Monday, September 1, 2025

পলিটিক্যাল নেশন

 একটা সময় জানতাম রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করে। সরকার দেশ চালায়। সরকারে যে দলই থাকুক, পক্ষপাতিত্ব করেও সরকার দেশটাকে চালিয়ে নেবার চেষ্টা করে। নব্বই দশক পর্যন্ত এটা মোটামুটি ঠিক ছিল। একুশ শতকে আসার পর দেখা গেল সরকারের নানা অংশ রাজনীতি করছে। মানে সরকারের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন না করে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। আগে যেটুকু করতো সেটার একটা মাত্রা ছিল। একুশ শতকে এসে মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তারপর দেখা গেল এদেশের মানুষগুলো সরকারের মতো হয়ে গেছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকছে সে দলের মানুষগুলো সরকারের মুখপাত্র হয়ে কাজ করছে। ন্যায় অন্যায় কোনো ব্যাপার নয় সমর্থিত সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তকে রক্ষা করার ঢাল হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এখান থেকেই গণতন্ত্রের পরাজয়ের সূচনা হয়। মানুষ যখন নিজের ভালমন্দ বিচার না করে দলের ভালোমন্দ, দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যে কোনো মতবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। মানুষগুলো তখন আর মানুষ রইল না, একপাল অন্ধ ভেড়ার পালে রূপান্তরিত হলো। ধীরে ধীরে প্রায় পুরো রাষ্ট্রজুড়ে সাধারণ জনগণ বলে কিছু থাকলো না। সবারই একটা না একটা পক্ষ আছে। নিজের স্বার্থের চেয়ে সেই পক্ষটার স্বার্থ বড় হয়ে গেল।

একটা মানুষ ততক্ষণ মানুষ থাকে যতক্ষণ সে নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা রাখে। যখন সে নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ভেড়ার পালের অংশ হয়ে যায় তখন আসলে দেশটা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কারণ সে অতীত-বর্তমান-ভবিষৎ দেখার চোখ হারিয়ে ফেলেছে। সে সবকিছু দেখছে সমর্থিত দলের চশমায়। এই সমর্থন হলো এমন একটা প্রবণতা যেখানে প্রতিপক্ষের কোনো স্থান নেই। আমি যেটা সমর্থন করি একমাত্র সেটাই ঠিক। বাকি সবাই ভুল। পৃথিবীতে গণতন্ত্রের অর্থ হলো নিজ নিজ পছন্দের দলকে নির্বাচিত করা কিন্তু প্রতিপক্ষের মতামতকেও শ্রদ্ধা করা। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের অর্থ হলো শুধু আমার সমর্থিত দল সঠিক, তার বাইরে আর কোনো সত্য নেই। এই বিশ্বাসটা অনেক ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের মতো হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, যত শুদ্ধভাবেই হোক, তবু শান্তি আসবে না। কারণ সমস্যা আমাদের মগজে। 

আরেকটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে। মানুষগুলো দলের বাইরে কিছু ইনফ্লুয়েন্সারকে গুরুমান্য করে। তাদের হাতে নিজেদের ভাগ্য সমর্পন করেছে। নিজের কোনো বক্তব্য নেই। গুরুজি যেটা বলবেন সেটাই তার বক্তব্য। ভেড়ার পালের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী। এরা নিজেদের অস্তিত্বের কথাও ভুলে যায় ছয় ইঞ্চির একটা স্ক্রিনে ভেসে আসা ভিডিওবার্তা দেখে। স্মার্টফোনের যত উপকারিতা আছে, তার দ্বিগুন ক্ষতি করেছে এই সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার। বাংলাদেশে এটা রীতিমত মহামারী। ঘুম থেকে উঠে মানুষ এই ডিভাইসের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে আজকে কোন গুজবটা বিশ্বাস করবে। আমাদের শিক্ষার হার যাই হোক, শিক্ষার মান কতটা ভয়াবহ সেটা ওই ইনফ্লুয়েন্সারদের কমেন্ট বক্সেই প্রমাণিত। 


এদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই মানবতা সহনশীলতা এই মৌলিক বিষয়গুলো মেনে চলে না। জোরে চেচিয়ে কথা বলে নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মানুষগুলো এখন সেই সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে নিজের অজান্তেই। দাসত্ব করছে এমন কিছুর যেটা কখনোই মানুষের জন্য সম্মানজনক নয়। কে কাকে কোন কারণে ব্যবহার করছে সেটা মানুষের ধারণাই নেই। চোখের সামনেই অসংখ্য অরাজকতার ঘটনা দেখছে, সেটা প্রতিকার চাইতে গিয়ে আসল কারণ না খুঁজে রোবটের মতো প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায় মানুষ বিভক্ত। এত বিভক্ত, এত তিক্ত বহুমতকে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া পৃথিবীর কোনো শক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই দেশে কোনো দিনও শান্তি আসবে না। এটা নিয়ে হা হুতাশ করেও লাভ নেই। আপাতত বাংলাদেশের নিয়তি এটাই। এই শতকে কোনো পরিবর্তন আশা করি না। আগামী শতকে যদি কোনো পরিবর্তন আসে সেটা দেখার জন্য আমরা কেউ থাকবো না। হয়তো দেশটাও তখন থাকবে না।

নিজের অজান্তেই আমরা একটা অপ্রয়োজনীয় পলিটিক্যাল নেশনে পরিণত হয়েছি যেখান থেকে মুক্তির পথে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন সাজানো।