১.
আকাশভ্রমণ আমার খুব নাপছন্দ। প্রতিটি আকাশভ্রমণে আমি ধরে নেই যে এইটা আমার অগস্ত্য যাত্রা। মাঝপথেই ধরণীর পরে মাথা ঠেকাবে বায়ুশকট। কিন্তু শেষমেষ সশরীরেই মাটিতে নামা হয়। এবারো ভুটানী এয়ারের ছোটখাট প্লেনটা দেখে ভয় হলো এই শকটে করে কি করে দুর্গম গিরি পাড়ি দেবো। মাত্র ৪৮ সীটের ছোট্ট বাহন। সেই ৪৮ জনের মধ্যে ১৮ জনের মতো যাত্রী উঠেছে। বাকী আসনগুলো শূণ্য। অথচ টিকেট যোগাড় করতে কেয়ামত হয়ে গেছে আমার।
প্লেনে ওঠার পর হালকা গর্জন করে রানওয়ে দিয়ে চলতে শুরু করে ভুটানী বিমান। পাইলট যথারীতি শক্ত করে বেল্ট পরে বসে থাকতে উপদেশ দিল। রানওয়ের ছোট গলিপথ ছেড়ে প্রধান সড়কে উঠে এল প্লেনটা। কিন্তু হঠাৎ করে ব্রেক কষে থমকে দাড়ালো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ঢাকার উষ্ণ আবহাওয়ায় খাঁ খাঁ করছে বিশাল ঘেসো প্রান্তর। প্লেনটা গোঁ গোঁ করছে দাড়িয়ে। ঈষৎ বিরক্ত সে। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে গ্রীন সিগন্যাল পাচ্ছে না বোধহয়। বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেল। কোন নড়নচড়ন নেই। ব্যাপার কি, ইঞ্জিনে সমস্যা নাকি? পাইলট কিছু বলছে না কেন। সন্দেহ লাগলে আমাদের নামিয়ে চেক করে নিক। তবু যাত্রা নিরাপদ হোক। দুপুর একটা বিশ মিনিট। ছাড়ার কথা বরাবর একটায়।
একটু পরেই নড়তে শুরু করলো। বেশ জোরালো গর্জন দিল। মোটর সাইকেলের মতো একটা টান দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল ছোট লেন থেকে প্রধান রানওয়েতে। তারপর দিল এক চিতাবাঘের লাফ। বাপ্রে। আমি জীবনে এতবার বিমান চড়েও এই রকম আকাশ লম্ফ দেখিনি। ভয়ে অন্তরাত্মা বুকের খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিতে চাইল। এই ব্যাটা পাইলট ক্ষেপে গেছে নিশ্চয়ই এতক্ষণ দেরী হওয়াতে। সে দিগ্বিদিগ জ্ঞান হারিয়ে দশ দিগন্ত ছাড়িয়ে মেঘের রাজ্য পেরিয়ে খাড়া চাঁদের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলো আমাদের। উঠছে তো উঠছেই, ছোট প্লেন এত উপরে উঠতে দেখিনি আগে। মেঘের সাথে ধাক্কাধাক্কি লেগে ডানা ঝাপটাতে শুরু করলো প্লেনটা। আমার সহযাত্রী চোখ বন্ধ করে দোয়া দরুদ পড়ছে। এয়ারহোস্টেস কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। ভুটানী ভাষায় পাইলট কিছু একটা বলছিল এয়ার হোস্টেসের উদ্দেশ্যে একটু আগে। মনে হলো বলছে, তোরা লুকায়া পর, আমি কিন্তু হেঁচকা টান মারতেছি। সাবধান!!!
ডিং করে ঘন্টা বাজলো একটা। প্লেনটা কাত হতে হতে সোজাতে আসলো। এবার পতন শুরু। সাঁ করে নামছে এবার। পাইলট প্লেনটাকে মধ্যাকর্ষনের কাছে সমর্পন করেছে মনে হলো। ব্যাটার মাথায় কি মতলব কে জানে। মনে মনে বললাম, মরলে তুইও মরবি ব্যাটা। সামলে চালা।
আমার কথা টেলিপ্যাথিতে তার কানে গেল মনে হয়। আবারো ডিং করে শব্দ হলো। কি একটা বললো এয়ারহোস্টেসের উদ্দেশ্যে। মনে হলো বলছে, এবার জলদি খানা লাগা পাবলিকের ভাত হজম হয়ে গেছে একটানে।
এয়ারহোস্টেস এসে বললো, জুস খাবা? আপেল না অরেঞ্জ। আমি কই আপেল দাও, গলা শুকায় গেছে। জুশ দেবার পর স্যান্ডউইচ আনলো। ওটা ভয়ে রেখে দিলাম। আগে কে জানি বলছিল ভুটানী স্যান্ডউইচ ভয়ংকর হতে পারে। পেটের বিমারের ভয়ে ওটা ধরলাম না। তবে সাথে দুপ্যাকেট বাদাম ভাজা দেখা যাচ্ছে। ওগুলো নিয়ে কুড়মুড় করে খাওয়া শুরু করলাম। নীচের দিকে তাকালাম। মেঘের ফাঁক দিয়ে বাংলাদেশের জলাভূমি দেখা যাচ্ছে।
খানিক পর বিমানটা আবার মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। একটু চিত্তচাঞ্চল্য দেখা গেল যাত্রীদের মধ্যে। খবর খারাপ নাকি? জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সামনে বামদিকে মেঘের রাজ্য ছাড়িয়ে একটা সাদা তেকোনা বরফের মাথা। বুঝলাম চাঞ্চল্যের রহস্য। ব্যাগ খুলে তাড়াতাড়ি ক্যামেরা বের করলাম। ওইটা হিমালয় পর্বত। জীবনে এই সুযোগ খুব বেশী আসে না। এই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য হলো খালি চোখে হিমালয় দর্শন। ক্যামেরা ক্লিক করা শুরু করলাম। ক্লিক করতে করতেই পাইলট তার সমস্ত ক্যারিশমা দেখিয়ে মেঘের রাজ্য ছেদ করে প্রবল ঝাকুনি কাপুনির মাধ্যমে প্লেনটাকে ভুটানের জটিল ও বন্ধুর পর্বতমালার উপর নিয়ে এসেছে। এবার একবার ডানদিকে কাত হয়, আবার বামদিকে। অপূর্ব এক দৃশ্য। দুই পাশে দুই পর্বত রেখে মাঝখান দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ছোট্ট প্লেনটা। সেই বাড়াবাড়ি পার্বত্য সৌন্দর্যের প্রভাবে সকল ঝাঁকুনি কাঁপুনির ভয় উবে গেল। কেবল ক্যামেরায়ই ক্লিক চলতে থাকে নামার আগ পর্যন্ত। একসময় চাকাগুলো ভুটান রানওয়ে স্পর্শ করে এক ছুটে গিয়ে থেমে গেল টার্মিনালের সামনে।
দরোজায় লাগানো সিড়ি দিয়ে নীচে পা দেয়া মাত্র অদ্ভুত সুন্দর এক নিস্তব্ধতার সঙ্গীত বেজে উঠলো চারপাশের পাহাড়ে। লক্ষ কোটি ঝিঁঝি পোকা ভর দুপুরে বাজিয়ে যাচ্ছে মধ্যরাতের সঙ্গীত। চারদিকে সবুজ পাহাড়ঘেরা ছোট্ট এই বিমানবন্দরকে প্রথম দেখায়ই ভালো লেগে গেল। এত সুন্দর যে আমি ক্যামেরায় হাত দিতেই ভুলে গেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িটা বেরিয়ে যখন পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, আমি তখন ক্যামেরায় হাত দিতে বাধ্য হলাম।
পারো থেকে থিম্ফু যাবার পথে
২.
পারো এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ভবনে ঢুকলাম। হাতের ব্যাগটা একটা ডেস্কে রেখে এরাইভাল ফর্ম পুরন করতে শুরু করলাম। দেখি হাসি হাসি মুখ করে এক বালিকা এগিয়ে এসে আমার উল্টেদিকে দাড়ালো। ভাবলাম মিষ্টি হেসে জেরা করবে, কোন দেশ থেকে আসছো, কি কাজে আসছো ইত্যাদি। কিন্তু সে চুপ করে দাড়িয়ে। আমার সন্দেহ হলো নিশ্চয়ই গোয়েন্দা হবে। আমাকে আপাদমস্তক দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করছে হয়তো আমার ব্যাগে কি কি অবৈধ জিনিস লুকোনো আছে। বিশেষ করে সিগারেটের একটা প্যাকেট ভেতরে আছে সেটা আমার চেহারা দেখেই বুঝে ফেলেছে বোধহয়। ব্যাগটা বেশ ফোলা এমনিতেই, ওজনও কম হবে না। ক্যামেরা ডায়েরী পাসপোর্ট সব ওই হাত ব্যাগেই। মনে মনে বলি, লাভ নেই বালিকা। আমি কোন অবৈধ জিনিস আনিনি, এক প্যাকেট সিগারেট আছে, ওটা তুমি ধরার আগেই আমি খুলে দেখিয়ে দেবো। ফর্ম পুরন করতে করতে মনে মনে বালিকার সাথে ইন্টারোগেশান জাতীয় সংলাপ চালিয়ে গেলাম। ফর্ম পুরন শেষ। তারপর আমি মুখ তুলে তাকালাম বালিকার দিকে।
বললাম, এই যে আমার কাছে কিন্তু এক প্যাকেট সিগারেট আছে। বের করবো?
বালিকা হেসে বলে, আমাকে এসব বলার মানে কি? আমি কাস্টমস না। তুমি ওই খানে ওসব দেখাবে। আমি এয়ারপোর্ট স্টাফ।
আমি কথা শুনে বুঝলাম ভুল জায়গায় সিগারেটের কথা বলে ফেলছি। মনে মনে নিজেকে শাসন করে এগিয়ে গেলাম ইমিগ্রেশান কাউন্টারে। ইমিগ্রেশানের লোকটা পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখে সীল মেরে ফেরত দিল। আমি বললাম, ভাইরে আমার কাছে একটা প্যাকেট সিগারেট আছে, দেখবা না?
লোকটা বললো, ওটা আমার কাজ না, ওইদিকে কাস্টম আছে ওদের বলোগে।
আমি এবার কাস্টম চেকপোষ্টে গেলাম। ওরা পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখে আমাকে বললো, যাও ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাও।
আমি তখন প্রায় মরিয়া হয়ে বললাম এবার, কিন্তু আমার ব্যাগে যে আস্ত এক প্যাকেট সিগারেট রয়ে যাচ্ছে তার কি হবে???
লোকটা অবাক হলো আমার কথা শুনে। বলে, ওটা আমার কাজ না, ওদিকে ওই ঘরে ডিউটি নেয়, কিছু থাকলে ওখানে ঘোষনা দিয়ে ডিউটি ট্যাক্স দিয়ে আসো।
আমি তখন অদূরের সেই ঘরে গিয়ে দেখি এক বালিকা ডেস্কের কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললাম, আমার কাছে এই এক প্যাকেট সিগারেট আছে। কি করতে হবে বলো?
ওখানে আর কোন যাত্রী যায়নি। কারো কাছে ট্যাক্সেবল কিছু নেই বোধহয়। আমিই একমাত্র বেকুব। বালিকা আমাকে দেখে হেসে বললো, তুমি বসো আমি দেখছি।
তারপর কিছু ফর্ম, রেজিস্টার ইত্যাদি বের করে খচখচ করে লিখলো। তারপর বললো আশি নুলট্রাম। আমি বললাম আমার তো ডলার আছে, নুলট্রাম কই পাবো?
সে তখন বললো, ওদিকে ব্যাংক আছে, ওখানে ভাঙাও। আমি ব্যাংকের কাউন্টার গিয়ে ১০ ডলার ভাঙিয়ে ৪৬০ নুলট্রাম নিয়ে আসলাম। তারপর ডিউটি মিটিয়ে কাস্টম পেরিয়ে লবিতে চলে এলাম। আমার সহযাত্রী রিজওয়ান ভাই ওখানে বসে মিটিমিটি হাসছে। বললো, এক প্যাকেট সিগারেটের জন্য এত কিছু করলেন? না বললেও তো কিছু হতো না। আমি বললাম, ধরা পড়লে, তিন বছর জেল। আশি টাকা বাঁচাবার জন্য তিন বছর জেল বেশী হয়ে যায়।
এখন গাইডের খোজ নেবার পালা। আমাদের নিতে আসবে একজন গাইড। যার নাম উগেন। চেহারা চিনি না। আমাদের চেহারাও চিনে না সে। এরমধ্যে গেটে দাড়ানো বেশ কয়েকজন লোকাল ড্রাইভার বেশ বন্ধুসুলভ স্বরে বলছে ওদের গাড়িতে যেতে। কিন্তু আমি তো আগেই বুক করে এসেছি হোটেল গাইড সব। খানিক পর নিরীহ চেহারার একজন কাছে এসে হাতের একটা কাগজ দেখালো, দেখি আমার নাম লেখা। বললাম, উগেন? বললো জী হা।
আমরা তার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। গাড়ি ছুটে চললো শহরের দিকে। গাড়িতে উঠেই বললাম, উগেন আমার প্রথম কাজ হলো একটা সীম যোগাড় করা। তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?
উগেন আমাকে সীম কিনে দিল পথের একটা দোকান থেকে। আমার ছবি পাসপোর্টের কপি ইত্যাদি দিয়ে সিম লাগালাম মোবাইলে। এবার শান্তি। পথের দৃশ্য উপভোগ করতে কোন অসুবিধা হলো না এরপর থেকে। রাস্তার পাশে পাহাড়ি ঝরনাময় নদী, নদীর ওপারে পর্বত, পর্বতের গায়ে ছোট ছোট সব বাড়ি। অপূর্ব সুন্দর একটা দৃশ্য। গাড়ি এগিয়ে চললো থিম্ফুর দিকে।
থিম্ফুর কেন্দ্রস্থলে আমাদের হোটেল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল তখন। গাড়ি থেকে নেমে অবাক সৌন্দর্যে আমি বাক হারা। রাস্তার উল্টোদিকে একটা বিশাল পাহাড় আকাশের দিকে উঠে গেছে। ঝাপসা অন্ধকার পাহাড়ের মাথায় ঝুলে আছে একটা অপার্থিব চাঁদ। এত সুন্দর চাঁদ আর কোথাও দেখিনি যেন। এত শান্ত নিরিবিলি একটা শহর। কোথাও কোন কোলাহল নেই। প্রায় নিঃশব্দে জেগে আছে একটা শহর।
হোটেল রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কফি খেতে আসলাম নীচের রেস্তোঁরায়। খোঁজ করলাম হোটেলের মালিক দীপক গুরুংকে। কিন্তু সে নেই। গ্রামের বাড়িতে গেছে এখান থেকে বহুদূরে। তবে সমস্যা নেই তার কিশোরী কন্যা জাহানা আর আইটি বিশেষজ্ঞ শ্যালক উগেশ আমাদের সার্ভিস দিতে এগিয়ে এল। এটা পুরোপুরি পারিবারিক একটা হোটেল। দীপক তার স্ত্রী কন্যা মিলে চালায়। হোটেল লবিটা চমৎকার। বারান্দার মতো একটা জায়গা আছে অর্ধবৃত্তাকার, ওখানে বসে শহর দেখা যায়, সামনের পাহাড়ের উপর ঝুলে থাকা চাঁদটাও একদম স্পষ্ট। বলাই বাহুল্য চমৎকার একটা সূচনা হলো থিম্ফু শহরে।
কফি খেয়ে নীচে নামলাম। ছোট্ট একটা শহর। আমাদের হোটেলের সামনের রাস্তটাই প্রধান সড়ক। তার ওপাশে মাইকে ভুটানী গান চলছে। একটা কি উৎসব চলছিল। আমরা হেঁটে হেঁটে বেড়ালাম ঘন্টা খানেক এদিক সেদিক। দোকানপাটগুলো ছিমছাম। ট্যুরিষ্টদের জন্যই সাজানো। দাম আকাশছোয়া। রাতে খাওয়ার আগে ফিরে এলাম। রিজওয়ান ভাই বললো এই ঠান্ডায় দুটো বিয়ারের বোতল নিলে মন্দ হয় না। আমি বললাম, অনেকদিন খাইনা। তবু আজকে খাওয়া যায়। ভ্রমণে এলে একটু বিয়ারটিয়ার দিয়ে সন্ধ্যেটা শুরু করা যায়। বিয়ার এলো, সাথে বাদাম ভাজা, চমৎকার করে পিয়াজ কাচামরিচ লেবু টমেটোর মিশ্রনে। নটার পর ডিনার আসলো। খেয়েদেয়ে রাত দশটায় যার যার রুমে পৌঁছে গেলাম।
রাতের থিম্ফু
1 comment:
খুব সুন্দর লেখা,থিম্পুর হোটেল নাম টা জানা দরকার
Post a Comment