২০১৫ সালে আমি একটি নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। নতুন জীবনটা কেমন হবে এখনো জানি না। তবু পুরোনো জীবন আর নতুন জীবনের সন্ধিক্ষণটা কোন জনবিরল স্থানে কাটাতে চেয়েছিলাম। পুরোনোকে ছেড়ে আসা সহজ কাজ নয়। কিন্তু কি করে যেন আমি খুব সহজেই ছেড়ে আসতে পারলাম পুরোনোকে, কোন রকম ভাবাবেগে আপ্লুত না হয়েই।
২০ বছরের একটা জীবন। হয়তো জীবিকা বলেই পেরেছি, মানুষ হলে পারতাম না। মানুষকে ছেড়ে আসা কঠিন। মানুষ খুব টেনে রাখে। এমনকি যে মানুষ কষ্ট দেয় সেও। যদি ওখানে এমন কেউ থাকতো যার সাথে আমার দীর্ঘসময়ের সখ্য, তাহলেও কষ্ট হতো। কিন্তু কেন যেন আমার নতুন কোন সখ্য গড়ে ওঠে না কারো সাথেই। আমি পুরোনো বন্ধুদের নিয়েই পথ চলি। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে সেটার লেনদেন নগদেই শেষ। তার কোন জের থাকে না। আমি কোথাও ভ্রমণের চিন্তা করলে সেখানেও পুরোনো বন্ধুদের নিয়ে যেতে চাই। আমার শ্রেষ্ঠ ভ্রমণগুলো বন্ধুদের সাথেই।
তবে এই প্রথম আমি সমগ্র পরিবারকে নিয়ে একটা দূরবর্তী ভ্রমণের আয়োজন করলাম এবং সফল হলাম। আমার পারিবারিক ভ্রমণগুলোর মধ্যে এটাই শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকবে বহুকাল। জায়গাটা ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম তেমন। কক্সবাজার আমার ভালো লাগে না জনবহুল হবার পর থেকে। এই জায়গাটা কক্সবাজার সৈকত থেকে আরো ১০ মাইল দূরে, হিমছড়ি ছাড়িয়ে পেঁচার দ্বীপ নামক জায়গার কাছে। সমুদ্র আর পাহাড় যেখানে জড়াজড়ি করে আছে সেই নির্জনে একটা জনবিরল রিসোর্ট 'সাম্পান কাফে'।
প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল সবার। দোতলা সবুজ টালির একটা বাড়িতে ছিমছাম কয়েকটি ঘর। ঘরের সামনে একফালি উঠোন, উঠোনে নানা জাতের গাছ লাগানো, উঠোনের ওপাশে একটা ত্রিতলকাঁচঘেরা রেস্তোঁরা, রেস্তোরায় বসে দূরে আদিগন্ত সমুদ্রীমা, রেস্তোরার সামনে সাজানো সবুজ বাগান, বাগানে চেয়ার পাতা। চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্রের ঢেউ গোনা যায়। সেই বাগানের সামনে দিয়ে চলে গেছে মেরিন ড্রাইভ, সরু মেরিন ড্রাইভে মাঝে মাঝে হুশহাশ ছুটে যাচ্ছে সৌখিন পর্যটকদের গাড়ি কিংবা টমটম।
রাস্তার ওপাশে কংক্রিটের বিশাল চত্বর, সেই চত্বরে চেয়ার পাতা, চেয়ারের গোলাকার সারির মধ্যিখানে বিশাল কাপড়ের ছাতা। এটাও সাম্পানের দেয়া। এখানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা বসে সামনের সমুদ্র উপভোগ করা যায়। বিকেলে পৌছে সবাই ছাতার নীচে বসলাম গোল হয়ে। সমুদ্র দেখতে দেখতে পেছন ফিরতেই দেখলাম একখানা একাদশীর চাঁদ উঠেছে রিসোর্টের পেছনের পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে। অপূর্ব সেই দৃশ্য। আশেপাশে কোন লোকালয় নেই কয়েক মাইলের মধ্যে। সন্ধ্যের পর গা ছমছম নির্জনতা। কিন্তু সেই নির্জনতায় ভয় নেই, আছে উপভোগের মাধুর্য। আমি প্রথমদিন থেকেই এই নির্জনতার ভেতর নিজেকে নির্বাসিত করলাম। পরবর্তী দুই দিন সেই নির্জন সৈকতে কাটিয়ে ফিরে এলাম। সেই সময়কালের মধ্যেও আরো নির্জন কিছু সময় কাটিয়েছি সন্ধ্যের পর। এখন একদম একা। সামনে আদিগন্ত সমুদ্রের দূরবর্তী গর্জন, পেছনে অন্ধকার পাহাড়ের মাথায় জেগে থাকা অপার্থিব চাঁদ আর মধ্যিখানে আমি। নিজেকে খুঁজে পাবার জন্য কেন মানুষ নির্জনতা খোঁজে সেটি আরো একবার অনুভব করলাম। এবং আমি নিজেকে পেলাম। মিথ্যে খোলস ঝেড়ে অকপট 'আমি'কে।
1 comment:
এখন অখাদ্য হলেও যেদিন আমিও যাব এবং নিরজনতাকে নাকের সামনে দেখব সেদিন লিখা হবে খাদ্য
Post a Comment