সংকটকালে বাংলাদেশে বরাবরই একটা তৃতীয় শক্তির প্রয়োজন অনুভুত হয়েছে। একাধিকবার তৃতীয় শক্তির উত্থানও ঘটেছে। কিন্তু কোন তৃতীয় শক্তিই জনগনের শক্তি হয়ে আসেনি। এসেছে কারো না কারো হাতিয়ার হয়ে। গত ১/১১ সরকারকেও প্রথমে ভাবা হয়েছিল জনগনের পক্ষের শক্তি। খোদ আওয়ামীলীগ স্বাগত জানিয়েছিল এই শক্তিকে। কিন্তু বাজারে মাইনাস টু চালু হবার পর আওয়ামীলীগের মোহভঙ্গ হয়। বিএনপি অধিকতর হতাশ ছিল, কারণ ১/১১ সরকারে হাতে তাদের বন্দী নেতাকর্মীদের সংখ্যায় অধিক।
এবার বিএনপিও সম্ভবতঃ চায় আরেকটা তৃতীয় শক্তির উত্থান। গত ১/১১ ছিল মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের তৃতীয় শক্তি, বিএনপির ধারণা তারাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ে সহায়তা করেছে। তাই বিএনপি জোটের আশা যদি আওয়ামীলীগ নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করে এবার বিপরীত ধারার একটা তৃতীয় শক্তির আগমন ঘটুক। তাতে তারা আবারো ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি ধারণার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সাধারন মানুষ মাত্রেই এই দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির উপর বিরক্ত। এমনকি কিছু কিছু বিএনপি আওয়ামী সমর্থকেরাও চায় বিকল্প কোন একটা শক্তির হাতে ক্ষমতা চলে যাক। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য তেমন কোন শক্তিমান দল আমাদের নেই। তবে যারা তৃতীয় শক্তি হিসেবে জামাত বা এরশাদের মতো সামরিক লম্পটের কথা ভাবেন তারা হয় নির্বোধ অথবা মতলববাজ।
অনুমান করি- বাংলাদেশের কমপক্ষে ৮০% মানুষ কায়ক্লেশে মানুষের জীবন যাপন করেন। নিন্মমধ্যবিত্ত থেকে চরম দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া এদের হিসেবেই আনে না কেউ।
বাকী ২০% মানুষ শহুরে বা আধা শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়, মাথা ফাটায়। উজবুক ধনী থেকে পরম সহনশীল সুশীল বুদ্ধিজীবি পর্যন্ত সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। এই অংশের সাথেই রাজনীতির লেনদেন, ক্ষমতার পালাবদলের নাট্যকারেরা এদেরকে দিয়েই মঞ্চ সাজায়। রাজনীতির কুশীলবরা সব এই অংশ থেকে উত্থিত। রাজনীতির প্রথম দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শক্তি নিয়ে যত মাথাব্যথা সব এই অংশেরই। দেশ রাজনীতি নিয়ে চিৎকার করার ক্ষমতাও আছে এই ২০ ভাগের। বাকী ৮০ ভাগ মানুষ কন্ঠহীন নীরব ভোটার। ওরা বিকল্প শক্তি বোঝে না, বিকল্প শক্তি ওদের খোঁজে না। ওরা যেন একই দেশের ভিন্ন নাগরিক। ওদের ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে রাজনৈতিক সুবচনে। ওদের কল্যাণের অজুহাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য মুখিয়ে থাকে ক্ষমতালোভী অপশক্তি।
এ যাবতকালে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি প্রতিনিধিত্ব করেছে ২০ ভাগ মানুষের। ফলে রাজনীতি ঘুরেফিরে একই পাঁকে আটকে আছে। আমরা গত ৩৮ বছরে কোন পরিবর্তনই দেখিনি রাষ্ট্র এবং জনগনের মধ্যেকার সম্পর্কে। স্বৈরাচার এরশাদ যে ভাষায় মানুষের সাথে কথা বলেছে, গণতান্ত্রিক খালেদা হাসিনাও সেভাবেই বলেছে। বিটিভিতে এরশাদ যা দেখিয়েছে গণতান্ত্রিক খালেদা-হাসিনাও তাই দেখিয়েছে। উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি শাসন পদ্ধতিতে, কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। পরিবর্তন প্রবৃদ্ধি যা হয়েছে তা গতানুগতিক হারেই হয়েছে। তবে যেটুকু পরিবর্তন দেখা গেছে তা সেই ২০ ভাগের স্বার্থ/শর্ত মেনেই হয়েছে। আগামীতেও তাই হবে।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আরো একটা বিকল্প শক্তি আসলেও বাংলাদেশের চেহারার কোন পরিবর্তন হবে না। যদি সত্যিকারের পরিবর্তন আসতেই হয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ওই ৮০% মানুষের প্রতিনিধিকে ক্ষমতার অংশীদার করতে হবে। রাজনীতিতে সৎ মানুষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতিই আনতে পারে সত্যিকারের গনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশ বাস্তবতায় এটা কি সম্ভব?
একটা কথা সবার কাছেই পরিষ্কার থাকা উচিত। বাংলাদেশ নৈরাজ্যের দেশ হয়ে থাকলেও আমরা জামাতী ধারণার বিকল্প শক্তির উত্থান চাই না। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে খুব খারাপ, মানি, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তান বা আফগানিস্থানের চেয়ে অনেকগুন বেশী স্বস্তির দেশ। আফগানিস্তান-পাকিস্তানের কথা ভাবলে বাংলাদেশের বর্তমান 'খারাপ'কেও আমি ভালোবাসি।
No comments:
Post a Comment