শ্রাবণী যখন আমাদের অফিসে যোগ দেয়, তখন সে মাত্র ইন্টার পরীক্ষায় পাশ করেছে। ওরকম অনেক তরুণ তরুণী আমাদের অফিসে কাজ করতে আসে যারা ওয়াক-ইন ইন্টারভিউতে নিয়োগপ্রাপ্ত। কিন্তু শ্রাবণী তাদের সবার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আলাদা হবার একমাত্র কারণ তার অপার্থিব সৌন্দর্য। যে সৌন্দর্যের আলোয় পুরো অফিসের চেহারা চিত্র বদলে গিয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যেই।
মেয়েটা যোগ দেবার পর থেকে অফিসের সম্পূর্ণ আবহাওয়ায় একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা গেল। আমাদের অফিসটা কাজ করার জন্য খুব আরামদায়ক জায়গা ছিল না। অফিস প্রশাসন এবং তাপমাত্রা উভয়ই সারাক্ষণ উত্তপ্ত এবং খড়গহস্ত থাকতো কর্মীদের উপর। ফলে কর্মীরা নানান ছুতো নাতায় বাইরের কাজে সময় ব্যয় করতো। এক ঘন্টার কাজ নিয়ে কেউ বের হলে সে চার ঘন্টা পর ফিরতো। দেরীর অজুহাতের কোন সীমা ছিল না। যাদের বাইরের কাজ ছিল না, তারাও চেষ্টা করতো অন্তত একটা ফাঁকে বেরিয়ে চা নাস্তা খেয়ে আসতে। অর্থাৎ পুরো অফিসটাই ছিল বহির্মূখী।
শ্রাবণী অফিসে যোগ দেবার পর সেই আবহাওয়াটা আমূল বদলে গেল। দিনের প্রথমভাগে লাঞ্চের আগ পর্যন্ত অফিসটা ফাঁকা থাকতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সকালবেলাও অফিসের মধ্যে ভিড়। বাইরের কাজের ব্যাপারে সব কর্মীদের হঠাৎ করে একটা অনীহা দেখা দিল। আগে নানান অজুহাতে বাইরে যাবার চেষ্টা করতো যারা, তারা এখন ভিন্ন অজুহাতে অফিসে সময় কাটাচ্ছে। বাইরে যাবার কাজ নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই। সামান্য টাইপ কিংবা ফটোকপির কাজ নিয়ে আগে যারা বাইরে ছুটতো, তারা এখন অফিসের একমাত্র টাইপ মেশিনে কাজটা নিজেই সেরে নিচ্ছে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল ফটোকপির কাজটা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। অফিসের একমাত্র ফটোকপি মেশিনটার দায়িত্বে ছিল শ্রাবণী। সেখানে সর্বক্ষণ লাইন লেগে থাকতো। এতদিন দেখতাম অফিসে সবচেয়ে বেশী ফটোকপি লাগতো আমার। এখন দেখি সবারই ফটোকপির কাজই বেশী। শ্রাবণী এত ফটোকপি করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতো। ফটোকপি মেশিনটাকে দূর থেকে দেখে একটা মৌচাক বলে মনে হতো।
সত্যিই সমস্ত অফিস তার রূপে ঝলসে গিয়েছিল। তরুণদের মাথা নষ্ট। বয়স্কদের বিভ্রম ঘটার দশা। আমার নিজেরও মতিভ্রম হতো -যদি না নিকট অতীতের একটা ধাক্কায় ঘোর বাস্তববাদী হয়ে না পড়তাম। একসময় মনে হতো এমন একজন রূপবতী নারীর চারপাশে এরকম ভিড় না থাকাটাই হতো অস্বাভাবিক।
মাসখানেকের ভেতর শোনা গেল শ্রাবনী কারো কারো কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব, বিয়ের প্রস্তাব ইত্যাদি পেতে শুরু করেছে। সে প্রতিযোগিতায় কে কে এগিয়ে আছে সেটা নিয়েও কানাঘুষা। মোটকথা অল্প সময়ের মধ্যে শ্রাবনী আমাদের অফিসের প্রায় সবগুলো পুরুষের মন জয় করে ফেলেছে। ওর মন কে কে জয় করেছে সেটা জানার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু তাতেও গোপন কৌতূহল ছিল অনেকের। আমি তখনো ২৯ বছর বয়সী ব্যাচেলর। কিন্তু বিয়ে থা করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বছরখানেক আগে পিতৃবিয়োগের কারণে পরিবারের অনেক বড় দায়িত্ব আমার ঘাড়ে।
তাই বলে শ্রাবনী যে আমাকেও মুগ্ধ করেনি, সেটা অস্বীকার করতে পারি না। পৃথিবীতে আমি যত রূপবতী দেখেছি টিভিতে সিনেমায় নাটকে- এই মেয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এই মেয়েটা আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী। এর সাথে তুলনা করার মতো একটি মুখও এই দেশে নেই। এর সাথে শুধু একজনেরই মিল পেয়েছি আমি। সেই একজন হলো হলিউডের অড্রে হেপবার্ন। সত্যি বলতে কী অড্রে হেপবার্নও হেরে যেতে পারতো। তবু তাৎক্ষণিকভাবে আমি শ্রাবণী নামের মেয়েটাকে মনে মনে অড্রে হেপবার্ন বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। তার সৌন্দর্যের ধার কতটা প্রবল সেটা বোঝাতে গিয়ে একটি উদাহরণ দেই। ওর দিকে সরাসরি তাকানো যেতো না, তাকালেই যেন দৃষ্টি পিছলে যাবে এ্তই মসৃন ছিল ওর মুখশ্রী। আমি তাই সহজে ওর দিকে তাকাতাম না। কী একটা ভয় আমাকে চেপে ধরতো। আমি এড়িয়ে যেতাম ওর সাথে চোখাচোখি। আমার কাছে শ্রাবনী ছিল অন্য বাগানের গোলাপ। দূর থেকে গোপন মুগ্ধতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম আমি। সেটা প্রকাশ করা কিংবা তার কাছে যাবার কোনও পরিকল্পনা ঘুণাক্ষরেও করিনি। তাছাড়া আমি ভাবতাম শ্রাবনীর অপার্থিব সৌন্দর্যের পাশে দাঁড়ানোর কোনও যোগ্যতা আমার নেই। থাকলে হয়তো শ্রাবনীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতাম।
শ্রাবনীর প্রতি আমার কোন মুগ্ধতা প্রকাশ না পেলেও দায়িত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছিল দুয়েকবার। এমনিতে ওর সাথে আমার কাজের সম্পর্ক খুব কম। আমার অধীনস্থদের সাথেই ওর কাজকর্ম, ওদের সাথে আলাপ আড্ডা হতো। সে ছিল আমাদের অফিস সহকারী। ফটোকপির পাশাপাশি ফাইলপত্র গোছানো এবং টুকটাক প্রশাসনিক কাজে লাগতো। আমার সাথে মাঝে মাঝে দুয়েকটা দরকারী কথা ছাড়া তেমন আলাপ হয়নি কোনও দিন। শুধু একবার একটু ব্যতিক্রম হয়েছিল। এক প্রচণ্ড গরমের দিনে দরদর করে ঘামছিলাম চেয়ারে বসে। কারেন্ট ছিল না। সবাই হাতের ফাইল নিয়ে বাতাস করছিল। সে আমার উল্টোদিকে বসা ছিল অন্যদের সাথে। সেও হাতে একটা ফাইল নিয়ে বাতাস করছিল। হঠাৎ কেন যেন সে মজা করে বলে উঠলো, আপনাকে বাতাস করি?
শুনে আমি একটু অবাক হলাম, কারণ অফিসের কোনও জুনিয়র আমার সাথে এমন ঠাট্টা করে না। আমি একটু গম্ভীর ধরণের লোক বলে পরিচিত ছিলাম। অনেকে ভয় পেতো আমার মেজাজকে। সে তার পরিচয়ও পেয়েছিল অন্তত একবার।
অফিসে বেশ কজন সিনিয়র বিদেশী কলিগ ছিল আমাদের। তার মধ্যে এক বিদেশী ওর সঙ্গ পাবার জন্য বারবার কফি খেতে চাইতো। ওকে বলতো সে যেন কফিটা রুমে দিয়ে আসে। সে একা ওই রুমে কফি নিয়ে ঢুকতে ভয় পেতো। মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। ওই লোকের মতিগতি নিশ্চয়ই ভালো লাগেনি তার। এটা নিয়ে অভিযোগ করে এডমিনের কাছে। কিন্তু এডমিনের সাহস ছিল না সেই ক্ষমতাবান বিদেশীর বিরুদ্ধে কিছু বলার।
কিন্তু একদিন সেই কফি চাওয়ার ঘটনা আমার সামনেই ঘটলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে সারা অফিসকে শুনিয়ে বাংলা ভাষায় বলেছিলাম, কফি বানানো তোমার চাকরী না। এর পর যদি তোমাকে কেউ কফি দিয়ে আসতে বলে, আমাকে জানাবা। আমি তাকে চারতলার জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবো নীচে।
আমাদের বিশাল অফিসটা উন্মুক্ত। এ মাথা ও মাথা সব শোনা যায় দেখা যায়। শ্রাবনী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল, আচ্ছা। সেই বিদেশী ক্ষমতাবান আমার বাংলা ভাষা বুঝতে না পারলেও ঘটনা হয়তো অনুমান করেছিল। সে আর কখনো কফি চায়নি শ্রাবনীর কাছে। আমাকে কিছু বলেনি। শ্রাবনীর সাথেও আমার কখনো কোনও কথা হয়নি সেদিনের টেলিফোনটা আসার আগে।
টেলিফোনটা এসেছিল একদম সকালবেলা। যখন আমরা অফিসে ঢুকি সাড়ে সাতটার সময়, ঠিক তখনই কেউ ফোন করে আমাকে চাইল। অপারেটর আমাকে ফোনটা ট্রান্সফার করে দিলে আমি এক অচেনা নারীকন্ঠ শুনতে পেলাম। পরিচয় জানতে চাইলে সে যা বলল আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। ফোনটা ঘড়ঘড় করছিল।
আবারো জানতে চাইলে মেয়েটা পরিচয় বলার পর আমি অফিসের চারদিকে তাকিয়ে শ্রাবনীকে খুঁজলাম। যে মেয়েটি ফোন করেছে সে নাকি শ্রাবনী। কিন্তু সে তো এখন অফিসে থাকার কথা। অফিসে না এসে ফোন করেছে কেন? আমাকে কেন? অফিসে আসতে না পারলে তো এডমিনকে ফোন করার কথা। ওর দফতর তো এডমিন। আমি ওর বস নই।
আমি বিরক্ত হতে হতেও হলাম না। কারণ শ্রাবনী নামের মেয়েটা বলছে সে একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছে। তাতে আমার সাহায্য দরকার। কিন্তু অফিসে এসে সমস্যার কথা বলতে পারবে না, অসুবিধা আছে। আমাকে বাইরে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে হবে।
এরকম অদ্ভুত অনুরোধ আমাকে জীবনে কেউ করেনি। আমি অনুরোধটা না রাখলেও পারি। শ্রাবনীর সাথে বাইরে গিয়ে দেখা করা আমার জন্য মানানসই ব্যাপার না। আমি কখনো কোনও মেয়ের সাথে এভাবে বাইরে দেখা করিনি। তাছাড়া এমন রহস্যময় আচরণ করছে কেন শ্রাবনী? অফিসে এসে বললে কী এমন সমস্যা। কিন্তু মেয়েটা এমন অনুনয় করে বলছে, প্রত্যাখ্যান করতে খারাপ লাগলো।
বললাম, আসবো তবে এখন পারবো না, আরো ঘন্টা দুয়েক পর। সে বলল, সে অপেক্ষা করছে। নেভি কলোনীর গেটে। নেভির অফিসার্স কলোনী আমাদের অফিস থেকে দূরে নয়। আমি নটার পর ব্যাংকের কাজে বের হই, ব্যাংকের অবস্থানও নেভি কলোনীর কাছাকাছি। আমার চেনা জানা জায়গা। ওখানে গিয়ে চট করে দেখা করে আসতে সমস্যা হবে না।
তখনো জানি না সেই দেড় ঘন্টায় কত কিছু ঘটে যেতে পারতো। জানলে আরো আগেই বের হতে পারতাম।
ইপিজেড গেট থেকে কয়েকশো গজ দক্ষিণে নেভি কলোনীর চেকপোস্ট। চেকপোস্টের পাশেই একটি কৃষ্ণচুড়া গাছ। এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে কালো বোরকা পরা আপাদমস্তক ঢাকা একটি মেয়ে। পাশে বড় একটা ক্যানভাসের জার্নি ব্যাগ। মেয়েটা বাড়ি যাচ্ছে বোধহয়। গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমাকে যে আসতে বলেছে সে কোথায়? শ্রাবনীর তো এখানেই কোথাও থাকার কথা। এই চেকপোস্টের পাশেই। যেতে উৎসুক চোখে খুঁজছিলাম সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়েকে।
তখনই আমাকে চমকে দিয়ে বোরকা পরা মেয়েটা কথা বলে উঠলো, আপনি এসেছেন?
আমি চমকে গেলাম বোরকা পরা মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটার চোখটাই শুধু দৃশ্যমান। আমি চোখের দিকে তাকিয়ে চিনে ফেললাম। এই তো শ্রাবনী! কিন্তু এমন আলখেল্লার আড়ালে কেন? সাথে এত বড় ব্যাগটাই বা কেন? আমার চোখে অসংখ্য প্রশ্ন দেখে সে বললো, ‘সব কিছু বলবো। আপাতত কোথাও গিয়ে বসতে হবে। অনেক সময় লাগবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না।’
আমি তখনো কিংকর্তববিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে উঠিনি। এই ব্যাগ নিয়ে কোথায় বসবো। হোটেল রেস্তোরায় লোক গিজগিজ। কথা বলার উপায় নেই। তাছাড়া এদিকে আমার সহকর্মীরা, চেনাজানা লোকেরা যাতায়াত করে। একটা মেয়েকে নিয়ে আমি হোটেলে বসেছি এটা জানাজানি হলে ইজ্জত থাকবে না।
হঠাৎ করে মাথায় এলো কফি হাউজের কথা। বে শপিং এর দোতলায় নিরিবিলি কফি হাউজ। আমরা কলিগরা মাঝে মাঝে ওখানে লাঞ্চ করি নাস্তা খাই। দেরী না করে ওর ব্যাগটা তুলে নিয়ে ওদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। তখনো বে-শপিং পুরোপুরি জাগেনি। লোকজন তেমন নেই। আমরা দোতলার কফি হাউজে গিয়ে বসলাম। আমরাই প্রথম কাস্টমার দোকানে। কেউ নেই বলে এবার সে বোরকা খুলে ফেললো। দেখলাম আজ শাড়ি পরে আছে। কলাপাতা সবুজ একটা শাড়ি। অন্যরকম লাগছিল ওকে শাড়িতে। মুখোমুখি বসলাম। জানালো সকালে কিছু না খেয়েই বেরিয়েছে বাসা থেকে। ক্লাব স্যাণ্ডউইচ অর্ডার দিলাম দুটো।
তারপর বললাম - ‘বলো তোমার কথা।’
সে প্রথমে দুঃখপ্রকাশ করলো আমাকে এভাবে অফিস থেকে বের করে আনার জন্য। আর কোন উপায় ছিল না।
তারপর আসল বোমাটা ফাটালো।
-আমি একটা বিপদে পড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি। আমাকে কোথাও নিয়ে যান। আপনি ছাড়া এই শহরে আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। আমাকে আশ্রয় দিন। আপনি যেখানে রাখবেন আমি সেখানেই থাকবো। আমাকে ওরা কেউ ছাড়বে না। এখানে আমি আর এক মুহূর্ত নিরাপদ নই। বড় একটা বিপদে পড়ে নিরুপায় হয়ে আপনাকে ডেকেছি।
শুনে আমি বাকহীন হয়ে গেলাম। কোনমতে বললাম-
-বলছো কী তুমি? অফিসে যাওনি কেন আজ?
-কী করে যাবো। বিপদ তো সেখানেও লুকিয়ে। সবখানেই ওরা। আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলছি। অনেক লম্বা কাহিনী আপনাকে একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
তারপর ধীরে ধীরে তার জীবন কাহিনী বলতে শুরু করলো। দীর্ঘ সেই কাহিনীর সারসংক্ষেপ হলো- সে খুলনার মেয়ে। এবার এইচএসসি পাশ করেছে। পাশ করার পরপর পরিবার থেকে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে। বাগদানও হয়ে গেছে। কিন্তু ওই বিয়েতে সে রাজী হতে পারেনি। সে কিছু সময় চেয়েছিল পরিবারের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিল। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। পরিবার তাতে রাজী না হওয়াতে সে রাগ করে খুলনা থেকে চট্টগ্রাম চলে এসেছিল। এখানে ওর বোন আছে। তার সুত্র ধরে যেনতেন কাজের একটা চাকরীতে ঢোকা। আসল উদ্দেশ্য একটা আশ্রয়ে থাকা।
কিন্তু চাকরীতে ঢোকার পর থেকে চারপাশ থেকে মৌমাছির মতো এত লোকজন তাকে ঘিরে ধরেছে যে সে এখন পালাবার পথ খুঁজছে। অফিসের লোকজনের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তাকে প্রস্তাব বা ইঙ্গিত করেনি। একমাত্র আমি নাকি ব্যতিক্রম। এটা শুনে কেমন আত্মতৃপ্তি লেগেছে সেটা বলাই বাহুল্য।
বড় বিপদটা হয়ে গেছে বাইরে থেকে। বাইরের কিছু সন্ত্রাসী পেছনে লেগেছে। এক প্রভাবশালী সন্ত্রাসী ওর বাসা পর্যন্ত গিয়ে হুমকি দিয়েছে। ওর বোন এবং ভগ্নিপতিকে বলেছে ওর কাছে বিয়ে না দিলে তুলে নিয়ে যাবে। দুদিন সময় দিয়েছে সিদ্ধান্ত নিতে। ওর বোন ভগ্নিপতি ভয়ে কাতর হয়ে রাজী হয়েছে প্রাণের দায়ে।
কিন্তু সে প্রাণ গেলেও সেই প্রস্তাবে রাজী নয়। আজ তাই বোন এবং ভগ্নিপতি অফিসে চলে যাবার পর সে ঘরে তালা মেরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়েছে চুপি চুপি। বেরিয়ে পড়েছে কিছু না ভেবেই।
পথে নেমেই ভাবছে কোথায় যাবে একা, কার কাছে যাবে। নেভি গেটের কাছে এসে আমার কথাই নাকি প্রথমে মাথায় আসলো। তাই আমাকেই ফোন করেছে মরিয়া হয়ে। এখন আমার কাছে পরামর্শ চাইছে কী করবে সে? কোথায় পালাবে? আমার বাসায় কী তার আশ্রয় হতে পারে কিনা। আমি যেভাবে রাখবো সেভাবে থাকতে রাজী সে। আমার ওপরই তার সমস্ত জীবনের ভার অর্পন করলো সে।
আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না এমন একটা কিছুর জন্য। এটা অদ্ভুত একটা সমস্যা। যার সমাধান আমার হাতে নেই। আমি জড়াতে চাইছিলাম না। আমার পরিবার ওকে আশ্রয় দিতে রাজী হবে মনে হয় না। আমার মা খুব কড়া। আমি এখনো বিয়ে করিনি। কিন্তু কোনো মেয়েকে আমি বাসায় এনে তুলবো, সেটা যে কারণেই হোক, এটা কিছুতেই মেনে নেবে না।
এটা কেউ বিশ্বাস করবে না যে প্রেম ভালোবাসাজনিত সম্পর্ক ছাড়া কোন এক মেয়ে এভাবে কারো কাছে চলে আসতে পারে। অন্যদের কথা কি বলবো, আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মেয়েটা কোন ভরসায় আমার কাছে আশ্রয় নিতে চাইছে।
বিপদে পড়ে সাময়িক আশ্রয় নিচ্ছে, এই কথাটা কোনও মানুষই বিশ্বাস করবে না। বাসায় গিয়ে জেনে এসে সিদ্ধান্ত নেবার অবকাশ নেই। এই মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বড়জোর এক ঘন্টা সময় হাতে। টেবিলের ওপর দুটো কনুইয়ে ঠেস দিয়ে ওপাশের চেয়ারে বসে আমার দিকে ব্যাকুলভাবে চেয়ে আছে শ্রাবণী। কিন্তু যে সমাধানের জন্য সে আমার দিকে তাকিয়ে, তার কোন সূত্র আমার জানা নেই। ওকে অসম্ভব বলে ফিরিয়ে দিতেও পারছি না। যে মানুষ এমন করে কারো কাছে আশ্রয় চায়, তাকে নিয়ে কী করা উচিত আমি জানি না।
শ্রাবণী মুখ ফুটে না বললেও ইঙ্গিত দিয়েছে আমার ঘরে আশ্রয় নেবার জন্য বউ হতেও তার আপত্তি নেই। যদিও আমি ঘুণাক্ষরেও সেটা ভাবার সাহস পাই না। প্রথমত আমার পরিবার তখনো আমার বিয়ে নিয়ে কোন ভাবছিল না। পরিবারে আমার দায়িত্ব অনেক বেশি। আমার ছোট অবিবাহিত বোন আছে, পড়াশোনা শেষ হয়নি তাদের এখনো। তাদের বিয়ে দেয়া ছাড়া নিজে বিয়ে করাটা দায়িত্বহীনতা। বাবা বেঁচে থাকলে অন্য ব্যাপার হতো। বাবার অবর্তমানে আমাকে অনেক বেশি দায়িত্ব মাথায় নিতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শ্রাবণীর সৌন্দর্য এতই প্রবল যে আমার চেয়ে অনেক বেশী উপযুক্ত পাত্রের সাথে ওর বিয়ে হওয়া উচিত। তাছাড়া তার বাগদান হয়েছে একজনের সাথে। যদিও সে ওটাকে মেনে নেয়নি।
দুঘন্টা কেটে যায় আলাপ করতে করতে। এই সময়ের মধ্যে আমি শ্রাবণীকে বোঝার চেষ্টা করি, শ্রাবণী আমাকে বোঝার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ওর মুখে হাসি ফোটে। নির্ভরতার হাসি। আমি অবাক হই কিছুটা। এরকম সময়েও কেউ হাসতে পারে? হয়তো ওকে সময় দিয়ে কথা শুনছি, তাতেই দুশ্চিন্তার ভার অনেকটা লাঘব হয়েছে তার। দিশেহারা অবস্থা মনে হলেও আমিও হাসলাম। অভয় দেবার হাসি। পথ খুঁজে দেবার হাসি। কিন্তু পথ কোথায়? উপায় কী?
জীবনে প্রথম এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। যে কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই, সেই কাজে আমার মাথা খাটাতে হবে। খুব জটিল একটা বিষয়। প্রাণের হুমকি বিদ্যমান। যাদের কথা শ্রাবণী বললো, তাদের অনেক ক্ষমতা। গুম খুন করে ফেলা কোন ব্যাপার না। তাদের কাছ থেকে শ্রাবণীকে কোথাও লুকিয়ে ফেলতে হবে ধরা পড়ার আগেই। যেখানে বসে আছি, সেই জায়গাটিও নিরাপদ কিনা জানি না। এখানেও তাদের আনাগোনা থাকতে পারে। এই জায়গা থেকেও সরে যেতে হবে। আমি অফিসের কাজের অজুহাতে বেরিয়েছি। পাশেই অগ্রনী ব্যাংক। ওখানে আমার কাজ থাকে নিয়মিত। কিন্তু ওদিকে যাওয়া যাবে না এখন। অন্য কোন কাজই করা যাবে না এটা শেষ না করে। ভয়ডর সব উবে গেল। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। দায়িত্ববোধ জেগে উঠলো প্রবলভাবে।
আমি বললাম -তুমি এসব কথা অফিসের কাউকে বলোনি? তোমার বসকে বলতে পারতে। কিংবা অ্যাকাউন্টসে যিনি তোমাকে ভালো জানেন। আরো তো অনেকেই আছে তোমাকে গাইড করার।
সে বললো, -আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কাউকে না। বললেই ফাঁস হয়ে যাবে। পুরো অফিসে আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। আপনি ছাড়া আমি আর কারো কাছে ভরসা খুঁজে পাইনি।
বললাম- কিন্তু আমার সাথে তোমার তো জানাশোনা নেই, কখনো তেমন করে কথাও হয়নি। তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। শুধু নামটা জানতাম।
-আমাকে আপনি জানেন না, কিন্তু আপনাকে আমি কয়েকদিনেই চিনেছি। আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আপনি অন্যদের মতো আমার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি, কখনো আমার সাথে তেমন আলাপ করেননি। কিন্তু আপনার কাছে আমি ভরসা করার একটা পথ পেয়েছি সেদিন থেকে, যেদিন আপনি আমার কফি বানানো নিয়ে অফিসের কোরিয়ানদের ধমক দিলেন। সেদিন মনে হয়েছে হয়তো আপনার ভেতরে আমার জন্য কোথাও একটা মমতা আছে। কোরিয়ান কোম্পানীতে চাকরী করে তাদের বিরুদ্ধে হুংকার দেয়া সহজ কাজ নয়। আপনার সাহসের উপর আমার শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছিল সেদিন থেকেই। তাছাড়া, কিছু মানুষ আছে যাদের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় মানুষটাকে ভরসা করা যায় কিনা। মেয়েরা এসব একটু বেশীই বুঝতে পারে। এত মানুষের ভিড়ে আমি তাই আপনার কাছেই আশ্রয় চেয়েছি।
কথাগুলো শুনতে নাটক সিনেমার মতো লাগছিল। কিন্তু বিষয়টা যে বাস্তব সত্য সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থাকলাম। একটা মেয়ে আমার ওপর এতটা ভরসা করেছে, তাকে বাঁচানোর পথ বের করা উচিত যে কোনও উপায়ে। হাতে সময় নেই। দ্রুত কিছু একটা উপায় বের করতে হবে। মিনিট কয়েকের মধ্যে একটা পরিকল্পনা করে ফেললাম। জানি না কাজ হবে কিনা। প্রশ্ন করলাম-
- শ্রাবণী, আমি তোমার জন্য কী করতে পারবো জানি না। তবে একটা পথ যদি বাতলে দেই তাহলে তুমি সেটা ধরে আগাবে?
- আমার সমস্ত জীবনটাই তো আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।
- প্রথমে বলে নিচ্ছি, আমি দুঃখিত যে তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারছি না। ওখানে আমার মা বোন সবাই আছে ঠিক। কিন্তু তোমাকে নিয়ে তুললে নানান প্রশ্ন উঠবে। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কী, এসব বিষয় আমাদের সমাজ এখনো সহজভাবে নেয় না। আমার মা এসব ব্যাপারে খুব কড়া। কাউকে বোঝানো যাবে না যে আমাদের মধ্যে সেরকম কোন ব্যাপার নেই। ফলে রাগারাগি অশান্তি এসব হবে। তুমি ওখানে ভালো থাকবে না। আমি নিজের পরিবারে তোমাকে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না। আমি একটাই উপায় দেখতে পাচ্ছি, চট্টগ্রাম থেকেই তোমাকে সরে যেতে হবে। কাজটা সহজ নয়। সারাদেশে বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ বলা চলে। ট্রেন চলছে কিনা জানি না। আমি খোঁজ নেবো। কিন্তু কোথায় সরে যাবে সেটা নিয়ে একটু ভাবছি। তোমার তো বাগদান হয়েছিল একজনের সাথে। তিনি ঢাকায় আছেন। তুমি কী তার কাছে ফিরে যেতে পারবে? তুমি একা যেতে পারবে না। আমিও তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো না। কিন্তু তুমি যদি একটা চিঠি লিখে তাঁকে সবকথা জানাও, তিনি কী আসবেন তোমাকে নিয়ে যেতে?
এক টানে সবগুলো কথা বলে ফেললাম। খুলে না বলে উপায় ছিল না। আমার পরিবার সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। আমার বাসার অবস্থা সম্পর্কে তার জানা থাকলে বিকল্প পথটা বেছে নেয়া সহজ হবে। যার সাথে ওর বাগদান হয়েছিল তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সেই মানুষটা যদি ওর কাছে মোটামুটি গ্রহনযোগ্য হয় তাহলে এই বিকল্পটা কাজ করবে। সে আমার প্রস্তাব শুনে বিষণ্ন চোখে হাসলো।
- আমি জানি না নাসির আসবে কিনা। কিন্তু আর কোনও বিকল্প যদি না থাকে তাহলে ওকে লিখতে পারি।
এটাই শোনার দরকার ছিল। আমি তখন প্রস্তাবের বাকীটুকু বললাম।
- তাহলে তুমি এখনই কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখো একটা। আমি চিঠিটা জিপিওতে গিয়ে জরুরী ডাকে পোস্ট করে দেবো। তোমার চিঠি পেলে তিনি নিশ্চয়ই আসবেন। যদি না আসে তখন অন্য বিকল্প ভাববো। আপাতত চিঠিটা লিখো। সাথে আমিও একটা চিঠি দেবো তাঁকে। তারপর দেখা যাক। তবে নাসির সাহেব যদি আসেন, তাহলে তুমি তার সাথে ঢাকা চলে যাও। সেখানে গিয়ে বিয়ের কাজটা প্রথমেই সেরে ফেলবে। তারপর অন্য কথা।
শ্রাবণী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো মাথা নীচু করে। সে ভাবছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে। আমি ওর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। অবশেষে মাথা তুলে তাকালো সে। চোখে সম্মতি। কিছুটা বিষন্নতাও কী? তবু রাজী হলো। ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর কলম বের করে এক পাতা চিঠি লিখে নাসির সাহেবকে সব জানালো। আমি আরেকটা কাগজ নিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কয়েক লাইনে তাঁকে বললাম ওর বিপদের কথা। তিনি যেন জরুরী ভিত্তিতে চিঠি পাওয়ামাত্র এসে শ্রাবণীকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
চিঠি লেখা শেষ করে পরিকল্পনার শেষটুকু বললাম- এবার তোমাকে দুদিন একটু অভিনয় করতে হবে। আমি তোমাকে এখন তোমার বাসায় পৌঁছে দেবো। তুমি একদম স্বাভাবিক হয়ে থাকবা। যেন কিছুই হয়নি। আগামীকাল থেকে নিয়মিত অফিসে আসতে শুরু করো। সবাইকে বলবা তুমি ওই সন্ত্রাসীকে বিয়ে করতে রাজী, তবে পরিবারের সম্মতি নেবার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে।
প্রস্তাবে রাজী হলো সে। আমি ওকে নিয়ে ব্যাগ হাতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে নীচে টেক্সি স্ট্যাণ্ডের দিকে গেলাম। হঠাৎ করে আমার এক কলিগের মুখোমুখি। ধরা পড়ে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডে সামলে নিয়ে আপদমস্তক বোরকায় ঢাকা শ্রাবণীর দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘আমার খালা, দেশের বাড়ি যাবে গাড়িতে তুলে দিতে যাচ্ছি।’
ভাগ্যিস শ্রাবণী আমার পেছনে আড়ালে চলে গিয়েছিল। নইলে বোরকায় মুখ ঢাকা চেহারা দেখেও চিনে ফেলতো কলিগটা। আমি টেক্সি ঠিক করে ওকে নিয়ে আকমল আলী রোডের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলাম। তারপর নিউমার্কেটের পাশে জিপিওর দিকে টেক্সি ছোটালাম। চিঠিটা যত দ্রুত পোস্ট করতে হবে। গ্যারান্টেড এক্সপ্রেস পোস্ট। অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে গেছে। দিনরাত বৃষ্টি তখন। ৯৮ সালের সেই ভয়ানক বন্যার সময়কার ঘটনা। জিপিওতে চিঠিটা পোস্ট করে ফিরে এলাম দুপুরের পরপর। অফিসে কোন কাজ হয়নি সেদিন। ভাগ্যিস কেউ খেয়াল করেনি। ভিজে বেড়াল হয়ে বাকী সময়টা কাটালাম অফিসের কাজে।
পরদিন থেকে শ্রাবণী অফিস করতে লাগলো স্বাভাবিকভাবে। যেন কিছু হয়নি। কেউ কিছু টের পেলো না। কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না। আমরা দুজন প্রকাশ্যে অফিসে কথাবার্তা বলবো না এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে আমার একই রুমে কাজ করে, কিন্তু আমরা কেউ কারো দিকে তাকাই না।
দুদিন পর সন্ধ্যার সময় অফিস ছুটির কালে সে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় সবার অলক্ষ্যে একটা চিরকুট রেখে গেল আমার সামনের ডেস্কে। আমি সতর্কতার সাথে চিরকুটের ভাঁজ খুলে দেখলাম পেন্সিলে কয়েকটা লাইন - ‘চিঠি পেয়েই নাসির চলে এসেছে। আগামীকালই আমরা চলে যাচ্ছি।’
অফিস থেকে বিদায় নেবার সময় আর কোন কথা হলো না। সে দূর থেকে একটু মুচকি হাসি দিল। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। আমিও ফিরতি হাসি দিলাম। মমতাময় দৃষ্টিতে। মনে মনে বললাম, ভালো থেকো মেয়ে।
সেই শেষ। আর কখনো দেখা হয়নি শ্রাবণীর সাথে। আমার জীবনের সবচেয়ে সফল রেসকিউ অপারেশন। শ্রাবণী নিরাপদে চলে যেতে পেরেছিল। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবেই সব করেছে। কী করে জানলাম?
এই ঘটনার দিন পনেরো পরে গেট থেকে সিকিউরিটি একটা হলুদ খাম এনে আমার টেবিলে রেখে বললো- আপনার চিঠি। প্রেরকের নামটা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। ঠিক সেই সময়ে আমার পাশে বসা ছিল আমার এমন এক কলিগ যিনি শ্রাবণীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তিনি কার চিঠি কার চিঠি বলে তিনি উঁকি দিতে চাইলে আমি চট করে ড্রয়ারে লুকিয়ে ফেললাম চিঠিটা। কলিগ ঠাট্টার সুরে বললেন - ‘কি মিয়া প্রেমের চিঠিপত্র নাকি?’ আমি লা জওয়াব। শুধু হাসলাম।
সবাই সরে গেলে চিঠি খুলে পড়তে লাগলাম। শ্রাবণী জানিয়েছে আমার কথামত সব করেছে। গিয়েই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেছে নাসির সাহেবের সাথে। এখন সে স্বামীর বাসায় উঠেছে। আমার কাছে তার কৃতজ্ঞতার কোন সীমা নেই। ভবিষ্যতে কখনো দেখা হবে আবার, সে আশা প্রকাশ করে চিঠি শেষ করলো।
আমি বিজয়ের হাসি নিয়ে সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। কখনো ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলিনি এই ঘটনা। শ্রাবণীর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। ওর ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছি। চিঠিটাও কোথাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু জীবনের একটা অন্যতম তৃপ্তিকর ঘটনা হিসেবে জেগে আছে এখনো।
অড্রে হেপবার্নের সেদিনের অপেক্ষাটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সংকটময় অপেক্ষা। তাকে সংকট থেকে উদ্ধার করার ঘটনাটি ছিল আমার জীবনের সফলতম অপারেশন। অড্রে হেপবার্ন এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে!