১.
শীত আসলে শহুরে মধ্যবিত্ত অন্ততঃ একবার পিকনিক/ভ্রমণ করে। কেউ একা, কেউ সপরিবারে। কেউ কক্সবাজার, কেউ রাঙ্গামাটি, কেউ বান্দরবান, কেউ বা সিলেট বা সেন্টমার্টিন। এটা না করলে মনের মধ্যে উশখুশ করে। আমিও প্রতিবছর নিয়ম মেনে সপরিবারে কোথাও না কোথাও যাই। আসলে কক্সবাজারেই যাওয়া হয় বেশী। যদিও পছন্দের দিকে পাহাড় আমাকে টানে বেশী। কিন্তু বাংলাদেশের পাহাড়ি শহরগুলোতে আবাসিক সংকট প্রবল। পিক সিজনে হোটেল পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে কক্সবাজার। যার কোথাও যাবার জায়গা নাই সেই যায় কক্সবাজার। প্রতিবার যাই বিরক্ত হয়েই, তবু ওশিন শিহানের আনন্দ দেখে বিরক্তি ফুরিয়ে যায়। ২০১২তে অনেক বেড়ানো হয়েছিল। ২০১৩তে এখনো কোথাও যাওয়া হয়নি না।
২.
শীতকালে গ্রামে মধ্যে একটা মজার পিকনিক চালু ছিল এককালে। চাটগাইয়া ভাষায় এটাকে বলে "খোয়াভাতি"। চট্টগ্রামের ভাষায় কুয়াশাকে বলো 'খোয়া'। কুয়াশাময় পরিবেশে এই পিকনিক হয় বলে এটাকে খোয়াভাতি বলা হয় সম্ভবতঃ। আমার শৈশব স্মৃতির মধ্যে এখনো যে স্মৃতির ঘ্রান অনুভব করি সেটা এই খোয়াভাতি। শীতকালে যখন ফসল উঠে যেত তখন ধূ ধূ প্রান্তর দিগন্ত জুড়ে। সেখানে ধান কেটে নেবার পর যে গোড়ালিটুকু বাকী থাকে সেটা শুকিয়ে খাড়া হয়ে দাড়িয়ে থাকে। সেই গোড়ালিকে বলে 'নাড়া'। যেখানে পিকনিক করা হবে সেই জায়গাটা সাধারণতঃ হয় এরকম ধূ ধূ প্রান্তরে। কিছু জায়গা থেকে নাড়া তুলে সমান করা হয়। তারপর সেই সমতল জায়গায় মাটি খুড়ে চুলা বানানো হয়। বাড়ি থেকে ডেকচি এনে বাচ্চাকাচ্চার দল রান্নার আয়োজন করে। সেই রান্না রাত ভর আনন্দ করে খাওয়া হয়। খোয়াভাতির নিয়মকানুন আছে কিছু। এখানে দোকান থেকে কোন জিনিস আসবে না। সবাই যার যার বাড়ি থেকে একেকজন একেকটা আইটেম আনবে। পাড়ার সবগুলো ঘরের ছেলেপেলের অংশগ্রহন থাকে এতে। কেউ আনে চাল, কেউ ডাল, কেউ মুরগী, কেউ ডিম, কেউ বা তেল নুন মশলা। এভাবে যোগাড় যন্ত্র করে নিজেদের মধ্যে যাকে সবচেয়ে যোগ্য মনে করা হয় সে রান্নার দায়িত্ব নেবে বাকীরা চারপাশ ঘিরে হৈ হৈ করে কাজ এগিয়ে দেবে। চুলায় আগুন জ্বালাতে গিয়ে চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। জ্বালানীর প্রধান হলো জমি থেকে টেনে তোলা নাড়া। সেই নাড়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুয়াশা জমে থাকে বলে আগুনে নাড়া দেবার পর বিশাল ধোয়া উৎপন্ন করে। সেই ধোয়ার কেমন একটা মায়াবী ঘ্রান থাকে। সন্ধ্যার আধো আধারে যখন রান্না শুরু হয় তখন সেই গোধুলীর আলো, ধোয়া, কুয়াশা সব মিলিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো মুহূর্ত তৈরী হয়ে যায়। সবাই গোল হয়ে বসে থাকি রান্নার ঘ্রান বের হয় খানিক পর। পুরো বিল জুড়ে সেই ঘ্রান মৌ মৌ করে। আজ রাতে কেউ ঘরে খাবে না। এই রান্নার মধ্যে এমন কিছু আছে যা দুনিয়ার সব ভালো খাবারকে মুহুর্তে হারিয়ে দেয়। সাধারণত খিচুড়ি রান্না হয়। সাথে থাকতো ডিম মুরগি আলুর ঝোল। খানিক সালাদ, এটুকুই। রান্নার পর দেখা যেতো হয় ভাত নরম হয়েছে, নয়তো লবনে গরমিল, অথবা ঝালে ভরপুর। তবু কী আনন্দ সেই ভাত খেতে। থালায় ভরে নিয়ে উন্মুক্ত আকাশের নীচে আগুনের গনগনে আলোয় বসে রাতের অপূর্ব ডিনার। আমাদের সেই খোয়াভাতি। আমি এখনো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে গেলে সেই ঘ্রানটা যেন পাই। মাঝে মাঝে গ্রামের পথে যাবার সময় কোন কোন গ্রাম থেকে সেই ঘ্রানটা এসে আবিষ্ট করে দেয় নস্টালজিয়ায়। আহ আবারো যদি খোয়াভাতির দিনগুলো ফিরে পাওয়া যেত। আমি জীবনের সবগুলো পিকনিকের চেয়ে খোয়াভাতির আনন্দটাকে বেশী মিস করি।
৩.
ভ্রমণের কথা বলতে গিয়ে খোয়াভাতির ভেতর ঢুকে গিয়েছিলাম। ফিরে আসি ঘোরাঘুরি কথনে।
আমার ঘোরাঘুরি দুই প্রকার। একটা পরিবার নিয়ে সুশীল ভ্রমন, আরেকটা বন্ধুদের সাথে হৈ হল্লা ভ্রমণ।
দ্বিতীয়টি আমাকে টানে বেশী, কিন্তু সুযোগ কমে গেছে আজকাল। কারণ দেশে আমার যেসব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে সেখানে মন মতো একটা ভ্রমণে হাতে কমসে কম পাঁচটা দিন থাকতে হবে। নইলে ঘুরন্তিসটা মনমতো হবে না। অথচ আমার ছুটিছাটা খুবই কম। দুই ঈদ বাদে বড় কোন ছুটি নেই। দুই ঈদ বাদ দিলে যেতে পারি, কিন্তু সামাজিকতার যন্ত্রনায় ঈদগুলো বাদ দেয়া যায় না। আমি তাই ঈদের ছুটিগুলোকে বলি নষ্ট ছুটি। একসময় ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে যেতে হতো। বেড়াতে নয়। অফিসের কাজ নিয়ে। অফিসের সাথে এটা নিয়ে অনেক ঝাড়াঝাড়ি আপত্তির পর ওটা বন্ধ করা গেছে। কিন্তু সামাজিক উৎসব পালন করা বাদ দিতে পারিনি। সময় চলে যাচ্ছে, জীবনের বাজেট কমে আসছে, অথচ না দেখা জায়গা রয়ে গেছে অগুনতি।
আন্দামান যাবার কথা ভাবছি সেই কবে থেকে, আন্দামানের উপর এন্তার পড়াশোনাও করলাম, কিভাবে কোন পথে গিয়ে কোথায় উঠতে হবে, কোন দ্বীপে যাওয়া যাবে, কোন দ্বীপে যাবে না সবকিছু জানলাম, কিন্তু বেরিয়ে পড়া হলো না এখনো। ম্যাপ দেখে মনে হবে আন্দামান চট্টগ্রাম থেকে নৌকা নিয়েও পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক পথের দূরত্ব অনেক। অন্য জায়গার চেয়ে আন্দামান যাত্রার নিয়মকানুন একটু কঠিনই।
দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরের মুরিয়া দ্বীপের উপর দিয়ে কতোবার ভার্চুয়াল ভ্রমণ করেছি ঠিক নেই। তাহিতির জমজ বলে পরিচিত ওই দ্বীপটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম প্রথম দেখাতেই। ওই দ্বীপের একজনের সাথে দোস্তালিও পাতিয়েছিলাম যাবো বলে। ব্যাটা আমাকে তার বাড়িতে থাকার দাওয়াত দিয়েও রেখেছে, কিন্তু ওই ফরাসী মালিকানার দ্বীপে যাবার কোন রাস্তা বের করতে পারিনি এখনো। ভিসা ট্রানজিটের ঝক্কি অনেক।
ব্রাজিল আর্জেন্টিনা চিলি পেরু এই আমাজন এলাকার দেশগুলো আদিকাল থেকেই আমাকে টানছে। পেরুর এডা মেলিসার সাথে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। সে বলেছিল বন্ধু চলে আসো একদিন তোমারে আমাজন থেকে মাচ্চুপিচ্চু সব ঘুরিয়ে দেখাবো। সেই ডাক এখনো আছে, আমিই বেরুতে পারলাম না।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপের স্বপ্ন পুঁতে দিয়েছিল ব্রজমাধব ভট্টাচার্য তার ক্যারিবিয়ানের সূর্য বইটি দিয়ে। ভেবেছি যদি সুযোগ পাই জীবনের শেষ অংশটা সেরকম কোন একটা দ্বীপে কাটাবো। সেই থেকে স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছি। সেই স্বপ্ন দেখার সময় ত্রিনিদাদের একজনের সাথে পরিচয় হলো এবং এমন ঘনিষ্ট বন্ধুতা হলো যে আমার পরিবারকে সহ সে তার দেশে নিয়ে রাখার আগ্রহ দেখাল। সে আমাকে সবগুলো ক্যারিবিয়ান দ্বীপ ঘুরে বেড়াবার প্রতিশ্রুতি দিল। কতো বছর ধরে যাচ্ছি যাচ্ছি করছি, কিন্তু সবকিছু গোছানো হয়নি বলে এখনো যাওয়া হলো না।
আরো আছে কেনিয়ার ওয়াইল্ড লাইফ সাফারির হাতছানি, তাসমানিয়ার বিরল বাঘের হুংকার, মাদাগাস্কারের আদিম জঙ্গল, ইরিয়ান জায়া প্রদেশের অচেনা পাহাড়, লাদাখের নিঃশ্বাস আটকে থাকা পর্বত আর তিব্বতের মানস সরোবরের হাতছানি।
এতো গেল বিশ্বের কথা। ঘর হইতেই তো দুই পা ফেলিয়া অনেক কিছু দেখা হয় নাই। দেশের মধ্যেই কতো জায়গা বাকী রয়ে গেছে। সুন্দরবন সিলেটের অরণ্য, বান্দরবানের নাফাখুম ঝর্না, একদম বাড়ির কাছের খরনা পাহাড়ের বিশাল অংশ এখনো অদেখা।
No comments:
Post a Comment