাকবে না, আমি সামান্য সঞ্চয়ের অর্থ
নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার চেষ্টা করবো। আমাদের হাতে বেশী সময় নেই। এখন আমি এই বয়সেই
আশংকিত থাকি যে কোন সময় চলে যাবার। বেঁচে থাকাটাই যখন দুর্ঘটনা, স্ট্রোক করাটা মুহুর্তের
ব্যাপার। জীবিকার চেয়েও জীবনের সংকট অনেক বেশী। মাঝে মাঝে বর্তমান জীবিকা ত্যাগ করতে
চাইছি একটু শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য। কিন্তু কাংখিত ওই শান্তির জীবন তো আসলে ইউটোপিয়া।
কেউ কি তার দেখা পেয়েছে? কেউ কি পেরেছে ভবিষ্যত ছুঁতে? এমনকি চরম সফল মানুষটিও অতৃপ্তি
নিয়ে থাকে কোথাও কোথাও। আমি তাই চরম অসফল মানুষ হয়েও মাঝে মাঝে নিজেকে কাল্পনিক তৃপ্তির
সমুদ্রে আবিষ্কার করে চমৎকৃত হতে চাই।
জীবিত মানুষদের অনেক সমস্যা
যদি তিনি বয়স্ক হন, যদি তিনি অসুস্থ হন, যদি তাঁর আর্থিক সামর্থ্য শেষ হয়ে যায়। যখন
ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে খুব বেশী মনোযোগ পান না। যাদের মানুষ করতে গিয়ে তাঁরা গলদঘর্ম
হয়েছিলেন, তারা এখন ভীষণ ব্যস্ত। তাদের ছেলেমেয়েদের সমস্যা নিয়ে অধিক পীড়িত। যাদেরকে
তাঁরা দৈনিক মনোযোগ দিয়ে গড়ে তুলেছেন, তারা এখন তাঁদের দিকে সাপ্তাহিক বা মাসিক মনোযোগও
দিতে পারে না। এর চেয়ে মর্মান্তিক বাস্তবতা আর কি আছে?
কিন্তু পৃথিবীতে এটাই সত্য,
এই বাস্তবতাই মানুষের নিত্য সঙ্গী। বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক বেশী কঠিন রকমের সত্য।
বুড়োকালে আরাম করার জন্য মানুষের কত কি ব্যবস্থা করতে দেখা যায় বয়সকালে। কিন্তু সেই
আরাম, সেই স্বাচ্ছন্দ্য কখনোই ফিরে আসে না। শক্তি সামর্থ্য আর্থিক স্বচ্ছলতার দিন যৌবনের
শক্তিকালেই শেষ। আসলে ৪৫ বছরের পর বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশী দিন সুখের সময় হাতে পায়
না। সুখগুলো সব তখন স্মৃতিতে আশ্রয় গ্রহন করে চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে যায়। বুকের
খাঁচায় না হওয়া গানের স্বরলিপি। বেঁচে থাকাটা তখন এক অপ্রিয় বাস্তবতা।"
চুপচাপ ভাবতে ভাবতেই চা
শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নেহাল উঠে দাঁড়ালো। এই বাড়িতে এলেই তার মন খারাপ হয়ে
যায়। কিন্তু আসতেই হয়। আফজাল সাহেব তাদের কোম্পানীর কাছ থেকে কিছু ঋন নিয়েছিল। সেটার
কিছু কাজ ছিল। ভদ্রলোককে ভালো লাগে। দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে। সেই কারণেই নিজে এসে
অনেক কাজ করে দিয়ে যায়। অন্য কোন ক্লায়েন্টকে এই সার্ভিস দেয় না সে। আবারো আসবো।
বিদায় নিয়ে রাস্তায় নামলো
সে। রাস্তায় আজ খুব গরম। রোদে চোখ ঝলসে যায়। বিকেল হয়ে আসছে তবুও তেজ কমেনি। অফিসে
ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বাসার দিকে চলে গেলে রিকশায় দশ টাকা লাগবে। বাসায় আজ বাজার লাগবে?
মুনিয়ার জন্য রং পেন্সিলের একটা সেট কিনতে হবে। মনে থাকলেই হয়। আজকাল ভুলোমনা হয়ে উঠেছে
সে সবকিছুতে। অফিসে ঢুকলে রাত আটটার আগে বের হওয়া যাবে না ভাবতেই ক্লান্তি লাগে। সারাদিন
বাইরের কাজ সেরে বিকেলে যখন অফিসের দিকে যায় দুনিয়ার লোক তখন বাড়ি ফিরছে।
উপায় নেই। অফিসের দিকে
রওনা দিল নেহাল। টেক্সিতে উঠে মোবাইল থেকে ফোন দিল বাসায়। নেটওয়ার্ক বিজি। আবারো ফোন
দিল, কেউ ধরছে না। ঘুমাচ্ছে মনে হয়। থাক পরে করবো ভেবে ফোন রেখে দিল পকেটে।
টেক্সি তখন বিশ্বরোড ছাড়িয়ে
কাস্টম হাউসের কাছাকাছি। ব্রীজে এখন তীব্র যানজট। ট্রলি আর কন্টেনারে সয়লাব। টেক্সি
ড্রাইভারও বিরক্ত। এদিকে ভাড়া নিতে চায় না এসময়ে কেউ। সে জোরে একটা টান মেরে হঠাৎ ব্রেক
কষলো, এত জোরে কষলো যে নেহাল ঝাঁকি খেয়ে টেক্সির লোহার গ্রিলে প্রচণ্ড বাড়ি খেল মাথায়।
এরপর মড়াৎ করে একটা শব্দ কানে এলো পেছন থেকে। টেক্সির অর্ধেকের উপর দিয়ে একটা ট্রাকের
চাকা উঠে গেল। তারপর নেহালের আর কিছু মনে নেই।
ভয়ংকর ঘটনার পরও কী করে
যেন নেহাল বেঁচে গেল। কিভাবে বেঁচে গেল দুমড়ে মুচড়ে যাবার পরও, এটা এখনো অবিশ্বাস্য
লাগে। দুমাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর চাকরীটাও বহাল থাকতে দেখলো। এটাকেই কি
ভাগ্য বলে?
কিন্তু কিছুদিন, আরো কয়েকমাস
পর নেহাল মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করলো। সে মাঝে মাঝেই ভুলে যাচ্ছে। লোকজনকে হঠাৎ
অচেনা মনে হচ্ছে। একদিন খোদ অফিসের বড়কর্তাকে চিনতে পারলো না। কাজকর্ম ঠিক থাকলেও মানুষকে
নিয়ে তার বিচিত্র আচরণ। বন্ধুবান্ধব কেউ ফোন করলে অনেক পরিচয় দেবার পর চেনে। একদিন
চেনে, পরদিন হয়তো আবার ভুলে বসে। দীর্ঘদিন দেখেনি এমন আত্মীয় স্বজনের ক্ষেত্রেও তাই
হচ্ছে। স্ত্রী সন্তান ছাড়া আর কাউকে ঠিকমতো
চিনতে পারছে না। আবারো ডাক্তার। আবারো চিকিৎসা। কিছুই হলো না। চাকরীটাও ছাড়তেই হলো
এককালীন কিছু টাকা নিয়ে। এমন লোককে কাজে বহাল রাখবে কে? গুরুত্বপূর্ণ পদে তো অসম্ভব।
চাকরী ছাড়ার পর পরিবারের
আর্থিক অবস্থার কী হলো সেটা খুব সহজে অনুমেয়, সেই দুর্দশার কথা নাই বলি আর। কিন্তু
আশ্চর্যজনকভাবে নেহাল ও তার পরিবার আবিষ্কার করলো যে তার স্মৃতিভ্রষ্টতা এখন আত্মীয়
বন্ধুদের মধ্যেও মহামারী আকারে ছড়িয়ে গেছে। ওকে কেউ চিনতে পারছে না আগের মতো। ফোন করলে
ধরছে না সবাই। ধরলেও পরিচয়ঘটিত সমস্যায় কথা বলা যাচ্ছে না। ঠিক যেমন সে তাদের চিনতে
পারতো না কয়েক মাস আগে।
স্মৃতিভ্রষ্টতা যে একটা
ছোঁয়াচে রোগ সেটা বুঝতে নেহাল ও তার পরিবারের অনেক সময় লেগে গেল।