Sunday, December 22, 2024

মূর্খতার প্রতিযোগিতা

সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষের উদাহরণগুলো ধারণ করে না উপমহাদেশের অসভ্য নির্বোধ মূর্খ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো। সাধারণ শিক্ষিত মানুষের ভেতরেও সফলতার সাথে এইসব মূর্খতার সফল অনুপ্রবেশ ঘটাতে পেরেছে এরা। একশো বছর আগে উপমহাদেশে যেসব শিক্ষা সভ্যতা আলো প্রবেশ করেছিল, এই সময়ে সেই জায়গাগুলো কালিমালিপ্ত হয়ে গেছে। অন্তত কিছু মানুষের চোখে এইসব অন্ধতা গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। এদের হাস্যকর অন্ধযুক্তিগুলো নিয়ে এরা ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকবে বাকী পৃথিবী থেকে। মূর্খতার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

Friday, December 13, 2024

এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী



না সজনী,না,আমি জানি জানি,সে আসিবে না।
এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী,বাসনা তবু পূরিবে না।
জনমেও এ পোড়া ভালে কোন আশা মিটিল না॥
যদি বা সে আসে,সখী,কী হবে আমার তায়।
সে তো মোরে,সজনী লো,ভালো কভু বাসে না--জানি লো।
ভালো ক'রে কবে না কথা,চেয়েও না দেখিবে--
বড়ো আশা করে শেষে পূরিবে না কামনা॥

পাপিয়া সারোয়ারের কন্ঠে এই গানটা আমার কানে স্থির হয়ে আছে । তাঁকে কখনো মুখোমুখি দেখিনি। কিন্তু কৈশোর থেকে রেডিওতে বহুবার শুনেছি গানটা। গানটা আর কারো কন্ঠেই এত ভালো লাগেনি। ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে তিনি চলে গেলেন। একই দিনে আমার আরেকজন প্রিয় মানুষের প্রস্থান ঘটলো। সেও অনেক বাসনা পুরণ না করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।


পাপিয়া সারোয়ার চলে যাবার খবরটা পেয়েছি লেখক ইমতিয়ার শামীমের পোস্ট থেকে। সেটাই তুলে রাখলাম এখানে।

সেই কৈশোরেই আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল, ‘জনমেও এ পোড়া ভালে, কোনো আশা মিটিল না’; জানা হয়ে গিয়েছিল, ‘এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী, বাসনা তবু পুরিবে না’; জানা হয়ে গিয়েছিল— কেননা এমন কোনও দিন ছিল না, যেদিন একজন পাপিয়া সরোয়ারের কণ্ঠ বেতারে শোনা যেত না, ইথারে ভেসে ভেসে ধরা দিত না আমাদের শ্রুতিজগতে।
গাঁয়ে আমার মা-বাবা বাড়ির পূবদুয়ারি যে ঘরটির দক্ষিণদুয়ারি একটি কোঠায় একদা আমি বাস করতাম, যে ঘর কিংবা কোঠার কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই, সেখানে কখনো লালরঙা রেডিওটায় ‘ হোল না লো হোল না লো সই ‘ বেজে উঠলেই বাড়ির ভেতরের উঠান থেকে ভেসে আসত কাজের মেয়ে কোমেলার তীব্র হাসি; কিন্তু কখনো সেই একই কণ্ঠ ‘নাই টেলিফোন নাই রে পিওন নাই রে টেলিগ্রাম’ গেয়ে উঠলে তাকে আর হাসতে দেখা যেত না।
তখন খুব বেশি মানুষজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন না, গাইতেন তো একেবারেই হাতেগোণা কয়েকজন। কিন্তু আমাদের অজ পাড়া গ্রামটিতে অদ্ভূত এক কারণে সবাই রবীন্দ্র সঙ্গীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। গাঁয়ের রাখালদেরও যখন-তখন দেখা যেত গরু চড়াতে চড়াতে গাইছে, ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগলপারা...’, গাইছে ‘ ভেঙে মোর ঘরের চাবী, নিয়ে যাবি কে আমারে...’। ছায়ানটের একেবারে প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন আমাদের এক ফুফাতো ভাই, যাকে আমরা ডাকতাম ঢাকার খোকন ভাই নামে। কী যে তাঁর হয়েছিল, লেখাপড়া বাদ দিয়ে গাঁয়ে গিয়ে থেকেছিলেন তিনি বছরের পর বছর। কামরুল হাসানের ব্রতচারী বিদ্যায় দীক্ষিত সেই ভাই সকাল বিকাল শুধু ব্যায়াম করতেন আর হারমোনিয়ামে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। আরও একটা কাজ ছিল তাঁর, গাঁয়ের পুকুর আর জলাভূমিতে ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরে বসে থাকতেন পারে। অমন গভীর মনযোগ দিয়ে মাছ ধরতে আমরা আর কাউকেই দেখিনি। কী অদ্ভূত, গোপীবাগের সেই খোকন ভাইয়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়াকে ভ্যাঙচাতে ভ্যাঙচাতেই আমরা গাঁয়ের আপামর জনগণ বেসুরো কিন্তু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়লাম রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে।
ওই বয়সে, খোকন ভাই যখন বলতেন, একেবারে মুখোমুখি বসে গান শুনেছেন পাপিয়া সারোয়ারের, তখন খুব অবাক হয়ে যেতাম—সত্যি বলছে তো?!
যেভাবে হুট করে এসেছিলেন, কয়েক বছর বাদে তেমনি হুট করে আবারও গোপীবাগমুখো হলেন খোকন ভাই। আমি বলি, সেদিন থেকে আমাদের গাঁয়ের মানুষজন হারাতে শুরু করল মাছ ধরার অপরিসীম ধৈর্য্য, হারাতে বসল জীবনের সুর ও রবির প্রাণশক্তি। তবু বেতারে পাপিয়া সারোয়ার কিংবা কাদেরী কিবরিয়ার কণ্ঠ ভেসে আসত, আর আমরা উপলব্ধি করতাম, ‘বাসনা তবু পুরিবে না।’
তারপর বয়স বেড়েছে, আরও কতজনের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেছি, কবে যে প্রিয় শিল্পীর গান বেছে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, শুনতে শুনতে কবে যে পাপিয়া সারোয়ারের কথা ভুলে গেছি, তা আর বলতে পারব না। কিন্তু এখন দেখছি, না, তাকে ভুলে যাইনি, হারিয়েও ফেলিনি; মনে করিয়ে দিলেন অন্তরতর তিনি; মনে করিয়ে দিলেন ‘বড় আশা করে শেষে পুরিবে না কামনা।’
পাপিয়া সারোয়ার
(২১ নভেম্বর ১৯৫২—১২ ডিসেম্বর ২০২৪)

Tuesday, October 22, 2024

শেয়াল ও শকুনের রাজত্বে

এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা হলো মানুষকে মানবিক, যৌক্তিক এবং একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারা। আদিকাল থেকে জেনেটিক কারণে এই অঞ্চলের মানুষেরা দুই রকম। একদল খুব সরল, আরেকদল খুব গরল। সরলদের একাংশ প্রায়ই গরলদের পাল্লায় পড়ে বলদে পরিণত হয়। সেই বলদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এদেরকে নানান হাটে বিক্রি করা যায়। কেউ বিক্রি হয় ধর্মের হাটে, কেউ বিক্রি হয় রাজনীতির হাটে, কেউবা প্রতারণার হাটে। মতলববাজরা এখানে সবসময় সফল হয়। একসময় অশিক্ষিত বলদের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন শিক্ষিত বলদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশে এমনসব উচ্চশিক্ষিত বলদ আছে, তাদের শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্র যে ব্যয় করেছে সেটা পুরোপুরি অপচয়। শিক্ষিত বলদ চেনার জন্য ফেসবুক সবচেয়ে উপযুক্ত হাট। ফেসবুকের হাটে পালে পালে বলদের দেখা মেলে, যারা নিজ নিজ খোয়াড়ের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে নানান হাস্যকর যুক্তি উপস্থাপন করে। 

সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নির্মোহ যুক্তিসঙ্গত মানুষের সংখ্যা এতই কম যে, এদেরকে খালি চোখে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনুবীক্ষণিক জীব হয়ে অদৃশ্য জীবনযাপন করে। তাদের যুক্তির কথা কোনো বলদের কানে পৌঁছায় না। ফলে কোনো না কোনো মতলবাজ এদেশে ফটকাবাজী করে যায় সারা বছর। গত অর্ধ শতাব্দী এমনই চলছে। এই বলদদের নেতা হয় শেয়াল শকুনের দল। তাদের পেছনে নিয়ে কেউ কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত দখল করে। তাই আমরা দেখি এক শেয়াল যাবার পর আরেক শকুন আসে। শেয়ালপর্বের বলদেরা শকুনের বিরুদ্ধে, শকুনপর্বের বলদেরা শেয়ালের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। বাংলাদেশ এই সব বলদের কারণেই কখনো শেয়াল ও শকুনমুক্ত হতে পারলো না। আগামীতেও পারার কোনো লক্ষণ এখনো দেখছি না। যে ছেলেটা কিশোর বয়সে দারুন যুক্তিবাদী স্মার্ট হিসেবে বড় হচ্ছিল, সে তারুণ্য পেরোবার আগে শকুন বা শেয়ালের পাল্লায় পড়ে বলদে পরিণত হয়। তাদের ইশারায় সকল তৎপরতা চালায়। তার নিজস্বতা বলে কিছু দেখা যায় না। 

আমরা জানি আবার নতুন কিছু ঘটবে। এই বলদেরাই আবার ঢুশাঢুশি করবে। এখন কিছু অবসরপ্রাপ্ত বলদও দেখা যাচ্ছে, যারা শেয়াল ও শকুনের হাতিয়ার হিসেবে জোয়াল টেনে যাচ্ছে। যে শেয়াল এতদিন গর্তে ছিল, তারা বেশিয়ে এসেছে, যে শকুন এতদিন লাশের সন্ধানে ছিল, তারা অনেকগুলো লাশ পেয়েছে। শেয়াল-ও শকুনের রাজত্বে মানুষেরা গৃহবন্দী হয়ে থাকে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের প্রজন্ম মানুষের শাসন দেখেছে খুব অল্প সময়ের জন্য। আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো পুরোটাই শকুন রাজত্ব দেখবে। তাদের জন্য সমবেদনা।


Thursday, October 17, 2024

ইতিহাস=অতীত

 ইতিহাস=অতীত। যাহাই অতীত, তাহাই  ইতিহাস। 


অতীতকালের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এটা পৃথিবীর যে কোনো শক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আপনি ভবিষ্যতকে বদলাবার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু অতীতকে এক বিন্দুও বদলাতে পারবেন না। কিছুতেই না। অতীতকে কেউ জোর করে তৈরি করতে পারে না, কেউ জোর করে মুছতেও পারে না। মিথ্যে ইতিহাসকে জোর করে গেলানোও অসম্ভব সেটাও বারবার প্রমাণিত।


অধিকাংশ তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানরা ইতিহাসকে নিজেদের মতো লিখতে চেষ্টা করে। এটা একটা মূর্খতা কিংবা হাস্যকর মানবিক দুর্বলতা।


মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধান স্তম্ভ। সেই স্তম্ভে কার কী ভূমিকা ছিল, সেটা লেখা হয়ে গেছে। মিথ্যে শব্দে কাগজের ইতিহাস নয়, সময়ের খাতায় লেখা ইতিহাস। 


ইতিহাস আজকে যে সত্য বলবে, একশো বছর পরও সেই সত্য বলবে, পাঁচশো বছর পরেও তাই বলবে। মানুষ সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে বেশি দূরের জিনিস দেখতে পায় না। 


সভ্যতার নিরিখে ১০০ বছর কোনো সময়ই না। এক হাজার বছর পর বাংলাদেশের গত ১০০ বছরের সকল ঘটনার মধ্যে হয়তো মাত্র একটা টিকে থাকবে। যদি একটি মাত্র ঘটনাপর্ব টিকে থাকে তাহলে সেটি হবে ১৯৭১ সাল। একাত্তরে কার কী ভূমিকা ছিল সেটা কোনো রিসেট বাটনে টিপ দিয়ে বদলানো যাবে না। ইতিহাস নিজের শক্তিতেই টিকে থাকবে। কোনো ক্ষমতাবানের শক্তি নেই তাকে বদলানোর। যুগ যুগ ধরে যারা নিজস্ব ন্যারেটিভ তৈরি করে বদলানোর চেষ্টা করেছে তারাই ইতিহাসের নর্দমাতে ঠাঁই পেয়েছে। 


 ব্যক্তিগতভাবে আমি অন্তত ৭৫-৮০টি দেশের ইতিহাস পড়েছি। তাতে যা দেখেছি ইতিহাস কীর্তিকেই ধারণ করে। সুকীর্তির কারনে ব্যক্তিকে মনে রাখে।  ক্ষমতাবানদের বুদ্ধি থাকলে তারা ইতিহাস বদলানোর চেষ্টা না করে সুকীর্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করতো। তাই ইতিহাস বদলানোর সংকট নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত থাকি না।


Monday, September 30, 2024

লেভান্টের দানব

ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে যেখানে তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, প্যালেস্টাইনের অবস্থান, সেই এলাকাকে সম্মিলিতভাবে লেভান্ট অঞ্চল বলা হতো। সেটা ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মানব সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। মানবজাতির প্রধান খাদ্যশস্যের প্রাচীন উৎসভূমিও ছিল ওই অঞ্চল। কয়েকশো বছর আগে সেই এলাকা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেই অঞ্চল দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে সুবিধা করতে না পেরেই কলম্বাস, ভাস্কো দা গামাকে পুরো দুনিয়া চষে বিকল্প রাস্তা বের করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই সুখী সমৃদ্ধ অঞ্চলে ইসরায়েল নামের একটা বিষফোঁড়া বপন করলো ইউরোপ-আমেরিকার সম্মিলিত শক্তি। চারপাশের আরব দেশের মাঝখানে একটা হাইব্রীড রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র পুরো লেভান্ট এবং আরব অঞ্চলকে অশান্ত করে রেখেছে গত ৫০ বছর ধরে। এই বিষফোঁড়া যদি পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া দানবীয় তাণ্ডব গাজা ছাড়িয়ে লেবানন ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এটা ইরান তুরস্কসহ আরো অনেক দেশকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেললে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর মানবজাতির হাতে যে পরিমাণ বিধ্বংসী অস্ত্র আছে তাতে এই গ্রহের কোনো অংশ রক্ষা পাবে বলে মনে হয় না। যেখানে সরাসরি যুদ্ধ হবে না, সেখানেও মানুষ কাতারে কাতারে মরতে থাকবে দুর্ভিক্ষ আর মহামারীতে। বিষাক্ত বায়ুতে পৃথিবীর প্রাণ প্রকৃতিও অবশিষ্ট থাকবে না। বৃটেন-আমেরিকার পোষ্য এই দানব দুদিন আগে লেবানন আক্রমণ করে ধ্বংসের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করেছে। নেতানিয়াহু নামের এই দানবকে থামাতে না পারলে ইউরোপ আমেরিকার শান্তিপূর্ণ জীবনও অক্ষত থাকবে না। দেরি হয়ে যাবার আগে তাকে কেউ থামাবে?

Wednesday, September 25, 2024

পাহাড় বিক্রির বিজ্ঞাপন

 পাহাড় বিক্রির বিজ্ঞাপন: চিঙ ওয়েঙ

যারা পাহাড়ে জমি কিনতে চান আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। একটা পাহাড় কিনে দিব। তবে বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকতে হবে। আপনার বউ সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে পাহাড়ের নিচে ছড়া তে পানি আনতে যাবে।  সেই পানি মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসবে আপনার বউ। আর হে, শীতকালে কিন্তু ছড়ার পানি শুকিয়ে যাবে!আপনি জুম চাষ করবেন পাহাড়ে।( তবে এই জুম চাষ শুধুমাত্র বর্ষাকালে করা যাবে। বাকি মাস ৪০০ টাকার মজুরি তে জংগলে কাজ করতে হবে)।  দূপুর বেলা আপনার বউ  তেল ছাড়া খাবার নিয়ে আসবে জুম ঘরে! নতুবা জুমের সবজি, ছড়ার কাঁকড়া ধরে বাঁশের চুঙ্গাই ভরে রান্না করে খাবেন তেল আর মসলা ছাড়া। মাঝে মাঝে আমরাও গেলাম আপনার অতিথি হতে। এক দুই দিন আপনার পাহাড়ের ভিলাতে থেকে আসলাম। আর হে আপনার বাচ্চাদের কিন্তু ইস্কুলে পাঠাতে হবে। ইস্কুলে যেতে দুই তিন কিলো হাটা লাগবে কিন্তু!!! 

কেউ চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। দেখলাম আমার পরিচিত অনেকেই পাহাড় কিনতে চাচ্ছেন । 

জমির দাম একরে ১০ হাজার টাকা মাত্র!!!

----------------------------------


বন্ধুতালিকার একজনের শেয়ার করা বিজ্ঞাপন পোস্টটি পড়ে আমার কয়েক বছর আগের সাজেকের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। সাজেকের প্রাইমারী স্কুলটার পেছনদিকে একটা রাস্তা নেমে গেছে খাড়া নীচের দিকে। মনে হলো সেদিকে একটা পাড়া  আছে। একদিন ভোরবেলা নাস্তা করার আগে হোটেল থেকে বেরিয়ে আমি কৌতূহলী হয়ে সেই পথ দিয়ে পাহাড়ের নীচের দিকে নেমে গেলাম। অনেকটা পথ নামার পর দেখলাম মাথায় দুটো কলসী(একটার ওপর আরেকটা) বসিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে উঠে আসছে। ওকে একটু থামিয়ে আলাপ করলাম। জানতে চাইলাম কোথা থেকে পানি আনছে। সে জানালো নীচের দিকে একটা ঝরনা আছে সেখান থেকে ঘরের জন্য পানি আনছে। সেই ঝরনার খোঁজে আরো নীচে নেমে যেখানে গেলাম, সেখান থেকে  উঠে আসতে খালি হাতেই আমার দম বেরিয়ে যাবার দশা। আমি তখন ভাবছিলাম ওই ৯/১০ বছরের বাচ্চাটার মাথায় রাখা কলসীগুলোর কথা। 

Sunday, September 22, 2024

আদিবাসী বনাম অভিবাসী

কয়েকদিন ধরে পিটার বেলউডের First Farmers পড়ছিলাম। বইটা মোটামুটি দশাসই হলেও তথ্য উপাত্তে বেশ উপভোগ্য। পড়তে গিয়ে মানবজাতির গত বিশ হাজার বছরের অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটা সারাংশও পড়া হয়ে গেল।  পড়ার সময় পৃথিবীর নানান অঞ্চলের আদিবাসী বনাম অভিবাসী ইস্যুতে সমসাময়িক কিছু আলোচিত বিষয় মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। বুক রিভিউ নয়, আদি মানবের বসতি পরিবর্তন, অভিবাসন বিষয়ক কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।

বসতির নিরিখে পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। আদিবাসী এবং অভিবাসী। যারা যুগ যুগ ধরে নিজেদের আদি বাসভূমে নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করে তারা আদিবাসী। আবার যারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে বসতি গড়ে এবং নিজেদের সংস্কৃতি সভ্যতাকে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর চাপিয়ে দেয় তারা হলো অভিবাসী। হাজার বছর আগে আদিবাসীরা ছিল শক্তিশালী। কিন্তু সময়ের সাথে আধুনিক প্রযুক্তি আয়ত্ব করার কারণে অভিবাসীরা আদিবাসীদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গত পাঁচশো বছর ধরে পৃথিবীটা অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় যায় পুরোপুরি। আধুনিক মানচিত্রে গত পাঁচশো বছরে যেসব অঞ্চল ‘আবিষ্কার’ করা হয়েছে তার সবটুকু অভিবাসীদের দখলে। তিন মহাদেশ এবং তিন মহাসমুদ্রে অভিবাসীদের হাতে কয়েক কোটি মানুষ নিহত হবার পর আদিবাসীরা নিজেদের বাসভূমি হারানোর বিষয়টা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীটা অভিবাসীদের রাজত্বে চলে গেছে পুরোপুরি।

আদিবাসীর সংজ্ঞা কী আসলে? এটা কি ভূমির অধিকার বিষয়ক ব্যাপার নাকি জাতি ও সংস্কৃতির ব্যাপার? খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে আদিবাসী হলো তারা যারা এখনো নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠির আদিম সংস্কৃতিগুলো ধারণ করেছে। যাদের জীবনযাত্রার মধ্যে ইউরোপের সংজ্ঞায় নির্মিত সভ্যতা প্রবেশ করেনি অথবা প্রবেশ করলেও সেটা সীমিত আকারে আছে। কিন্তু আদিবাসীর সংজ্ঞা নিয়ে প্রায়ই যে বিতর্কটা ওঠে সেটা হলো ভূমির অধিকার বিষয়ক। এই ভূমিতে কে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল। কারা আগে এসেছিল। কাদের প্রভাব বেশি ছিল ইত্যাদি। কিন্তু আদিম জনগোষ্ঠী মূলত যাযাবর ছিল যাদের নির্দিষ্ট এলাকায় বেশিদিন বসবাস করতো না। নানান কারণে বাসস্থান স্থানান্তর হতো। পৃথিবীর অধিকাংশ আদিবাসী পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে। এটার মূল কারণ সমভূমির দখল নিয়েছে ভদ্রলোকের সভ্যতা। যারা প্রযুক্তির শক্তি নিয়ে পৃথিবী দখল করেছে। 

আধুনিক সভ্যতার রাষ্ট্রকাঠামোতে পৃথিবীকে ভাগ করে নিয়েছে মানচিত্র নামের এক সীমান্ত রাজনীতি দিয়ে। আদিবাসীরা মানচিত্র বহির্ভূত জনগোষ্ঠী। তাদের কাছে যখন যে গ্রামে বাস করে সেটাই সীমান্ত। আদিবাসীদের কোনো স্থায়ী স্থাপনা নেই পৃথিবীর কোথাও। তারা অস্থায়ী নিবাসেই বিশ্বাসী। গত পাঁচশো বছরে পৃথিবীতে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে তার পর থেকেই আদিবাসীরা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদেরকে কোনো না কোনো একটা রাষ্ট্রের খোপে ঢুকতে হয়েছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। গত পাঁচশো বছরের হিসেব বাদ দিলে আগের দশ হাজার বছরের কখনো এই মানচিত্র খাঁচা তাদের ভূমিকে বেদখল করেনি। আদিবাসীদের সংজ্ঞা নিরূপন করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ভুল করি সভ্যতার চশমা পরে। পশ্চিমা সভ্যতা এই চশমা আমাদের চোখে এমনভাবে সেঁটে দিয়েছে যে আমরা তার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে পারি না।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসীদের বসতি ছিল তাইওয়ানে। গত দশ হাজার বছর ধরে তাইওয়ান থেকেই ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া সহ পুরো প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে আদিবাসীরা ছড়িয়ে পড়েছে। তাইওয়ানে সেই আদিবাসীরা এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যার মাত্র ২% আদিবাসী। বাকী সবাই অভিবাসী। অভিবাসীদের ৯২ ভাগ হলো চীনের হান জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নৃতাত্তিক জাতি গোষ্ঠী হলো চীনের হান জনগোষ্ঠী। এরাই চীনের ৯৫ ভাগ জনসংখ্যা। একই কথা প্রযোজ্য দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরো জাতির ক্ষেত্রে। পুরো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিম জাতিগোষ্ঠিগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আন্দেজ পর্বতমালার পাদদেশে যেসব জাতিগোষ্ঠি বসবাস করছে, একসময় এদের পূর্বপুরুষ পুরো দক্ষিণ আমেরিকা দাপিয়ে বেড়াতো। 

আমি পৃথিবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠিগুলোকে একেকটা সম্পদ মনে করি, কারণ এদের জীবনধারন, আচার-সংস্কৃতি সবকিছু প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসকে ধারণ করেছে। সভ্য জাতির হাতে নষ্ট হবার পর যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা এদের হাতেই নিরাপদ। সভ্যতার শক্তি দেখিয়ে এদের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা পৃথিবীর ইতিহাসেরই ক্ষতি। উন্নয়নের খপ্পরে পড়ে নগরায়ন এবং শিল্পোন্নয়নের নামে প্রায় পুরো পৃথিবী গ্রাস করে ফেলেছে সভ্যজগতের মানুষেরা। 

বাংলাদেশে যেসব পার্বত্য জাতিগোষ্ঠি আছে তারা এদেশের আদিবাসী কিনা এটা নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হয়। তারা কত বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করছে, তাদের আগেও এখানে আদিম জনগোষ্ঠী ছিল কিনা ইত্যাদি নিয়ে। এই কথাগুলো বলা হয় শুধু ভূমির অধিকার নিয়ে। একটু বৃহত্তর পরিসরে ভাবলে দেখা যাবে ভূমিটা এখানে মূখ্য বিষয় নয়। ভারতের মিজোরাম, বার্মার চিন, কিংবা পূর্বাঞ্চলে কুকি বা লুসাই নামে সাধারণভাবে পরিচিত যে জনগোষ্ঠি, তাদের মধ্যে শত শত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি রয়েছে। বিবর্তিত বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে তেমন জাতিগোষ্ঠিও কম নয়। তারা সবাই দেড় থেকে দুহাজার বছর আগে চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। তারও আগে এখানে যেসব জনগোষ্ঠি ছিল, তাদের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। যেমন আমাদের দেশে পার্বত্য জাতিগোষ্ঠির মধ্যে চাকমারা সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ, আবার বম জনগোষ্ঠি  সংখ্যায় অনেক কম। কিন্তু এই অঞ্চলে বমদের বসতি চাকমাদের চেয়ে অনেক প্রাচীন। সুতরাং কাকে আপনি এখানকার আদিবাসী বলবেন? সবক্ষেত্রেই দেখা যাবে আগে কোনো না কোনো জাতিগোষ্ঠীর বসতি ছিল ওই এলাকায়। একহাজার, দুহাজার, তিন হাজার, দশ হাজার? তাদের কোনো ইতিহাস কিংবা চিহ্ন নেই কোথাও। 

অতএব সেই জাতিগোষ্ঠিগুলো কোন এলাকায় কতদিন ধরে বসবাস করছে সেটা দিয়ে তাদের বিচার করা যাবে না। আদিকাল থেকে ভূমির অধিকার বলে কোনো বস্তু ছিল না। সবাই ছিল যাযাবর। একশো বছর পরপর বাসস্থান বদল করেছে তেমন উদাহরণও প্রচুর। এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও পাকাপাকিভাবে ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকে। 
আদিবাসী শব্দটা দেশে দেশে সবসময় রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত। যে যার সুবিধামত, রাজনৈতিক ভৌগলিক প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে শব্দটাকে ব্যবহার করে। আমার ব্যক্তিগত মত হলো কোন দেশে কারা আদিবাসী সেটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন জাতি তাদের আদিম সংস্কৃতি কতখানি ধরে রেখেছে। যে জাতি সেটা ধরে রেখেছে সে জাতি নিজস্ব সংস্কৃতির আদিবাসী হিসেবে পরিচিত হতে পারে। তাদের আবাসস্থল কিংবা ভৌগলিক অবস্থান বদলাতে পারে, কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এখনো ধরে রেখেছে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সেই হিসেবে পার্বত্য জাতিগোষ্ঠিগুলো তাদের সংস্কৃতি লালন করার ব্যাপারে সমভূমির জাতিগোষ্ঠিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি যত্নবান।  

আমাদের সমভূমির বাঙালিদেরও নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। কিন্তু সেটার সাথে পার্বত্যবাসীদের তুলনা করা উচিত হবে না। আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের পরিচয় কিছুটা তুলনা করা যাবে আমেরিকানদের সাথে। ইউরোপ থেকে দলে দলে নানা জাতিগোষ্ঠি আমেরিকা গিয়ে যে একটা নতুন জনগোষ্ঠি এবং সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে তারাই আমেরিকান। বাঙালিরা আমেরিকানদের চেয়ে হাজার বছর পুরোনো জাতি, কিন্তু এখানেও দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে আসা নানান জাতিগোষ্ঠির মিশ্রিত একটা জাতির জন্ম হয়েছে। এখানে আমাদের বিশুদ্ধ আদিম সংস্কৃতি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। এই বিশুদ্ধতার অভাবেই সমভূমির জাতিগুলোর মধ্যে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সবকিছুতে অস্থিরতা, বিশৃংখলা, নৈরাজ্য বেশি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এখানে প্রবল। কারণ ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠি থেকে আসা লোকেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায় নানা ভাবে। কেউ বংশগৌরবে, কেউ অর্থ সম্পদে। কেউবা স্রেফ হাস্যকর ইগোর জোরে। 

এক কথায় আমি যেটা বলতে চাই তা হলো- আসলে মানবজাতির সবচেয়ে বড় অংশটাই হলো অভিবাসী। এটা মেনে নিয়ে আমেরিকার মতো এত বড় রাষ্ট্র সদর্পে পৃথিবী রাজত্ব করছে, আমাদের সমস্যা কেন?