Friday, December 12, 2025

শেখ মুজিবুর রহমানের কী করা উচিত ছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে


আখতারুজ্জামান আজাদ এর ফেসবুক পোস্ট থেকে সংকলিত বিশ্লেষণ
[৮-১২ ডিসেম্বর ২০২৫]

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে একটি বিতর্ক প্রায়ই উত্থাপিত হয়। সেটি হলো— একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে তিনি কি গ্রেপ্তারবরণ করেছিলেন, নাকি আত্মসমর্পণ করেছিলেন; তার কি সেই রাতে গ্রেপ্তার হওয়া উচিত হয়েছে, নাকি আওয়ামি লিগের অন্য নেতাদের মতো ভারতে চলে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে সেই সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল; তার কি প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল, নাকি গেরিলাপ্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিত ছিল। শেষোক্ত বিতর্কটি হালে খুব বেশি পানি পায় না। কেননা, একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান কখনওই সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হতে পারেন না, গোটা দেশের মানুষের দায়িত্ব নিয়ে তাকে থাকতে হয় নেতৃত্বের জায়গায়। ২৫ মার্চকে ঘিরে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সে-রাতে তার ভারতে পাড়ি জমানো উচিত ছিল কি না। এই প্রশ্ন কারা উত্থাপন করে থাকেন, তাদের পরিচয় স্পষ্ট— যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছেন এবং নিজ উদ্যোগে আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছেন। কিন্তু ‘প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা স্বাধীনতাবিরোধী’— শুধু এটুকু বলে দিলেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়ে যায় না, বরং সেই প্রশ্ন যুগ-যুগ ধরে ঘুরে বেড়াবেই। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধানতম চরিত্র। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার সাথে-সাথে তিনি উভয় পাকিস্তানেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে, তার জীবনের প্রতিটি মিনিট কষ্টিপাথরে ঘষে পরীক্ষা করে দেখা হবে, আতশকাচের নিচে ফেলে বড় করে দেখে-দেখে নীরিক্ষা করা হবে, করা হবে বেধড়ক ব্যবচ্ছেদ— সেটিই স্বাভাবিক। যদিও তিনি ইতিহাসের মীমাংসিত চরিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধও মীমাংসিত, তবু রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে-সাথে কিছু পুরোনো প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও অনিবার্য হয়ে ওঠে।
২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন— এই বাক্যটি কল্পনা করলে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে একটিমাত্রই ছবি; যে-ছবিতে দেখা যায়— শাদা পাঞ্জাবি, কালো কোট পরে মুজিব মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দু’জন সশস্ত্র সেনা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। মুজিবের গ্রেপ্তারের এই একটি ছবিই ইতিহাসে প্রোথিত হয়ে আছে। এই ছবি দেখে মনে হতে পারে সে-রাতে মুজিবকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরম আদরে ধানমন্ডি ৩২ থেকে এনে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল, সে-রাতে আর কিছুই ঘটেনি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেককিছুই ঘটেছিল সে-রাতে। অবশ্য এ-কথা অনস্বীকার্য যে, ২৫ মার্চ আওয়ামি লিগের অধিকাংশ নেতাকর্মীর ধারণা ছিল মুজিব গ্রেপ্তার বরণ না-করে আত্মগোপনে চলে যাবেন এবং নিজেই প্রতিরোধযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু মুজিবের চিন্তা ছিল ভিন্নতর। যুদ্ধের আগমুহূর্তে নেতা কী করবেন; এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই গণভোটের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্ত নেতাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিতে হয়। মুজিবেরও একটি নিজস্ব চিন্তা ছিল এবং সেই চিন্তা মোতাবেকই তিনি ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। কী চিন্তা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; সে-বর্ণনা এই লেখায়ই থাকবে, থাকবে গ্রেপ্তারের ঘটনার বিক্ষিপ্ত বর্ণনা, থাকবে এ-ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মূল্যায়ন। উল্লেখ্য, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতে মুজিব যখন তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ্‌কে ফোন করে বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন, শফিউল্লাহ্‌ও মুজিবকে বলেছিলেন বাসভবন থেকে সরে পড়তে। কিন্তু মুজিব সরে পড়েননি— ১৫ আগস্টও না, ২৫ মার্চও না। মুজিব পঁচাত্তরে ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, একাত্তরে ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পালাতে পারেন না, মুজিবও পালাননি— হয় গ্রেপ্তারবরণ করেছেন অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন।
২৫ মার্চ রাতের গ্রেপ্তারবরণের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার আগে উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন যে, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান ঐদিন রাত সাড়ে দশটায় চট্টগ্রামে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন বেতারে প্রচারের জন্য। সেই বার্তায় তিনি দেশের সাধারণ জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, জনগণ যেন যেকোনো মূল্যে সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। বার্তায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছিলেন। আওয়ামি লিগের যেসব নেতাকর্মী ও বিডিআরের যে-সদস্যরা সে-রাতে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, চট্টগ্রামে স্বাধীনতার বার্তা পাঠানোর পর তিনি তাদের অধিকাংশকে তার ধানমন্ডির বাড়ি ত্যাগ করতে বলেছিলেন। ঢাকায় সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করেছিল রাত এগারোটার দিকে, আর মুজিব চট্টগ্রামে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন আক্রমণ শুরু হওয়ার আধঘণ্টা আগেই বা আক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই। অর্থাৎ স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো ধরনের দিক্‌নির্দেশনা না-দিয়েই মুজিব সেনাসদস্যদের হাত ধরে পশ্চিম পাকিস্তানে বনভোজন করতে সানন্দ রওয়ানা দিয়েছিলেন— ব্যাপারটি এমন নয়। ২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে যারা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, সেই ঘোষণা তারা মুজিবের পক্ষেই দিয়েছিলেন। অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিধায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার এখতিয়ার তখন মুজিব ছাড়া আর কারওই ছিল না এবং মুজিব সেই ঘোষণা না-দিয়ে গ্রেপ্তারবরণও করেননি। চট্টগ্রামে স্বাধীনতার বার্তা পাঠানোর ব্যাপারটির তথ্যসূত্র ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারির নিউ ইয়র্ক টাইমস। ১৬ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গকে মুজিব নিজেই এই কথাগুলো বলেছেন। ‘হি টেলস ফুল স্টোরি অব অ্যারেস্ট ডিটেনশন’— এটুকু লিখে গুগল করলেই শ্যানবার্গের পুরো প্রতিবেদনটি চোখের সামনে চলে আসবে।
আগেই উল্লেখ করেছি, ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের ঘটনার মাত্র একটি ছবিই আমরা দেখি, শাদা পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরে যে-ছবিতে তিনি বিষণ্ণবদনে সোফায় বসে আছেন। এ থেকে আমাদের মনেই হতে পারে সে-রাতে মুজিব কেবল সোফায়ই বসে ছিলেন, আর কিছুই ঘটেনি। বাস্তবতা হলো সেনাবাহিনী ঢাকা আক্রমণ শুরু করেছিল রাত এগারোটায় আর মুজিবের বাড়ি আক্রমণ করেছিল রাত একটায়। সেনাবাহিনী মুজিবের বাড়িতে খোশমেজাজে ঢোকেনি, মুজিবকে সসম্মান গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়নি, নিয়ে গিয়ে পুষ্পশয্যায় শুইয়ে রাখেনি। সেনাবাহিনী মুজিবের বাড়িতে ঢুকেছিল বাড়ির চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ করতে-করতে। সে-রাতে মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে সেনাসদস্য পাঠানো হয়েছিল সত্তরজনের মতো, দলের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জহির আলম খান। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন বিগ বার্ড’। গ্রেপ্তার সম্পন্ন হওয়ার পর জহির আলম ঢাকা সেনানিবাসে জেনারেল টিক্কা খানের কাছে সাংকেতিক রেডিওবার্তা পাঠিয়েছিলেন— ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, লিটল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’। অর্থাৎ বড় পাখিটিকে খাঁচায় পোরা হয়েছে, ছোট পাখিগুলো পালিয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
১৯৭২-এর ২৬ মার্চ ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জবানিতে ছাপা হয়েছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের অভিজ্ঞতা। সেই লেখার অংশবিশেষ ছিল এ-রকম—
‘রাত দশটার কাছাকাছি কলাবাগান থেকে এক ভদ্রলোক এসে শেখ সাহেবের সামনে একেবারে আছড়ে পড়লেন। তার মুখে শুধু এক কথা— আপনি পালান, বঙ্গবন্ধু, পালান। ভেতর থেকে তার কথা শুনে শঙ্কিত হয়ে উঠল আমারও মন। বড়মেয়েকে তার ছোটবোনটাসহ তার স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। যাওয়ার মুহূর্তে কী ভেবে যেন ছোটমেয়েটা আমাকে আর তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। শেখ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললেন— বিপদে কাঁদতে নেই, মা। তখন চারিদিকে সৈন্যরা নেমে পড়েছে। ট্যাঙ্ক বের করেছে পথে। তখন অনেকেই ছুটে এসেছিল ৩২নং রোডের এই বাড়িতে। বলেছিল— বঙ্গবন্ধু, আপনি সরে যান। উত্তরে দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়েছিলেন তিনি— না, কোথাও আমি যাব না। দশটা থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। দূর থেকে তখন গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। দেখলাম প্রতিটি শব্দতরঙ্গের সাথে-সাথে শেখ সাহেব সমস্ত ঘরটার মাঝে পায়চারি করছিলেন। অস্ফুটভাবে তিনি বলছিলেন— এভাবে বাঙালিকে মারা যাবে না, বাংলা মরবে না। রাত বারোটার পর থেকেই গুলির শব্দ এগিয়ে এল। ছেলেমেয়েদের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম পাশের বাড়িতে সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে। স্পষ্ট মনে আছে এ-সময়ে আমি বাজের মতো এক ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম— গো অন, চার্জ!
সাথে-সাথেই শুরু হলো অঝোরে গোলাবর্ষণ। এই তীব্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যেও অনুভব করলাম সৈন্যরা এবার আমার বাড়িতে ঢুকেছে। নিরুপায় হয়ে বসে ছিলাম আমার শোয়ার ঘরটায়। বাইরে থেকে মুষলধারে গোলাবর্ষণ হতে থাকল এই বাড়িটা লক্ষ্য করে। ওরা হয়তো এই ঘরের মাঝেই এমনইভাবে গোলাবর্ষণ করে হত্যা করতে চেয়েছিল আমাদেরকে। এমনভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল সমস্ত বাড়িটা বোধহয় খসে পড়বে। বারুদের গন্ধে মুখচোখ জ্বলছিল। আর ঠিক সেই দুরন্ত মুহূর্তটায় দেখছিলাম ক্রুদ্ধ সিংহের মত সমস্ত ঘরটায় মাঝে অবিশ্রান্তভাবে পায়চারি করছিলেন শেখ সাহেব। তাকে ঐভাবে রেগে যেতে কখনও আর দেখিনি। রাত সাড়ে বারোটার দিকে ওরা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ওপরে উঠে এল। এতক্ষণ শেখ সাহেব ওদের কিছু বলেননি। কিন্তু এবার অস্থিরভাবে বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সামনে। পরে শুনেছি সৈন্যরা সেই সময়েই তাকে হত্যা করে ফেলত, যদি না কর্নেল দু’হাত দিয়ে তাকে আড়াল করত। ধীরস্বরে শেখ সাহেব হুকুম দিলেন গুলি থামানোর জন্য। তারপর মাথাটা উচু রেখেই নেমে গেলেন তিনি নিচের তলায়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আবার তিনি উঠে এলেন ওপরে। মেজো ছেলে জামাল এগিয়ে দিল তার হাতঘড়ি ও মানিব্যাগ। স্বল্প কাপড় গোছানো। সুটকেস আর বেডিংটা তুলে নিল সৈন্যরা। যাওয়ার মুহূর্তে একবার শুধু তিনি তাকালেন আমাদের দিকে। পাইপ আর তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সাথে।’
মুজিবকে গ্রেপ্তারপ্রক্রিয়া যে মোটেই শান্তিপূর্ণ ছিল না, এই লেখায় তা সামান্য আগেই উল্লেখ করেছি। আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এক বর্ণনায় পেয়েছি সে-রাতে মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন স্থানীয় পুলিশসদস্য সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতও হয়েছিলেন (অবশ্য জহির আলম খান তার বইয়ে দাবি করেছেন সেই পুলিশ নিহত হননি, আহত হয়েছিলেন)। সেনাসদস্যরাও মুজিবকেও শারীরিকভাবে আঘাত করেছিলেন। হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির মুজিবের গালে সে-রাতে সশব্দ চড় মেরেছিলেন। চড়ের তথ্যসূত্র জহির আলম খানেরই লেখা আত্মজীবনীমূলক বই ‘দি ওয়ে ইট ওয়াজ : ইনসাইড দ্য পাকিস্তান আর্মি’। মুজিবের শরীরের পেছনদিকে ও পায়ে সেনাসদস্যরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছিলেন (তথ্যসূত্র মহিউদ্দিন আহমদের ‘একাত্তরের মুজিব’ বইয়ের ‘গ্রেপ্তার’ অধ্যায়)। গ্রেপ্তার-অভিযানে সেনাসদস্যরা সাবমেশিনগানের পাশাপাশি এমনকি গ্রেনেডও ব্যবহার করেছিলেন। সেই মুহূর্তে মুজিবের বাড়িতে যত পুরুষ ছিলেন, তাদের সবাইকেই গ্রেপ্তার করে আদমজি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; মুজিব বাদে অন্যদেরকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছিল। বাড়ির সব পুরুষকে গ্রেপ্তারের তথ্যসূত্র পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিক সালিক। মুজিবকে কারা, কখন, কীভাবে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন; গ্রেপ্তারের আগে মুজিবের বাড়ি কীভাবে কারা রেকি করেছিলেন, গ্রেপ্তারের আগে-পরে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবন ও এর আশেপাশে কী ঘটেছিল; এর অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যাবে জহির আলম খানের ঐ ‘দি ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইয়ে। গ্রেপ্তারের ঘটনাপ্রবাহ সবিস্তার বর্ণনা করা এই নিবন্ধে সম্ভব নয়। জহির আলমের বইটি পড়ার মতো সময় না-থাকলে সেরেফ ‘যে-রাতে মুজিব বন্দি হলেন’ লিখে গুগল করা যেতে পারে। ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বরের প্রথম আলোয় ঐ বইয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাপা হয়েছিল। কেবল ওটুকু পড়লেও জানা যাবে আলোচ্য গ্রেপ্তারপ্রক্রিয়া মুজিবের জন্য ফুলশয্যা ছিল না, বরং ছিল অত্যন্ত ভীতিকর একটি অভিজ্ঞতা। গ্রেপ্তারের সময়ে বা গ্রেপ্তার করে মুজিবকে নির্বিচার হত্যা করা হবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা তাকে কেউ দেয়নি। অধিকতর আগ্রহী পাঠকরা পড়তে পারেন ‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ লুৎফুল হকের ‘লারকানা ষড়যন্ত্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ’ বইয়ের ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একাত্তরের ২৫ মার্চ’ অধ্যায়টিও।
শেখ মুজিবুর রহমানকে যে ২৫ মার্চ রাতেই হত্যা করা হতে পারত, এই আশঙ্কা তিনি নিজেও প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে (১৯৩৯-২০১৩) দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মুজিব বলেছিলেন— ‘সে-রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একটি কমান্ডোদল আমার বাড়ি ঘেরাও করে। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমাকে খুন করে প্রচার করবে যে, বাংলাদেশের চরমপন্থিরা আমাকে মেরেছে। এভাবেই তারা হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করবে।’ আবার গ্রেপ্তারবরণ করলেই যে মুজিবের প্রাণরক্ষার নিশ্চয়তা ছিল, তা-ও নয়। বরং গ্রেপ্তারবরণ না-করে গোপনে ভারতে চলে গেলেই তার বেঁচে থাকা নিশ্চিত হতো। গ্রেপ্তারবরণ করেও মুজিবকে মৃত্যুর মুখোমুখিই হতে হয়েছিল। তার বিচারের জন্য পাকিস্তানে সামরিক আদালত বসানো হয়েছিল, আনা হয়েছিল এগারো বা বারোটি অভিযোগ। এর মধ্যে অন্তত ছয়টি অভিযোগ ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। ‘সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ ছিল সেসব অভিযোগের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার মাত্রই কয়েক দিন আগে— ৪ ডিসেম্বর— সামরিক আদালত মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। সেলের পাশে মুজিবের জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আইনি উপায়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে না-পেরে কারাগারে মুজিবকে হত্যার জন্য বিকল্প পথও অবলম্বন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। মুজিবকে যে-মিয়ানওয়ালি কারাগারে রাখা হয়েছিল, সেই মিয়ানওয়ালি ছিল জেনারেল নিয়াজির জেলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগের দিন— ১৫ ডিসেম্বর— মিয়ানওয়ালি কারাগারে গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইয়ে নিয়াজি নিহত হয়েছেন এবং যে-মুজিবের জন্য নিয়াজিকে মরতে হয়েছে, সেই মুজিব এই কারাগারেই আছেন। ষড়যন্ত্র করা হলো— কারাগারের তালা খুলে দেওয়া হবে, যাতে নিয়াজির নিহত হওয়ার ক্ষোভে কয়েদিরা মুজিবকে মেরে ফেলে। কিন্তু এর আগেই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে মুজিব সে-যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন। মুজিব নিজে এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের কাছে।
অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে যে সাড়ে নয় মাস বন্দি ছিলেন, এর প্রতিটি মুহূর্ত তাকে মৃত্যুর প্রহরই গুনতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকার কারাগারে মুজিবের জন্য রূপচর্চার ব্যবস্থা করেনি বা পুষ্পশয্যায় শুইয়ে রাখেনি। ফলে, ২৫ মার্চ রাতে মুজিব মনের সুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ‘ধরা’ দিয়েছিলেন বা পাকিস্তানে ‘পালিয়ে’ গিয়েছিলেন— এই তত্ত্ব হালে মোটেই পানি পায় না। হালে পানি পায় না ‘মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি’ এই তত্ত্বও। মুজিব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে না-চাইলে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা না-চাইলে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে মুজিবের মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ার কথা না, তার সেলের পাশে কবর খোঁড়ার কথা না, নিয়াজির নিহত হওয়ার গুজব রটিয়ে কয়েদিদেরকে দিয়ে মুজিবকে হত্যা করানোর পরিকল্পনাও করার কথা না। মুজিবকে গ্রেপ্তার করার পর তার নব্বই বছরের বৃদ্ধ বাবা ও আশি বছরের মায়ের চোখের সামনে তাদের বাড়ি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিল। মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা না-চাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাত না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি জামায়াতে ইসলামি। মুজিব যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা না-চাইতেন, তা হলে জামায়াতের চোখে মুজিবের থাকার কথা ছিল ফেরেশতা। কিন্তু জামায়াত মুজিব স্বাধীনতা চাননি বলে প্রচার করে একদিকে, আরেকদিকে চেষ্টা করে মুজিবকে মানবেতিহাসের বৃহত্তম দানব হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। সবার সব অঙ্ক মিললেও জামায়াতে ইসলামি ও তাদের সমমনা স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর মুজিব-অঙ্ক মেলে না। মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরও পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কাছে বীভৎস বিভীষিকার অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
এবার আসা যাক শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারবরণ কেন করেছিলেন, এ-প্রসঙ্গে। এর উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন। দিয়েছেন ডেভিড ফ্রস্টকে। ফ্রস্টকে দেওয়া ঐ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় নিউ ইয়র্কের ডাব্লিউ নিউ টেলিভিশনে ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি। ‘কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও না-গিয়ে গ্রেপ্তারবরণ করলেন’— ফ্রস্টের এই জিজ্ঞাসার জবাবে মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম পাকিস্তানি বাহিনী বর্বর। জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। তাই স্থির করলাম, আমি মরি ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।’ ফ্রস্ট বললেন, ‘আপনি হয়তো কোলকাতায় চলে যেতে পারতেন।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবের উত্তর ছিল— ‘আমি ইচ্ছে করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব! আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব, মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে যাব কেন! দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘ভাইয়েরা আমার, যখন আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তাজউদ্দিন-নজরুলেরা আমাকে ছেড়ে যায়; আমি বলেছিলাম— সাত কোটি বাঙালির সাথে আমাকে মরতে ডেকো না। আমি আশীর্বাদ করছি। তাজউদ্দিনরা কাঁদছিল। তোরা চলে যা, সংগ্রাম করিস। আমার আস্থা রইল। আমি এই বাড়িতে মরতে চাই। এই হবে বাংলার জায়গা, এইখানেই আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করতে আমি পারব না।’ এই লেখায়ই আগেও উল্লেখ করেছি মুজিব ২৫ মার্চ রাতেও পালাননি, ১৫ আগস্ট রাতেও পালাননি। একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পালাতে পারেন না। উল্লেখ্য, মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের চেয়ে ১০ জানুয়ারির ভাষণ কম গুরুত্বপূর্ণ না। আগ্রহীরা ইউটিউবে ১০ জানুয়ারির পুরো ভাষণটি শুনলে উন্মোচিত হতে পারে চিন্তার নতুন দরজা।
এখানে একটি চাঞ্চল্যকর ব্যাপার উল্লেখযোগ্য। সেটি হলো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের যুদ্ধপ্রতিনিধি ও সাবেক সচিব মুসা সাদিককে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক টিক্কা খানের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার। টিক্কা খান সেই সাক্ষাৎকারে বলেছেন— ‘আমি ভালো করেই জানতাম ওঁর (মুজিব) মাপের একজন নেতা দেশের মানুষকে ফেলে রেখে কখনওই পালাবেন না। মুজিবকে ধরার জন্য আমি ঢাকার সমস্ত বাড়িঘর-রাস্তাঘাট তন্নতন্ন করে খুঁজতাম। তাজউদ্দিন বা অন্য কোনো নেতাকে গ্রেপ্তারের কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। এজন্যই ওঁরা অত সহজে পালাতে পেরেছিলেন। ঐ রাতেই শেখ মুজিবকে কোনোভাবে যদি গ্রেপ্তার করতে না-পারতাম, আমার বাহিনী ঢাকার এবং বাংলাদেশের অন্য সমস্ত বাড়িঘর মর্টার শেল দিয়ে উড়িয়ে দিত। প্রতিশোধস্বরূপ আমরা হয়তো ঐ রাতেই কোটি বাঙালিকে হত্যা করতাম।’ মুসা সাদিক ১৯৮৮ সালে ইসলামাবাদে চতুর্থ সার্ক শীর্ষসম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন, ৩১ ডিসেম্বর লাহোরের গভর্নর্‌স হাউজে তিনি টিক্কা খানের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি পাওয়া যাবে মুসা সাদিকের ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’ বইয়ে। ‘রিটার্ন অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক ফ্রম দ্য জস অব ডেথ’ লিখে গুগল করলেও সাক্ষাৎকারটির আলোচ্য অংশ পাওয়া যাবে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো ২৫ মার্চ রাতে মুজিব গ্রেপ্তারবরণ না-করলে সেনাবাহিনী ঐ রাতেই আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাত— এ-কথা খোদ টিক্কা খান কর্তৃক স্বীকৃত ও সত্যায়িত। ‘বিগ বার্ড’ মুজিবও ব্যাপারটি অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং দলের প্রধান নেতাদেরকে আত্মগোপনে চলে যেতে বলেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে মুজিব বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কি না, মুক্তিযুদ্ধের সতেরো বছর পরে দেওয়া টিক্কা খানের এই স্বীকারোক্তি পড়েই তা ভেবে দেখা যায়।
শেখ মুজিবুর রহমানের ২৫ মার্চের গ্রেপ্তারবরণ, ধরা দেওয়া বা আত্মসমর্পণ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ-কেউ তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে থাকেন, কেউ বলে থাকেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি বিধায় তিনি সে-রাতে তার বাসভবনে সেনাবাহিনীর আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন, কারও মন্তব্য— তার এই গ্রেপ্তারবরণ অমীমাংসিত ও রহস্যময়। অনেকের দাবি— সে-রাতে মুজিব গ্রেপ্তারবরণ না-করে দেশের মধ্যে বসে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিলে বা দেশের বাইরে চলে গিয়ে প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে থাকলে যুদ্ধে মৃত্যুর পরিমাণ আরও কম থাকত। তবে, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ বইয়ে লিখে গেছেন— ‘মুজিবকে পাকিস্তান বন্দি করেছিল, খুনও করতে পারত, তাদের জন্যে এটাই স্বাভাবিক ছিলো; তবে তাদের মতো মগজহীনেরাও হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, বন্দি মুজিবের থেকে নিহত বা শহিদ মুজিব হবেন অনেক বেশি জীবন্ত ও শক্তিশালী। তারা বুঝেছিল বন্দি মুজিবকে হয়তো দমন বা প্রতারণা করা যাবে, কিন্তু শহিদ মুজিবকে দমন বা প্রতারণা করা যাবে না; তখন তিনি হয়ে উঠবেন অপরাজিত, অজেয়, অদম্য। মুজিবকে কখনও আমি কাছে থেকে দেখিনি, বাসনাও কখনও হয়নি। আমি বীরপুজারী নই। বেশ দূর থেকে কয়েকবার তাকে দেখেছি, তার স্তবও কখনও করিনি; রাজনীতিক মহাপুরুষদের প্রতি আমি বিশেষ আকর্ষণ বা শ্রদ্ধা বোধ করি না। মুজিব যে বন্দি হয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়টি ভরে কারারুদ্ধ ছিলেন পাকিস্তানে, একে তার শত্রুরা দীর্ঘকাল ধরে নিন্দা করে আসছে; তারা খুব অশ্লীলভাবে ব্যাপারটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাখ্যা করে সুখ পায়। মুষিকছানারা নিন্দা করে সিংহের।
আমাদের শোচনীয় দেশে সব ধরনের ব্যাখ্যাই সম্ভব। মিথ্যে এখানে খুবই শক্তিমান। মুজিব যদি ধরা না-দিয়ে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতেন, কোনো ভাঙা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তা হলে কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্র, আরও সফল হতো? তা হলে কি তিনি মুজিব হতেন? তা হলে তো তিনি হতেন মেজর জিয়া। মুজিব পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না, তিনি মুজিব হতেন না, হতেন সামান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং আমরা একটি বিশাল রাজনীতিক ভাবপ্রতিমাকে হারাতাম, মুক্তিযুদ্ধে আমরা এত অনুপ্রেরণা বোধ করতাম না। যোদ্ধা মুজিবের থেকে বন্দি মুজিব ছিলেন অনেক শক্তিশালী ও প্রেরণাদায়ক, তিনি তখন হয়ে উঠেছিলেন মহানায়ক, ঘোষকের অনেক ওপরে যার স্থান। মুক্তিযুদ্ধের সময়টি ভরে তিনিই ছিলেন নিয়ন্ত্রক ও প্রেরণা। তিনিই ছিলেন, এক অর্থে, মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের কারাগারে তিনি হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতেনও না, পাকিস্তানিরা তাকে তা জানতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের রূপ কী, তা হয়তো তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, কিন্তু সমগ্র বাঙালির রূপ ধরে তিনিই করে চলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাই ছিলো মুজিবের দ্বিতীয় সত্তা। মুজিবের বন্দিত্ব মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণার থেকে অনেক বড় ঘটনা। ঘোষণা করে ঘোষক হওয়া যায়, মুজিব হওয়া যায় না।’
১৯৭০ থেকে ’৭২ পর্যন্ত ছাত্রলিগের সভাপতি ছিলেন নুর-এ-আলম সিদ্দিকি, মারা গিয়েছেন ২০২৩-এ। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে তার একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি যাকে দিয়েছেন, তার নাম উল্লেখ করতে পারছি না। সাক্ষাৎকারটি নুর-এ-আলমের শেষবয়সে দেওয়া। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন— ‘আমি সম্ভবত শেষ ব্যক্তি, (২৫ মার্চ রাতে) যে ৩২ নম্বর থেকে বের হয়। অনেক অনুরোধ করেছি। নেতা (মুজিব) আমাদের সাথে আসতে চান নাই। তখন খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। এখন ভাবি, উনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি গেলে মানুষের মন ভেঙে যেত, মানুষ দুর্বল হয়ে যেত এবং মনে করত যে, হয়তো স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য বা পাকিস্তান ভাগ করার জন্য আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এই যে মানুষের মন ভেঙে যেত, দ্বিধাবিভক্তি আসত; এজন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ঐ যে প্রত্যয়দৃঢ় পদক্ষেপ নেতার, ঐটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করে, আরও বেগবান করে, আরও শক্তিশালী করে।’
বাংলাদেশের নির্মোহতম রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একজন সৈয়দ আবুল মকসুদ মারা গিয়েছেন ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। এর এক বছর আগে ২০২০-এর ১০ জানুয়ারি তিনি ‘প্রথম আলো’য় একটি কলাম লিখে গিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন— ‘ইতিহাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোত্র ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারেন। জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের পক্ষ-বিপক্ষের বয়ান এক রকম হবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হওয়া, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিত্ব, বন্দিদশা থেকে মুক্তি, মুক্তির পর লন্ডনে গমন, সেখান থেকে দিল্লি হয়ে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে সবার পর্যবেক্ষণ এক রকম নয়। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একাত্তরের ১ মার্চ থেকে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রতিটিই যথার্থ ছিল। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং অপছন্দ করতেন কমিউনিস্টদের মতো আত্মগোপনে থাকা। তিনি রাজনীতি করতেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।’ মুজিব নিজেও তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন— ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না।’ আত্মপরিচয় লুকিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে ফায়দা লুটে সেই দলকে বিতর্কিত করে সেই দলের পতন ঘটিয়ে পরবর্তীকালে স্বরূপে আবির্ভূত হওয়ার মতো মোনাফেকির রাজনীতি যারা করে, তারা মনে করে শেখ মুজিবুর রহমানেরও তাদেরই মতো মোনাফেক হওয়া উচিত ছিল।
যা হোক, একই কলামে আবুল মকসুদ আরও লিখে গিয়েছেন— ‘বঙ্গবন্ধু জনগণ-নন্দিত মেজরিটি পার্টির নেতা। তিনি বিপ্লবী নেতা নন, গেরিলা নেতাও নন। তিনি কারও ভয়ে পালাতে পারেন না। দলের কোনো-কোনো সহকর্মী তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ২৫ মার্চ সন্ধ্যারাতে আত্মগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সম্মত হননি। জনগণকে কামানের নলের মুখে রেখে তিনি আত্মগোপনে যেতে চাননি। সংসদীয় গণতন্ত্রের একজন নেতা হিশেবে তিনি তার বাসভবনেই অবস্থান করেন। তার সহকর্মীরা তাকে ছেড়ে আত্মগোপন করেন। আত্মগোপন না-করে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের কয়েকটি সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের একটি। তিনি সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পান, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বজনমত তার পাশে থাকে। বায়াফ্রার মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বায়াফ্রা প্রজাতন্ত্র হলো পশ্চিম আফ্রিকার একটি আংশিক স্বীকৃত দেশ, যেটি বিরাজমান ছিল ১৯৬৭ থেকে ’৭০ পর্যন্ত। দেশটি ছিল নাইজেরিয়ার অংশ। নাইজেরিয়ায় জাতিগত উত্তেজনা ও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৬৬ সালের দিকে এবং এই সুযোগে ’৬৭ সালে বায়াফ্রা স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে এবং তিন বছর দেশটি স্বাধীন ছিলও। কিন্তু সামরিক অভিযান চালিয়ে ১৯৭০ সালে নাইজেরিয়া আবার বায়াফ্রা দখল করে নেয়, মৃত্যু ঘটে স্বাধীন বায়াফ্রা রাষ্ট্রের। মুজিব ২৫ মার্চ ভারতে চলে গেলে বাংলাদেশের পরিণতি বায়াফ্রার মতোই হতো— বাংলাদেশ সে-ক্ষেত্রে স্বাধীনই হতো না, হলেও বছর কয়েক পর পুনরায় পাকিস্তানে অঙ্গীভূত হয়ে যেতে বাধ্য হতো।
ক্ষণে-ক্ষণে মতাদর্শ পালটানো ক্ষণিকের কবি ফরহাদ মজহার বর্তমানে পাকিস্তানপন্থিদের প্রিয়পাত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে তিনি সম্ভাব্য সবকিছু সম্প্রতি করেছেন। ১৯৯৫ সালের ৪ জুলাই তিনিও ‘ভোরের কাগজ’-এ লিখেছেন— ‘শেখ মুজিব অসাধারণ দূরদর্শী ছিলেন এবং অন্তত এই ধরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি দারুণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। এটা তার নেতৃত্বের চূড়ান্ত অভিপ্রকাশ। ধরা দেওয়াটা তার মৌলিক পারফরম্যান্স। এই বিশাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তিনি শুধু তার বুদ্ধি খাটাননি, তার সফল বৃত্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। চিন্তার যে-সীমানায় এসে পৌঁছালে বুদ্ধি আর বিশেষ কাজে লাগে না, যুক্তি যেখানে খুব একটা সহায় হয় না, যে-সীমান্তে এসে শুধু নিজের প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করতে হয়; তিনি ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। আজ যখন ইতিহাসের পেছনদিকে তাকাই; তখন মনে হয় দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে ধরা দিয়ে তিনি যে অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। এই কাজটি যদি তিনি না-করতেন; তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কি না, সে-বিষয়ে আমি ঘোরতরভাবে সন্দেহ করি।’
প্রাবন্ধিক আবদুল হালিম (১৯৩৯-২০১০) ‘দৈনিক সংবাদ’-এ ১৯৯৫ সালেরই ১০ মে লিখেছেন— ‘বঙ্গবন্ধু ধরা দিয়েছিলেন, অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করেছিলেন, এই বক্তব্য সঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু তার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, যেটা তার দপ্তরও বটে। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করেছেন অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তানি সৈন্যদল সেখানে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার বা বন্দি করে নিয়ে যায়। এটাকে ধরা দেওয়া বা আত্মসমর্পণ করা বলে না। বস্তুত, পাকিস্তানিরা তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিশেবেই বন্দি করেছিল। এর আংশিক স্বীকৃতি পাওয়া যায় এ-ঘটনা থেকে যে, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তান তথা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদি তাকে শুধু গ্রেপ্তার করা হতো, তা হলে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখলেই চলত। কিন্তু পাকিস্তানিরা বন্দি করেছিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে এবং মূলত সে-কারণেই তারা তাকে নিয়ে যায় নিজেদের দেশ পাকিস্তানে।’
কলামিস্ট খন্দকার মজহারুল করিম (জন্ম ১৯৫৪) দৈনিক ইত্তেফাকে ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লিখেছেন— ‘আত্মগোপন করার বদলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার বরণ করে জাতির পিতা আসলে দূরদৃষ্টিরই পরিচয় দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু পলাতক অবস্থায় ধরা পড়লে ঐ কূটনৈতিক মর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হতেন। জাতির মুক্তিসংগ্রামও দুর্বল হয়ে পড়ত। এমনকি পলাতক অবস্থায় বিদেশে গিয়ে মুুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে সমাসীন হলেও তিনি জাতির জন্য ওই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদভুক্ত সুবিধাদি আদায় করতে পারতেন না। তাই ক্ষিপ্ত-উচ্ছৃঙ্খল সেনাবাহিনীর হাতে অপঘাত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও তিনি নিজ বাসভবনে গ্রেপ্তার বরণ করেন।’ দৈনিক নয়াদিগন্তে ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর অধ্যাপক আহমদ নূরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আমাদের প্রশ্ন— মিত্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ না-করে মুজিব কেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শত্রু পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিলেন। আমার ধারণা— মুজিব সম্ভবত জানতেন, পাকিস্তানিদের হাত থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তায় হয়তো বাংলার মাটিতে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু ভারতে চলে গেলে বাংলার মাটিতে তিনি ফিরে না-ও আসতে পারতেন।’ ফরহাদ মজহার, আবদুল হালিম, খন্দকার মজহারুল করিম ও আহমদ নূরুল ইসলামের উক্তিগুলো যোগাড় করেছি সামহোয়্যারইন ব্লগ থেকে, ব্লগটি লিখেছিলেন জনৈক রফিকুল ইসলাম ফারুকি।
২০১২ সালে ‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিত ‘মুজিব ভাই’ বইয়ে সাংবাদিক এবিএম মুসা (১৯৩১-২০১৪) ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ অধ্যায়ে লিখে গেছেন— ‘শেখ মুজিব যদি স্বাধীন বাংলায় না-ফিরতেন, তাহলে কী হতো দেশটির? বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছে, আবার অনেক ঘটনা ঘটতে পারেনি। অনেকেই বলেছেন, লিখেছেন এবং বিশ্বাসও করেন যে, বঙ্গবন্ধু ফিরে না-এলে প্রথমত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এত তাড়াতাড়ি যেত না। তারা চাইলেও যেতে দেওয়া হতো না। কারও মতে, মুজিববাহিনী আর মুজিবনগরফেরত প্রবাসী সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করত, দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যেত। কঙ্গো, সোমালিয়া বা আফগানিস্তানের মতো গোষ্ঠীগত না-হলেও দলগত সংঘর্ষ লেগে থাকত। সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সামর্থ্য দেশে-আসা প্রবাসী সরকারের ছিল না। এমনকি সরকারের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাজ করছিল, দেশশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় মনোবল বা প্রভাব প্রতিষ্ঠার ক্ষমতার অভাব ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, বাহাত্তরেই তেমন কিছু ঘটতে পারত। বঙ্গবন্ধু ফিরে না-এলে কী যে হতো, তৎকালীন দেশের অবস্থা যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাদের ছাড়া অন্য কাউকে তা বোঝানো যাবে না। সহজ কথায়, বঙ্গবন্ধু ফিরে না-এলে অনেক কিছুই হতো, অনেক অঘটন ঘটত, যা রোধ করার ক্ষমতা অন্য কারও ছিল না। মুজিবনগর সরকারের চারদিকে সুরক্ষা বন্ধন তৈরির জন্য ভারতীয় বাহিনীকে পাহারায় থাকতে হতো। নতুন বাংলাদেশ ইরাক অথবা আফগানিস্তানও হতে পারত। ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেও বিদ্যমান অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত না। হয়তো সেই পরিস্থিতির অজুহাতে তারা থেকেই যেত অথবা তাদের থাকতে বলা হতো।’ নিশ্চয়ই এ-কথা বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না— পাকিস্তান থেকে না-ফিরে ভারত থেকে ফিরলে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতফেরত প্রবাসী সরকারের সদস্যদের মতোই দুর্বল থাকতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার মতো আত্মবিশ্বাস বা গ্রহণযোগ্যতা তার থাকত না।
২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারবরণ নিয়ে এই লেখায় এতক্ষণ যাবৎ যত তথ্য, তত্ত্ব বা উপাত্ত হাজির করলাম; এখন এর একটি সারমর্ম দাঁড় করানো আবশ্যক। ইতিহাস পাটিগণিতের নিয়ম মেনে চলে না। দুইয়ের সাথে দুই যোগ করলে পাটিগণিতে চার হয়; ইতিহাসে চারও হতে পারে, বাইশও হতে পারে। সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী মুজিব ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি একই সময়ে ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগের সভাপতি। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা না-পেলেও সত্তরের নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তান কার্যত মুজিবের অঙ্গুলিহেলনেই চলেছে। ঐ মুহূর্তে মুজিবই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ। ঐ মুহূর্তে মুজিবই ছিলেন সরকার, মুজিবই হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্র, মুজিবই হয়ে উঠেছিলেন ভূখণ্ড। ফলে, ২৫ মার্চ রাতে মুজিবের করণীয় কী, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের একচ্ছত্র এখতিয়ার যেমন তারই ছিল; এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো পর্যাপ্ত প্রজ্ঞাও ছিল একমাত্র তারই। তিনি তার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হয়েছে। ঐ রাতে মুজিব গ্রেপ্তারবরণ না-করে ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও গোটা উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। বাংলাদেশ তাতে হয়তো আরও আগেই স্বাধীন হতো কিংবা আদৌ স্বাধীনই হতো না অথবা কিছুদিনের জন্য স্বাধীন হয়ে বায়াফ্রার মতো ফের আগের দেশে বিলীন হয়ে যেত। তবে, মুজিব ভারতে চলে গেলে বাংলাদেশের পরিণতি করুণ হতো বলেই ইতিহাসের সমীকরণ সাক্ষ্য দেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে ভারতে যে-যাত্রাবিরতি নিয়েছিলেন, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তখনই তিনি বলে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে। ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশে সংবর্ধনা দেওয়ার পর মুজিব ইন্দিরার কাছে একই দাবি করেছিলেন। ইন্দিরা এই দাবি না-মানলে বাংলাদেশের কিছুই করার থাকত না। ভারত বাংলাদেশকে হায়দ্রাবাদ বা সিকিমের মতো দখল করে নিলেও বাংলাদেশকে তখন নিরুপায় থাকতে হতো। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী মুজিবের আহ্বানে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। শতভাগ সেনাপ্রত্যাহারের জন্য ইন্দিরা তারিখ বেছে নিয়েছিলেন ১৭ মার্চকে। কারণ, ১৭ মার্চ মুজিবের জন্মদিন। ইন্দিরা মুজিবকে এই পরিমাণ শ্রদ্ধা ও সমীহ করতেন। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের অন্য কোনো নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে বলারই সাহস পেতেন না। মুজিব এই সাহস রাখতেন। তবে, মুজিবও ইন্দিরাকে সেনাপ্রত্যাহারের আহ্বান জানানোর মতো পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে পারতেন না, ২৫ মার্চ রাতে যদি তিনি ভারতে পালিয়ে যেতেন। একটি দেশে পালিয়ে থেকে সুবিধাজনক সময়ে সেই দেশ থেকে ফিরে এসে সেই দেশেরই সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানানোর চিন্তা করাও নিঃসন্দেহে বাতুলতা। এখানে আরও একটি ব্যাপার প্রণিধানযোগ্য। মুজিব ফিরেছিলেন বলেই এবং ‘পাকিস্তান’ থেকে ফিরেছিলেন বলেই এ-দেশীয় যুদ্ধাপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়েছিল এবং প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, মুজিব না-ফিরলে বা ‘ভারত’ থেকে ফিরলে কোনো যুদ্ধাপরাধীই প্রাণে বাঁচার সুযোগ না-ও পেতে পারত।
এই লেখায় উল্লিখিত বাণীসমগ্র বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় ভারতে আত্মগোপনে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি অধিক শক্তিশালী ছিল। মুজিব বাদে স্বাধীনতাকামী প্রায় সব নেতা ২৫ মার্চের পর ভারতেই ছিলেন, ভারতে ছিলেন আবদুল হামিদ খান ভাসানির মতো উপমহাদেশজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন নেতাও। কিন্তু ভারতে তার ভূমিকা খুব বেশি উল্লেখযোগ্য ছিল না। ভারতে চলে গেলে মুজিবও হয়তো ম্রিয়মাণই থাকতেন, ইতিহাসে তার স্থান হতো পাদটীকা হিশেবে। অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ভারত যথাযথ প্রটোকল দিতে পারত না। অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ভারতের যত্রতত্র ছোটাছুটি করছেন— ব্যাপারটি শোভনীয় হতো না, নিরাপদও হতো না। আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলায় গ্রেপ্তার মুজিবকে পূর্ববাংলার মানুষ গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে আইয়ুব খানকে তখতে তাউস থেকে হটিয়ে মুক্ত করে এনেছে। এক মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে বাঙালি আস্ত একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিতে পারে। মুজিবকে আরেকবার মুক্ত করতে করতে বাঙালি দেশই স্বাধীন করে ফেলেছে। মুজিব ভারতে লুক্কায়িত থাকলে দেশ স্বাধীন করার এত বজ্রকঠিন সংকল্প একাত্তরে বাঙালিমনে না-ও থাকতে পারত। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি মুজিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একাত্তরে যে-গুরুত্ব পেয়েছেন, ভারতে আত্মগোপনে থাকা মুজিব সমপরিমাণ গুরুত্ব পেতেন না। বন্দি মুজিব একাত্তরে এই উপমহাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন, পরিণত হয়েছিলেন একটি দেশের প্রতিশব্দে। একাত্তরে ভারতে বসে আওয়ামি লিগেরই কিছু নেতাকর্মী বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রয়োজন নেই, পরাধীন থাকার বিনিময়ে হলেও জীবিত মুজিবকে ফেরত চাই। অর্থাৎ একাত্তরে সমীকরণ দাঁড়িয়েছিল— মুজিব মানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানেই মুজিব। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে ১৯৭১ সালে, দেশ শত্রুমুক্ত করেছে সেরেফ নয় মাসে। পাকিস্তানেরই কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বেলুচিস্তান বিদ্রোহ শুরু করেছে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায়— ১৯৪৮ সালে। বেলুচিস্তান এখনও— সাতাত্তর বছরেও— স্বাধীন হতে পারেনি। কেননা, বেলুচদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান নেই।

মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ক একটি মাপকাঠি

কে কতটা যোগ্য বোঝার উপায় কি? মাপকাঠি কি? জ্ঞান, সম্পদ নাকি শক্তি? জ্ঞান আর সম্পদ মানুষের একচ্ছত্র অধিকার। অন্য কোন প্রাণী জ্ঞানার্জন করে না। অন্য কোনো প্রাণী সম্পদের মালিকানা দাবী করে না। বাকী থাকে শক্তি। এখানে যোগ্যতার প্রমাণ হলো কে কতটা কম শক্তি দিয়ে বেশিদূর পথ যেতে পারে। পৃথিবীর স্থলচর প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে ঘোড়া, উট, হরিন, চিতাবাঘ, হাতি ইত্যাদি প্রানীগুলো শারীরিক সামর্থ্যে মানুষের চেয়ে বেশিদূর ছুটতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্বটা যখন ১০০+ মাইল পার হয়ে যায় তখন হিসেবটা বদলে যেতে থাকে। ৫০০ মাইলের দূরত্ব হিসেব করলে মানুষই সবচেয়ে বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারে। প্রাণী হিসেবে মানুষ কেন অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, সেই সমীকরণে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানেই এগিয়ে যায় মানুষ। পৃথিবীর সবগুলো প্রান্তে ছুটতে পারা প্রাণীদের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে।

Monday, December 8, 2025

The distant wishes

 


Upon a mountain veiled in mist, a tender flower wakes, newly kissed. Born today where the high winds roam, yet far from me, it makes its home. I send my wishes across the skies, love carried in whispers, unseen ties. Though my hands can never reach its stem, my heart will guard it, a quiet gem. Forever afar, yet always near, a bloom I cherish, year by year.



Photo: Mustafizur Rahman

Tuesday, November 4, 2025

বই পড়া নিয়ে অপ্রিয় কথা

ক.
অপ্রিয় কথাটা আপনাকে বলছি। দেশকে নিয়ে আপনার অনেক দুশ্চিন্তা। দেশের তরুণ সমাজের অবক্ষয়ের ব্যাপারে আপনার সীমাহীন উদ্বেগ। কিন্তু এই দুশ্চিন্তা উদ্বেগের পাশাপাশি আপনি নিজেকে একটা প্রশ্ন করুন। আপনি শেষবার কবে আপনার সন্তানের হাতে একটা বই তুলে দিয়েছেন? আপনি প্রতি বছর সন্তানের কোচিং টিচার সেমিস্টার ফি যোগানোর জন্য হাজার হাজার টাকা(কেউ কেউ লাখ লাখ টাকা) খরচ করেন। কিন্তু একাডেমিক বইয়ের বাইরে আপনি সন্তানের জন্য কত টাকার বই কিনেছেন? অথচ এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর হবে ছেলেমেয়ের হাতে আদর করে অ্যান্ডরয়েড ফোন দিয়েছেন। কেউ প্রয়োজনে দিয়েছেন, কেউ প্রয়োজন হবার আগেই দিয়েছেন। যত দামী ফোন সম্ভব ততটা দিয়েছেন। কিন্তু বইয়ের কথা কেউ ভাবেননি। আমার অনুমান বাংলাদেশে ৯০% অভিভাবক কিংবা শিক্ষক ছেলেমেয়েদের বই পড়ার কথা বলেন না। সবাই বিচিত্র সব শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে জিপিএ ফাইভ নিয়ে ছুটেছি। গত পনেরো বিশ বছর ধরে এই প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ৬ ইঞ্চি পর্দার অ্যান্ডরয়েড ফোন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে বাংলাদেশে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সারা পৃথিবী যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা ওই একই প্রযুক্তির ভেতরে নিমজ্জিত হয়ে নিজে ডুবেছি, আমাদের সন্তানদেরও ডুবিয়েছি।

সারা পৃথিবীতে বই পড়ার র‍্যাংকিং এ ১০২টি দেশের মধ্যে ৯৭ স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। বলা হয়েছে গড়ে একজন বাংলাদেশী বছরে ২.৭৫টি বই পড়ে। আমার ধারণা এটাও বেশি বলা হয়েছে। অথবা এখানে একাডেমিক বইয়ের কথাও যোগ করা হয়েছে। বছরে একটা আউট বই পড়ে সেরকম একটা মানুষ খুঁজে পেতে আপনি হিমশিম খেয়ে যাবেন।


খ.

১. জীবন থেকে যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে প্রথম উপলব্ধিটা হলো- বই পড়লে মানুষ সহজে বুড়ো হয় না(মানসিকভাবে)। বই মানুষের তারুণ্যকে ধরে রাখে। দ্বিতীয় উপলব্ধি হলো- ঘরের মধ্যে রাশি রাশি বই কিংবা বিশাল একটা লাইব্রেরি থাকলেই বই পড়া হয় না। উদাহরণ আমার ঘরের মধ্যেই আছে।


২. বই পড়ার সাথে মগজের একটা গভীর অদৃশ্য সংযোগ আছে। সেই সংযোগটাই আমাদের বইয়ের কাছে টেনে নিয়ে যায়। আমাদের হাতের কাছে যতই বইপত্র থাকুক, এক পাতা বই পড়াও অসম্ভব যদি ওই আবেগটা না থাকে। ওটাকে প্রেমের সাথে তুলনা করা যায়। বইপ্রেম ব্যাপারটা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রতিটা মানুষের চাহিদা আলাদা। জোর করে যেমন প্রেম ঘটানো যায় না, তেমনি জোর করে কাউকে বই পড়ানো যায় না।


৩. লোকে কেন বই পড়ে? এই বোধের জন্ম হয় কিভাবে? এটারও সঠিক উত্তর বলতে কিছু নেই। একেক মানুষ একেকভাবে বইয়ের প্রেমে পড়ে। কখনো পরিবার, কখনো বন্ধুবান্ধব, কখনো বা অচেনা কেউ বই পড়ার জন্য প্রভাবিত করে। এই প্রেম চিরকাল থাকবে তারও গ্যারান্টি নেই। একসময় খুব বই পড়তো, এখন বইয়ের দিকে তাকিয়েও দেখে না, সেরকম লোকের সংখ্যা প্রচুর।


৪. অবসরের অভাবে বই পড়তে পারি না, এটা একটা সাধারণ অজুহাত। অবসরে আমরা অন্য অনেক কাজ করার জন্য ঠিকই সময় পাই, কিন্তু বইয়ের জন্য সময় পাই না। আসল কারণ হলো মগজের সাথে ঠিক যে সংযোগটা থাকলে বই মানুষকে টানে, সেই সংযোগটা নষ্ট হয়ে আছে।

গ.

মানবজাতি গত কয়েক হাজার বছরে প্রযুক্তিবিদ্যার অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। কিন্তু জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প আবিষ্কার হয়নি। নানা কারণে বইপত্র পড়ে মানুষ। জ্ঞানার্জন ছাড়াও বই কারো অবসর, কারো বিনোদন, কারো একাকীত্ব দূরীকরণের হাতিয়ার। আমি যে বইয়ের কথা বলছি সেটা আউট বই, ক্লাসের বই না। দুটো আলাদা জিনিস। আলাদা জগত। 


আজকাল যে সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা যাচ্ছে মানুষের সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি। আগে যে জিনিস বই পড়ে জানতো, এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে সেটা জেনে যাচ্ছে। এটার সবচেয়ে বড় বিপদটা হলো বিভ্রান্তি। সোশ্যাল মিডিয়াতে যে কেউ দায়িত্বহীন তথ্য প্রচার করতে পারে। সেই মিথ্যা তথ্যের জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। দেশে অসংখ্য মানুষ বোধহীনভাবে সেই তথ্যগুলো গ্রহন করে যদি সেটা তার পছন্দের হয়। এখানে এসে সবচেয়ে বিপদগ্রস্থ হয় ইতিহাস। আমি ইতিহাস নিয়ে কাজ করি বলে এই বিষয়টা খুব পীড়া দেয়। ইতিহাস জানার একমাত্র উপায় হলো প্রচুর বই পড়া। এখন প্রায়ই দেখা যায় ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়েই সেটার ভিত্তিতেই নানা তর্ক জুড়ে দেয় অনেকে। তর্ক করার খাতিরে হলেও বই পড়তে হবে। ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কী বললো সেটা তর্ক করার কোনো সূত্র হতে পারে না। ইন্টারনেট উন্মুক্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার। চাইলে সেটার সুষ্ঠু ব্যবহার করে অনেক কিছু জানা যায়। ইচ্ছে করলে বিনা পয়সাতেও প্রচুর বইপত্র পাওয়া সম্ভব। 


স্কুল কলেজের বই পড়ে সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব হলেও সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের জন্য আরো অনেক অনেক বই পড়া দরকার। বই পড়ার অভ্যেস একেকটা জাতিকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যায় সেটা ইউরোপের সাথে ভারতবর্ষের তুলনা করলেই বোঝা যাবে। এই উপমহাদেশের মূর্খতা অন্ধতা সবকিছুই ঘটছে বই পড়ার অভাবে। মূর্খতা একটা অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য হলেও বই পড়ার জন্য কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখা উচিত।


Tuesday, September 23, 2025

শিক্ষা বনাম জীবিকা

আমার প্রথম চাকরির প্রথম দুবছর দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ করতাম। প্রথম ছমাস ছুটি বলে কোন শব্দ ছিল না। ছমাস পর থেকে মাসে একটা শুক্রবার ছুটি। সপ্তাহে নিয়মিত একদিন ছুটি পেতে প্রায় দুবছর লেগেছিল। নতুন কোম্পানি গড়ে তোলার প্রাথমিক কারিগর হিসেবে এই কষ্টটা সহ্য করার পুরস্কারও পেয়েছিলাম। অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখে গিয়েছিলাম। যেখানে আমার যাবার কথা নয় সেখানেও পৌছে গিয়েছিলাম। আমি একা ছিলাম না, আমার সাথে আরো কয়েকজন এই ধৈর্য পরীক্ষায় পাশ করেছিল। সেটা ব্যাপার না। ব্যাপার হলো আমি যখন ১৪ ঘন্টা কাজ করা নিয়ে কাহিল, তখন আমার নিয়োগকর্তা ১৮ ঘন্টা কাজ করতেন। মাঝে মাঝে আমরা ভাবতাম তিনি ঘুমান কখন? রাত বারোটায় অফিস থেকে গিয়ে ভোর ছটায় আবারো হাজির। আমরা প্রতিদিন সকাল সাতটায় অফিসে পৌঁছে আমাদের আগেই তাঁকে উপস্থিত দেখতাম। তখন থেকে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু মানুষগুলোর বসবাস পূর্ব এশিয়ায়। কিন্তু মাল্টি মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও এত পরিশ্রম করার পেছনে রহস্য কী? ব্যালেন্স শীটের অংকটা বছরের পর বছর বাড়িয়ে যাওয়া? নতুন নতুন কোম্পানি গড়ে তোলা? নাকি স্রেফ কাজের নেশা? তখন কিছুই বুঝিনি।

এখন আমি একটা স্বাধীন দেশের রাজা। যেখানে কাজ করি আমার ওপর খবরদারী করার কেউ নেই বললেই চলে। আমি কটায় ঘুম থেকে উঠলাম, কটায় ঘুমালাম সেটা নিয়ে কারো অভিযোগ নেই। কাজটা নিজের সময়মতো মতো করি। ভোরে উঠে অফিসে যাবার তাড়া নেই।  কিন্তু নিজের রাজ্যে এসে দেখলাম আমিও প্রায় ১৮ ঘন্টার কাজের চক্রে আটকে গেছি। প্রায়ই মনে হয় দৈনিক ২৪ ঘন্টা যথেষ্ট নয় দিনের সবগুলো কাজ শেষ করার জন্য। কাজের পর কাজ এসে জমা হতে থাকে নিজস্ব অনলাইন ওয়ার্কস্পেসের ফোল্ডারে। ত্রিশ বছর পর আমি পূর্ব এশিয়ার সেই ভদ্রলোককে একটু হলেও অনুভব করলাম। তিনি বলেছিলেন- ‘কাজ একটা নেশা, তোমাকে জাগিয়ে রাখবে ভোর থেকে মধ্যরাতের পরও। যদি কাজ ও তুমি পরস্পরকে পছন্দ করো’।

আমরা কী পরস্পরকে পছন্দ করি? হয়তো। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি। জীবন থেকে মানুষ অনেক শিক্ষা নেয়। এটা ছিল আমার বিলম্বিত শিক্ষার একটি। প্রাচীন ল্যাটিন ভাষায় বলা হতো Potius sero quam nunquam, ইংরেজিতে Better late than never.

কিন্তু একজন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে পছন্দের কাজ পাবে সেরকম কোনো ব্যবস্থা আছে? কাজ ও শিক্ষা এদেশে যোজন যোজন আলোকবর্ষ দূরে থাকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? শিক্ষাখাতে এত বাজেট রেখেও কেন পাঁচ দশকে আমরা একটা অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠি বহন করে যাচ্ছি? বিকলাঙ্গ শিক্ষার প্রতিফলন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবশালী লোকদের কমেন্ট সেকশনেই আছে।

আমাদের দেশে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অধিকাংশ তরুণের দুর্ভাগ্য হলো অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন একটা কর্মজীবন শুরু করা এবং অপছন্দের একটা কর্মজীবন কাটিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে যাওয়া।

এই বিকলাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে, জগাখিচুড়ি কারিকুলাম দিয়ে কখনোই একটা সুশিক্ষিত সুশৃংখল জাতিগোষ্ঠি গড়ে তুলতে পারবে না বাংলাদেশ।


Sunday, September 21, 2025

অদ্ভুত উটের পিঠে বাংলাদেশ.......

একজন সিনিয়র সচিব লিখেছেন ফেসবুকে। প্রকাশ্যে পাবলিক পোস্ট। পোস্টে উপস্থিত আছেন বর্তমান ও সাবেক অনেক সচিব, আমলা। তাদের মন্তব্য থেকেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এতদিন যা গুজব বলে উড়িয়ে দিতাম, এখন বোধকরি আর সম্ভব নয়। গভীর অন্ধকারে পতিত বাংলাদেশের ভবিষ্যত। চোরের বদলে ডাকাতই বাংলাদেশের ভাগ্য। সাক্ষ্য হিসেবে তুলে রাখলাম দুর্নীতির ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকুক।



কোটি কোটি টাকার সচিব!!!
লিখেছেন শামসুল আলম, সিনিয়র সচিব
---------------------------------------------

বর্তমান সরকারের সময়ে নগদ টাকায় সচিব হয়, এটা কোনো বাজে কথা নয়। চ্যালেঞ্জ করবেন না। এর প্রমাণ আমি নিজেই জানি। ছোট ছোট করে কয়েকটা ঘটনা বলি:
ঘটনা-এক
আমাকে যখন কেবিনেটে বসা আটকে দেয়া হলো, (গত ডিসেম্বরে ড. রশিদের দুদক চেয়ারম্যান, এবং আমার কেবিনেট সচিব হওয়া নির্ধারিত ছিল, প্রধান উপদেষ্টা আমার একটি নথিও সাক্ষর করেছেন), তখন একটা গ্রুপ আমাকে ফোন করেছিল, "স্যার আপনাকে কেবিনেটে বসিয়ে দেই, আমরা শত কোটি টাকা খরচা করবো, আপনি শুধু হ্যাঁ বলুন"। আমি বলেছি, “না। আমি ওই লাইনের লোক না। কিছু না হলেও আমি দুর্নীতির সাথে আপোষ করবো না!"
ঘটনা-দুই
আমি একদিন বসে আছি এক অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি রুমে, তিনি আমার ৬ ব্যাচ জুনিয়র। কথা বলছি। হঠাৎ করে আমাকে বলেই উঠে গেলেন। কোথায় গেল বুঝতে পারিনি। তবে পরে বুঝলাম আমার পেছন দিকে সোফায় বসে কথা বলে এসেছেন খুব নিরবে। আমি শুনতে পাইনি কিছুই। সিটে এসে আমাকে বললেন, "স্যার, ক্ষমা করবেন। দু’জন সমন্বয়ক এসেছিলেন, তাই কথা বললাম।" আরও বলল, "আমার সাথে চুক্তি করতে এসেছিল, আমাকে জ্বালানি সচিব করতে চায় মোটা টাকার অফারে। আমার একটা কালার পিডিএস দিতে হবে, একটা চুক্তিপত্রে সই করতে হবে, আর আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ডের কপি দিতে হবে।" আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি দিয়েছো?" বলল, “না স্যার, আমি দেইনি।” এরপর তার ফোন থেকে আরেকজনের স্যাম্পল দলিলের কপি দেখালো। “স্যার, এই যে দেখেন, একজনকে তারা ওইভাবে চুক্তি করে এক মন্ত্রনালয়ে সচিব করেছে। এইরকম চুক্তি করতে হতো। আমার চাকরি অনেক দিন আছে, আমি এই কাজে যাব না, স্যার”। আমি তাকে সাবাসি দিলাম। এখনও ওই অফিসারটি সচিব হতে পারে নি।
ঘটনা-তিন
মে মাসের ৩০ তারিখে আমার এক নির্ভরযোগ্য লোক একটা দলিল পাঠায়, সেটা বর্তমান বানিজ্য সচিব মাহবুবের ৩৫ কোটি টাকার চুক্তির দলিল। এতদিন এটা থামিয়ে রেখেছিলাম, দেখি ভেরিফিকেশন হোক। ভেরিফাই হয়ে এখন নিউজে পরিণত হয়েছে, তারপর আরো কিছু আসছে এগুলো নিউজ পেপারে।
ঘটনা-চার
১৩ ব্যাচের একজন অফিসার মাত্র তিন মাস সচিবগিরি করে উইড্র হয়ে ওএসডি অবস্থায় আছেন। বছরখানেক চাকরিও আছে। ওকে নিয়ে দুটি আলাদা সোর্স জানতে চায়, এই অফিসারটা কেমন। একটা প্রস্তাবে ৩০ কোটি, আরেকটা প্রস্তাবে ৩৬ কোটি- সচিব করার অফার আছে।
ঘটনা-পাঁচ
এর মাঝখানে, এক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফোন করলেন আমাকে সকাল সাড়ে ন’টার দিকে। তিনি আমাকে জানতে চাইলেন তার সচিব সম্পর্কে। কাস্টমস ক্যাডারের অফিসার, নতুন প্রমোশন পেয়ে সচিব হয়েছেন বিস্ময়কর ভাবে। তিনি জানতে পেরেছেন, এই সচিব ৩৫ কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে এখানে এসেছেন। একজন চরম দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঢাকায় পাঁচটা বাড়ি আছে, ওনার অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপ আছে, পরিবার থাকে সেখানে। উনি আসলে যাবেন এনবিআরে, এবং সেখানকার জন্য কয়েক’শো কোটি টাকার ডিল রেডি আছে।
ঘটনা-ছয়
একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরের ডিজি হিসেবে নিযুক্ত আছেন এরকম পনেরো ব্যাচের এক অফিসারের জন্য ৩০ কোটি টাকার অফার আছে। দুর্যোগ সচিব করা হবে। ওই অধিদপ্তরের এডভাইজার মহোদয়কে আমি আজকে জানিয়েছি যে, আপনার ডিজি সচিব হয়ে চলে যাচ্ছে।
ঘটনা-সাত
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার চুক্তিতে এবং আড়াই কোটি টাকা ক্যাশ দিয়ে। তারপরও চার মাসের বেশি থাকতে পারেনি, এটা এখন সচিবালয়ের সবাই জানে।
ঘটনা-আট
গেলো বছর শেষের দিকে শিপিং মিনিস্ট্রির সচিব বানাতে একজন অফিসারকে অফার দিয়েছিল একজন রিটায়ার্ড লেফটেনেন্ট জেনারেল এবং আলাদাভাবে এডিশনাল সেক্রেটারি এপিডি। ১২ কোটি টাকার ডিল। যারা টাকা খর্চা করবে, তারা পরে তুলে নিবে। কেবল সহযোগিতা করলেই চলবে। অফিসারটি রাজী হননি। পরে অবশ্য তিনি টাকা ছাড়াই সচিব হয়েছেন, এখনও আছেন দুর্বল জায়গায়। সংশ্লিষ্ট অফিসার নিজেই আমাকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন।
আর কয়টা বলব? কাজেই এই সরকারের সময়ে টাকা দিয়ে, অর্থাৎ কোটি কোটি টাকা দিয়ে সচিব হয়, এটা কোনো মিথ্যা কথা নয়। সত্য কথা। সম্পূর্ণ সত্য কথা।
এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না॥
----------------------------------------------------------------------------------
পোস্টের লিংক:
https://www.facebook.com/alampmobd/posts/pfbid0Ygso3kkiaL8LtJ8DEvbPvbG7Werqryvgqv9RcpBjELaNsPKgH4Sq9UpFiA8HXmmCl

পোস্টের স্ক্রিনশট:




দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য:

১. Inbox comment: স্যার, আপনার ফেসবুক পোস্ট দেখে কথা বলছি: আওয়ামী সরকারের চরম বঞ্চনার শিকার আমি ...তম ব্যাচের কর্মকর্তা উপসচিব হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের খুবই অগুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচিতে ৮ বছরের বেশি পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। বঞ্চনাকালে নীরবে বুৎপত্তি অর্জন করে বাংলাদেশের সেরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ পরিচিতি পাই (খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন)। এ সরকারের সময় অতিরিক্ত সচিব হই। আমার উপদেষ্টা আমাকে জানতেন, আমার জন্য হয়তো চেষ্টাও করেছেন দুর্যোগ সচিব করার জন্য। কিন্তু এখানে কী যেন কারিকুরিতে এ সরকারের সময়েই ওএসডি হওয়া আওয়ামী সচিব আবারও পদায়ন পায় দুর্যোগ সচিব হিসেবে। পুরো মন্ত্রণালয়ের কাজ ঝুলিয়ে দেয় সে। আমার সুনামকে হুমকি মনে করে উপদেষ্টাকে বুঝিয়ে আমাকে বিদায় করে দেয় মন্ত্রণালয় থেকে। আমাদের মুখ বন্ধ! কোথাও বলতেও পারি না। ২. Mahbub Kabir Milon একজন উপদেষ্টা তার দপ্তরের ডিজি নিয়োগ করবেন ফিট লিস্ট এর কয়েকজনের ভাইবা নিয়ে। তিনি দেশে ফেরেশতা হিসেবে খ্যাত। তিনি তার দপ্তরের ভাইবা নিচ্ছেন। সামনে বসা তিন সচিবসহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্কর্তা। প্রার্থি ৩/৪ জন। দশ মিনিট করে পরীক্ষা চলছে। সবাইকে একই প্রশ্ন। শেষের জনকে যখন বলা হল, তোমার চাকুরী জীবনের বড় এচিভমেন্ট বল। এটা আগের সবাইকেই জিজ্ঞাস করা হয়েছে। শেষের জন ছিলেন চরম দুর্নীতিবাজ। তিনি হাসিনার আমলের লক্ষ কোটি টাকার এক প্রকল্পের কথা বললেন। তিনি পিডি ছিলেন সেখানে। যে প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর দেশের সবাই জানে। এই প্রকল্পের নাম শোনার সাথে সাথেই উপদেষ্টা প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তুমি তো একটা চোর। মুখ দেখাও কেমন করে!! এত বড় দুর্নীতিবাজ হয়ে এসেছ ডিজি হবার জন্য!! রাগে গজড়াতে গজড়াতে উপদেষ্টা আর একটা কথাও না বলে টেবিল থেকে উঠে গেলেন। পরদিন সকালে শেষেরজনের ডিজি হিসেবে অর্ডার হল। স্বাক্ষী ৩ সচিবসহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই হল ফেরেশতাদের কাহিনী স্যার।





Thursday, September 11, 2025

নেপালের বিপ্লব বনাম সহিংসতা

আরেকটা বিপ্লবের ঘটনা ঘটে গেল নেপালে। এক বছর আগের বাংলাদেশের সরকার পতন আন্দোলনের মতো। প্রায় একই ফরমূলা। আগে শুনতাম হিন্দি সিনেমার নকল করে বাংলা সিনেমা তৈরি হয়। এখানে দেখলাম বাংলা সিনেমার নেপালী সংস্করণ।

নেপালের সিংহদরবারে অগ্নিসংযোগ করেছে সরকার বিরোধী আন্দোলনকারীরা। ধ্বংস হয়ে গেছে হাজার বছরের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদও হারিয়ে গেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো আন্দোলনের সাথে এই সহিংসতাগুলোর সম্পর্ক কী? কেন এমন ঘটছে?

যুগ যুগ ধরে গণ আন্দোলন হয়ে এসেছে দেশে দেশে। কিন্তু তার সাথে যে সহিংসতা যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিককালে, সেটা একটা আত্মঘাতী প্রবণতা। প্রকৃত শত্রুমিত্র না চিনে এরা কোনো না কোনো প্ররোচনায় এরা এই অনর্থক সহিংসতাগুলো ঘটাচ্ছে। এই প্রজন্মের একটা বড় অংশের ডিভাইস এবং সোশাল মিডিয়া আসক্তি এত ভয়াবহ, এরা সকল মানবিক যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলেছে। একসময় হয়তো আক্ষেপ করবে, কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে যাচ্ছে।