Sunday, February 27, 2011

(আউট) বই কেনা

নাহ, এইবার বইমেলায় যাওয়াই হলো না!! কপালের দোষ নাই। আসল কথা, অফিস ফাঁকি দেবার কোন সুযোগ করতে পারি নাই। এই মাসের ফাঁকির বাজেট শেষ। মাসে একদিন নিয়ম করে অফিস ফাঁকি দেবার চেষ্টা করি। মাসটা আটাশে হওয়াতে বাজেটে টান পড়ছে। বই মেলা নয়, বইকেনা নিয়ে একটা বকরবকর পোষ্ট লিখতে ইচ্ছা হইল। পুরান কথা নিয়ে একটা চুইংগাম পোষ্ট।
‍ ‍= = = =

বই কিনে দেউলিয়া হবার কোন সম্ভাবনা আমার ছিল না, কারণ দেউলিয়া বড়লোকের কারবার। আমি তার ধার দিয়েও ছিলাম না।

বই কেনা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ মধ্যবিত্ত পরিবারে। যাদের 'আউট বই' পড়ার নেশা আছে কিন্তু বই কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের মর্মবেদনা আমার খুব ভালো করেই জানা। তবে টাকা না থাকার অন্ততঃ একটা ভালো দিক হলো, না পাওয়া জিনিসের প্রতি আমাদের হাহাকার থাকে সবচেয়ে বেশী। টাকার টানাটানিতে বই পড়ার তৃষ্ণাটা প্রলম্বিত হয়েছিল।

মাঝে মাঝে দার্শনিক চিন্তা ভর করতো। 'টাকা নেই কিন্তু বই পড়ার তৃষ্ণা আছে' এবং 'টাকা আছে কিন্তু বই পড়ার তৃষ্ণা নেই', এই দুই দলের মধ্যে ভাগ্যবান কে?

বইকেনা নিয়ে টাকাপয়সার এই টানাটানির আরেকটা মধুরতম দিক হলো শেলফে সাজানো প্রতিটা বইয়ের পেছনে একেকটা গল্প আছে। আর দরিদ্র মানুষের গল্পগুলি সাধারণতঃ আকর্ষনীয় হয়, আর্ট ফিল্মের মতো। স্কুল কলেজের বই কেনার টাকা বাবার হোটেল থেকে নির্বাহ করা হলেও 'আউট বই'য়ের জন্য কোন বরাদ্দ ছিল না। তাই স্কুলে থাকতে বেশীরভাগ আউট বই পড়া হয়েছে আত্মীয়-বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে। নিজের তেমন কোন সংগ্রহ ছিল না স্কুল বয়সে। মাঝে মধ্যে বাবার টাকায় যদি কোন আউট বই কেনা হতো সেটা অবশ্যই বিজ্ঞানের বা শিক্ষামূলক বই হতো।

কলেজে ওঠার পর রিকশাভাড়া দৈনিক বাজেট দশ টাকা। বাসে আসা যাওয়া করলে সাত টাকা সাশ্রয়। তাই রিকশা বাদ দিয়ে বাসে চড়া শুরু করি। ওই সাত টাকায় বন্ধুদের সাথে চা সিঙ্গাড়া আড্ডাবাজি। একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ফুটপাতে পাতলা কভারের একটা চটি বই চোখ কাড়ে। নাম 'তানিয়া'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা রাশিয়ান বিপ্লবের একটা করুণ ঘটনা নিয়ে লেখা অসাধারণ মানবিক কাহিনীর অনুবাদ। প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে এত মুগ্ধ হলাম যে পাঁচ টাকা দিয়ে নিউজপ্রিন্টের বইটা কিনেই ফেলি। নিজের টাকায় কেনা প্রথম বই। ছোট্ট সেই চটি বইটা আমার পড়াশোনার জগতের মধ্যে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল।

দিন দিন আউট বইয়ের চাহিদা আরো বাড়তে থাকলেও টাকার যোগান নেই। একেকটা বই কিনতে ঘাম ছুটে যেতো। অন্যদের দেখতাম বইয়ের দোকানে গিয়ে নাম ধরে বই খুজছে, অমুক লেখকের তমুক বই। আর আমি দোকানের চিপায় চুপায় নীচে মেঝেতে অবহেলায় পড়ে থাকা পুরোনো সংস্করনের বই খুঁজি। এটা আমি বেশ উপভোগ করতাম। প্রতিবার কারেন্ট বুক সেন্টারে গেলে কোন না কোন পুরাতন বই আবিষ্কার করতাম। সেই সস্তা বইগুলো দেখা যেত নতুন বের হওয়া বইগুলো থেকে এগিয়ে থাকতো। সৈয়দ মুজতবা আলী কিংবা আবুল মনসুর আহমদের আমলের বইগুলো সংগ্রহ করা গেছে সেভাবেই।

পাঁচটাকা দিয়ে শুরু করে পনেরো টাকা ছিল প্রাথমিক রেঞ্জ। বিশ টাকার উপরের বইয়ের দিকে তাকাতাম না নাগালের বাইরের জিনিসে কখনোই হাত বাড়াতে ইচ্ছে করতো না। এমনকি এক পৃষ্টা পড়ে জিনিসটা চেখেও দেখতে ইচ্ছে করতো না। যেটা আমার হবে না ওদিকে খামাকা তাকিয়ে কাজ কি?

একটা ঘটনা বলি। তখন কলেজ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। একবার নিউমার্কেটের এক দোকানে গিয়ে বাংলাদেশের ছোটগল্প নামের মোটাসোটা একটা বই চোখে পড়ে গেল। গল্পের তালিকায় চোখ বুলিয়ে আমি বইটার প্রেমে পড়ে গেলাম। গত একশো বছরের ক্লাসিক সব ছোটগল্পের সংকলন। অনেক পুরোনো সংস্করন বলে দাম চল্লিশ টাকা মাত্র।

কিন্তু চল্লিশ টাকাও অগম্য আমার। পকেটে ছিল বিশটাকা। এরকম বই বেশীক্ষণ থাকবে না, পরের বার আসলে নাও পেতে পারি। কি করি? বিশ টাকা বাকীতে দেবে না। বইটা ছেড়েও আসতে পারছি না। পরে লজ্জার মাথা খেয়ে পাশের এক পরিচিত দোকান কর্মচারী থেকে ২০ টাকা ধার নিয়ে বইটা কিনলাম। এখনো বইটা ছুঁয়ে দেখলে ২২ বছর আগের স্মৃতির গন্ধ পাই, মনে হয় মাত্র গতকাল!

আরেকবারের কথা। বইয়ের খিদে পেল খুব। গরীবের খিদা বেশী, খাবার কম পকেট থাকে খালি। বাসা থেকে সাপোর্ট পাওয়ার কোন রাস্তাও দেখি না। তখন চোখে পড়লো তাকের উপর ইন্টারমিডিয়েটের মোটা গাবদা পদার্থবিজ্ঞান বইটা অপদার্থের মতো শুয়ে আছে। দেড় কেজি ওজনের বইটা তখনো প্রায় নতুন (আমার প্রায় সব একাডেমিক বই নতুনই থাকতো পড়াশোনা করে ওদের বেশী কষ্ট দিতাম না বলে)।

বইটা পলিথিনে ভরে সোজা আন্দরকিল্লা পুরোনো বইয়ের দোকানে। সেখানে দেড়শো টাকার বইটা বিশ টাকায় রফা করে, সে টাকায় শওকত আলীর 'যাত্রা' কিনে ফিরে আসি। একদিনের খিদা মিটলো।

সস্তার তিন অবস্থা। বইয়ের ক্ষেত্রে একদম ভুয়া কথা। আমি বলি সবচেয়ে সস্তা বইগুলিই সবচেয়ে মজাদার। মুক্তধারা, বাংলাএকাডেমী,বইঘর এইতিনটা ছিল সস্তার প্রথম পছন্দ। গুগল প্লেকস নামে মুক্তধারার একটা বই কিনেছিলাম। মাত্র দুই টাকা দামের বইটা আমার বইকেনা ইতিহাসের সবচেয়ে সস্তা বই। ওখান থেকে জেনে চমৎকৃত হয়েছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংখ্যার নাম নাকি গুগল প্লেকস(googolplex)।

কষ্টের টাকায় বই কেনা যেরকম আনন্দ, তার পাঁচগুন কষ্ট যদি সেই বই কেউ হাপিশ করে দেয়।

গ্রুপ থিয়েটার করতাম একসময়। সেই দলের এক পড়ুয়া বড়ভাই বই নিয়ে অপমানজনক কথা শোনালো একদিন। কি এক তর্কে বদ্দা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বললো, তুই তো এখনো সুনীল-শীর্ষেন্দু-আবুলবাশার পড়িস নাই, তোর সাথে কিসের বই তর্ক। যা, আগে সুনীলের 'সেই সময়' পড়ে আয়!

কথাটা সত্য বলেই গায়ের চামড়া জ্বলে গেল। আসলেই ওই বাংলার তেমন কোন বই পড়িনি তখনো। অত দাম কে কিনে? বইটা দোকানে সাজানো দেখে মনকে বলেছি, "চোখ সামালে রাখো। আড়াইশো টাকা দাম ওটার। তুমি পঞ্চাশ টাকার বইতেই যেতে পারোনি এখনো"।

আজব কান্ড। বদ্দাকে জবাব দিতেই যেন কদিন পরেই আচমকা একটা দৈব প্রাপ্তিযোগ ঘটলো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনশো টাকার অপ্রত্যাশিত কামাই। টাকাটা দ্রত তুলে নিয়ে সোজা 'কারেন্ট বুক সেন্টার'। বীরদর্পে সুনীলের 'সেই সময়' নিয়ে বাসায়। প্রায় গোগ্রাসে গিলে হজম করি বইটা। এত ভালো লেগেছিল যে বইটা পড়ার পর কিছুদিন উনিশ শতকের উপর ঘোর চলে এসেছিল। কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতোম পেঁচার নকশা' পড়ার আগ পর্যন্ত ঘোরটা লেগেই ছিল।

একদিন সেই বইটা আরেক বিদ্যামাস্তান বদ্দা ধার নিল। তার কাছ থেকে থেকে নিল আরেকজন, তার থেকে আরেকজন.......এভাবে বইটা ক্রমাগত কয়েক হাতে যাবার পর শোনা গেল সে নিখোঁজ হয়ে গেছে কোন এক মার্ক টোয়েনের হাতে। কষ্টটা গেঁথে ছিল অনেকদিন।

আরো লিখতাম কিন্তু মার্ক টোয়েনের নাম এসে গেছে বলে ক্ষ্যামা দিলাম। এই গুরুর কথা লিখলে আরো কয়েক পৃষ্টা গড়াতে কাহিনি। সেটা অন্য কোনদিন।

No comments: