আমার প্রথম চাকরির প্রথম দুবছর দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ করতাম। প্রথম ছমাস ছুটি বলে কোন শব্দ ছিল না। ছমাস পর থেকে মাসে একটা শুক্রবার ছুটি। সপ্তাহে নিয়মিত একদিন ছুটি পেতে প্রায় দুবছর লেগেছিল। নতুন কোম্পানি গড়ে তোলার প্রাথমিক কারিগর হিসেবে এই কষ্টটা সহ্য করার পুরস্কারও পেয়েছিলাম। অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখে গিয়েছিলাম। যেখানে আমার যাবার কথা নয় সেখানেও পৌছে গিয়েছিলাম। আমি একা ছিলাম না, আমার সাথে আরো কয়েকজন এই ধৈর্য পরীক্ষায় পাশ করেছিল। সেটা ব্যাপার না। ব্যাপার হলো আমি যখন ১৪ ঘন্টা কাজ করা নিয়ে কাহিল, তখন আমার নিয়োগকর্তা ১৮ ঘন্টা কাজ করতেন। মাঝে মাঝে আমরা ভাবতাম তিনি ঘুমান কখন? রাত বারোটায় অফিস থেকে গিয়ে ভোর ছটায় আবারো হাজির। আমরা প্রতিদিন সকাল সাতটায় অফিসে পৌঁছে আমাদের আগেই তাঁকে উপস্থিত দেখতাম। তখন থেকে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু মানুষগুলোর বসবাস পূর্ব এশিয়ায়। কিন্তু মাল্টি মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও এত পরিশ্রম করার পেছনে রহস্য কী? ব্যালেন্স শীটের অংকটা বছরের পর বছর বাড়িয়ে যাওয়া? নতুন নতুন কোম্পানি গড়ে তোলা? নাকি স্রেফ কাজের নেশা? তখন কিছুই বুঝিনি।
এখন আমি একটা স্বাধীন দেশের রাজা। যেখানে কাজ করি আমার ওপর খবরদারী করার কেউ নেই বললেই চলে। আমি কটায় ঘুম থেকে উঠলাম, কটায় ঘুমালাম সেটা নিয়ে কারো অভিযোগ নেই। কাজটা নিজের সময়মতো মতো করি। ভোরে উঠে অফিসে যাবার তাড়া নেই। কিন্তু নিজের রাজ্যে এসে দেখলাম আমিও প্রায় ১৮ ঘন্টার কাজের চক্রে আটকে গেছি। প্রায়ই মনে হয় দৈনিক ২৪ ঘন্টা যথেষ্ট নয় দিনের সবগুলো কাজ শেষ করার জন্য। কাজের পর কাজ এসে জমা হতে থাকে নিজস্ব অনলাইন ওয়ার্কস্পেসের ফোল্ডারে। ত্রিশ বছর পর আমি পূর্ব এশিয়ার সেই ভদ্রলোককে একটু হলেও অনুভব করলাম। তিনি বলেছিলেন- ‘কাজ একটা নেশা, তোমাকে জাগিয়ে রাখবে ভোর থেকে মধ্যরাতের পরও। যদি কাজ ও তুমি পরস্পরকে পছন্দ করো’।
আমরা কী পরস্পরকে পছন্দ করি? হয়তো। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি। জীবন থেকে মানুষ অনেক শিক্ষা নেয়। এটা ছিল আমার বিলম্বিত শিক্ষার একটি। প্রাচীন ল্যাটিন ভাষায় বলা হতো Potius sero quam nunquam, ইংরেজিতে Better late than never.
কিন্তু একজন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে পছন্দের কাজ পাবে সেরকম কোনো ব্যবস্থা আছে? কাজ ও শিক্ষা এদেশে যোজন যোজন আলোকবর্ষ দূরে থাকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? শিক্ষাখাতে এত বাজেট রেখেও কেন পাঁচ দশকে আমরা একটা অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠি বহন করে যাচ্ছি? বিকলাঙ্গ শিক্ষার প্রতিফলন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবশালী লোকদের কমেন্ট সেকশনেই আছে।
আমাদের দেশে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অধিকাংশ তরুণের দুর্ভাগ্য হলো অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন একটা কর্মজীবন শুরু করা এবং অপছন্দের একটা কর্মজীবন কাটিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে যাওয়া।
এই বিকলাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে, জগাখিচুড়ি কারিকুলাম দিয়ে কখনোই একটা সুশিক্ষিত সুশৃংখল জাতিগোষ্ঠি গড়ে তুলতে পারবে না বাংলাদেশ।
No comments:
Post a Comment