সতেরো বছর আগে সোফিয়াকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন সে ঘুমন্ত মায়ের পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার সারাহ রেস্তোঁরার পাশে অগ্রণী ব্যাংকের বন্ধ কলাপসিবলের সামনের ছায়াটুকুতে মা মেয়ের অস্থায়ী নিবাস। আর ঠিক সেই জায়গায় আমার অফিসের গাড়ি থামতো। সকাল সাতটায় প্রতিদিন অফিস যাবার সময় আমাদের দেখা হতো। অমন সুন্দর শিশু আমি এই শহরে আর একটিও দেখিনি। সবুজ চোখের সোনালী কোকড়া চুলের দুধে আলতা বর্ণের শিশুটি আমার দেখা আর দশটি পথশিশুর চেয়ে একদম আলাদা। এক ফুটপাতচারিনীর কোলে অমন দেবশিশুকে কেমন বেমানান দেখাতো। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম মেয়েটার বাবা কে? বাবা কি বিদেশী কেউ? এত মায়াময় একটি শিশুকে দেখে যে কারো আদর করতে ইচ্ছে করবে। আমারো করতো। কিন্তু সেই ইচ্ছে পর্যন্তই। আমি প্রতিদিন শিশুটিকে দেখতাম আর ভাবতাম যদি একটি ভালো পরিবারে বড় হতো মেয়েটি নিঃসন্দেহে সুন্দর একটি জীবন পেতো। শিশুটি যদি ইউরোপে জন্মাতো তাকে সবাই সোফিয়া লোরেন বলে ভুল করতো। তখন থেকে মনে মনে ওকে আমি সোফিয়া বলে ডাকতে শুরু করি।
জীবন চলতে থাকে। প্রতিদিন আমি অফিসে যাই নিয়ম করে। দিন মাস বছর কাটে। আমাদের চাকরীতে প্রমোশন হয়, বেতন বাড়ে, সুযোগ সুবিধা বাড়ে। আমরা ক্লাবে যাই, পার্টিতে যাই, দেশ বিদেশ ঘুরতে যাই। আমাদের চাকচিক্য উর্ধ্ব গগনে পাখা মেলে। সোফিয়াও সময়ের সাথে সাথে বড় হতে থাকে। হামাগুড়ি শেষে একদিন দাঁড়াতে শেখে, গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শেখে, নিজে নিজে মুখে খাবার তুলে নিতে শেখে। কিন্তু তার ঠিকানা বদল হয় না। হয়তো আজ অগ্রণী ব্যাংকের বারান্দা, কাল সোনালী ব্যাংক, পরশু রূপালীর ফুটপাতে। ঘুরে ফিরে আগ্রাবাদের সেই ব্যাংক পাড়াতেই বড় হতে থাকে সোফিয়া। অনেকটা আমার চোখের সামনেই, প্রায় প্রতিদিন এক ঝলক দেখতাম ওদের। যেন আমি দীর্ঘ মেয়াদী এক নির্বাক সিনেমার দর্শক।
আমি ওদের কিছুই জানি না, শুধু সোফিয়ার বড় হওয়া দেখতে থাকি। আরো পাঁচ বছর পর্যন্ত সোফিয়ার নিটোল শিশু সৌন্দর্য প্রায় অটুট থাকে। কখনো তার মাকে সাথে দেখি, কখনো সে একা। তাকে রেখে মা কোথাও কাজ করতে যায়? জানি না ঠিক। একদিন হয়তো সেই মা কোথাও হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় বলেছি- কেননা, আমি দেখি সোফিয়া একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।
একদিন সোফিয়া আমার সামনে এসে হাত পাতে। আমি কয়েক সেকেণ্ড নির্বাক তাকিয়ে থাকি শিশুটির দিকে। কেমন একটা কষ্ট হতে থাকে। পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে ওর হাতে দেই। এরপর থেকে সোফিয়া প্রায়ই এসে সামনে দাঁড়ায়, আমি একটা কয়েন বা ছোট নোট দিয়ে দায় সারি। সোফিয়ার জন্য কিছু করতে না পাড়ার অক্ষমতা আমাকে পোড়ায়। আবার বাসায় গিয়ে সাহস করে বলতে পারি না, ওই শিশুটিকে আমাদের সাথে রেখে মানুষ করলে কেমন হয়। তাছাড়া আমি ওসব বলার কে? সোফিয়ার মা কোথায় জানি না, কার কাছে ওকে চেয়ে নেবো? তাছাড়া চাইলেই কি দেবে ওকে? আর নিলেই কি আমার পরিবার জায়গা দেবে? হয়তো দিত, হয়তো দিত না। কিন্তু যাচাই করাই তো হয়নি।
কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। সোফিয়াকে প্রতিদিন দেখি না আজকাল। মাঝে মাঝে দেখি, মাঝে মাঝে দেখি না। যখনই দেখি, সময়ের নিষ্ঠুর আঘাতে ক্ষয়ে যেতে থাকে সোফিয়ার সৌন্দর্য। আস্তে আস্তে তার সবুজ চোখে ছাই জমতে থাকে, কমতে থাকে উজ্জ্বলতা, চুলের সোনালী রঙ ফ্যাকাশে বাদামী হতে থাকে, মুখের চামড়ায় ময়লার আস্তরণ, রুক্ষতা দেখা দেয় চাহনীতে। আমি ভেতরে ভেতরে কেমন আহত হতে থাকি। অমন একটা শিশুকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা নিজের ভেতর খচ খচ করতে থাকে।
তিন কি চার বছর পরে একদিন অফিসের গাড়িতে ওঠার সময় একটু দূরেই সারাহ রেস্তোঁরার সাইনবোর্ড পিলারের সাথে হেলান দেয়া বেঢপ পেট ফুলে থাকা ক্লান্ত এক কিশোরীকে দেখে চমকে উঠলাম। মেয়েটার বয়স দশ বছর পেরিয়েছে কি? এত বড় পেট কেন ওর? এখনো বয়ঃসন্ধিকাল আসেনি মেয়েটার। অতটুকুন বাচ্চাকে কোনো অমানুষ গর্ভবতী করে ভেগে গেছে? হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মেয়েটা সোফিয়া। চোখ দুটো ঝাপসাই থাকে অফিসের বাকী পথটুকু যেতে।
বছরখানেক পর অগ্রণী ব্যাংকের ওই বারান্দাতেই দেখি সোফিয়া তার মায়ের জায়গাটাতে শুয়ে আছে, পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটি শিশু। অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য। সে নিজেই এখনো একটা শিশু। তার কোলে আরেকটি শিশু? শিশুপালনের কী জানে অতটুকুন মেয়েটি? এত ছোট্ট কিশোরী মা আমি এর আগে কখনো দেখিনি। গত কয়েক বছর সোফিয়া হাত পেতে দাঁড়ায়নি কখনো। এখন হয়তো তাকে শরীর বিক্রি করে জীবন ধারণ করতে হয়। কিরকম একটা অসভ্য সমাজের অযোগ্য বাসিন্দা আমরা!
আর দশটা ভদ্রলোকের মতো আমিও শরীর থেকে ময়লা ঝেড়ে সাবধানে থাকি। উর্বর যত ভাবনা মনে মনেই ভাবি, বাস্তবায়নের ধারে কাছেও যাই না। বড়জোর মনে মনেই মানবিকতার গল্প সাজাই, দু চারটে লিখি এখানে সেখানে। সোফিয়াকে নিয়ে আমার আদ্র করুণা ফিকে হতে থাকে। আমি প্রায় ভুলেই যাই ওকে। সোফিয়াকে নিয়ে না ভাবলে কারো কিচ্ছু আসে যায় না। এমনকি সোফিয়ারও না।
ফিরে আসি বর্তমানে।
ব্যাংকে গিয়েছিলাম আজ দুপুরে। কাজ সেরে একটা সিএনজি টেক্সি নিয়ে ফেরার পথে বাদামতলী মোড়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। প্রচণ্ড গরমে ভাপ উঠছে রাস্তা থেকে। ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে দিলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুক লাইটে লগইন করে দেখছিলাম নতুন কোন নোটিফিকেশান আছে কিনা। হ্যাঁ মেসেজটার জবাব এসেছে। এত জলদি আসবে ভাবিনি। বাসায় ফিরে লিখবো পরে। নেট অফ করে মোবাইল পকেটে রাখতে না রাখতেই সিএনজির লৌহবেষ্টনির বাইরে থেকে হাত বাড়ালো উস্কোখুস্কো একটা মানুষ। মলিন বিধ্বস্ত কালসিটে চেহারার এক মহিলা। অভাবে অনাহারে ক্ষুধায় যন্ত্রণায় মহিলার চেহারা অমানবিক রূপ নিয়েছে। চেহারা শরীর এতটাই ভগ্ন বিধ্বস্ত যে দেখে মনে হবে ষাট সত্তরের কোন বৃদ্ধা। শেষ বয়সে যখন মানুষ সব হারিয়ে যখন মৃত্যুর প্রহর গোণে তখন এরকমই হয়।
আর দশজন লোক তাই ভাববে। কিন্তু এই মানুষটি আমার চেনা। এই মেয়েটার কোকড়া খয়েরী চুল আমার চোখে খুবই পরিচিত। আমি জানি এটা সোফিয়া। যার বয়স এখনো আঠারো হয়নি। আঠারো হবার আগেই মেয়েটা যেন সত্তর বছরের দুঃসহ জীবনপথ পাড়ি দিয়ে এখন মৃত্যুর মুখোমুখি।
তাড়া দিল মহিলা। হাতে সময় নেই, আমি না দিলে অন্য গাড়িতে যেতে হবে। আমি তড়িঘড়ি পকেট হাতড়ে কিছু খুচরো টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ভদ্রলোকের মতো বসে রইলাম। বুঝতেও দিলাম না ওকে আমি কত বছর ধরে চিনি। দুঃসময়ে চেনা মানুষই অচেনা হয়ে যায়- এ তো রাস্তার একটা মেয়ে মাত্র। তবে হ্যাঁ এরকম জীবন নিয়ে গল্প লেখা নেহাত খারাপ হবে না। ওকে নিয়ে একটা গল্পতো লেখা যায়। গল্পের শুরুটা হবে- "সতেরো বছর আগে সোফিয়াকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন সে ঘুমন্ত মায়ের পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছিল...."
সোফিয়াদের নিয়ে মর্মান্তিক গল্প লেখা সম্ভব হলেও কখনো বলা হয় না – এতদিন কোথায় ছিলেন? সোফিয়ারা জানে না ভদ্রলোকেরা ওদের দারিদ্র নিয়ে কত বেসাতি করে।
৩১ মে ২০১৫