Friday, December 21, 2018

আগ্রাবাদ হোটেলে পাক বাহিনীর ইঁদুরপর্ব : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

এই ঘটনাটি অনেকেই জানেন না। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল সাড়ে চারটায় পাকিস্তানীরা ঢাকার রেসকোর্সে আত্মসমর্পন করলেও চট্টগ্রাম শহর তখনো বিপদমুক্ত হয়নি। চট্টগ্রামের পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের কথা ছিল পরদিন। সেদিন চট্টগ্রাম আরেকটি ভয়াবহ রক্তপাতের সাক্ষী হতে পারতো। ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছিল আগ্রাবাদ হোটেলে। সাক্ষী ছিলেন জাপানী রেডক্রস কর্মী তাদামাসা হুকিউরা।

১৭ ডিসেম্বর ভোরবেলা মেজর থাপার নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী যখন শহরে প্রবেশ করছিল তখন চট্টগ্রাম শহর একদম থমথমে। পাক বাহিনীর একাংশ কক্সবাজার হয়ে বার্মা পালিয়ে যাবার চেষ্টায় ছিল। তাদেরকে বাধা দেবার জন্য দোহাজারীর কাছে শংখ নদীর সেতুটা ধ্বংস করারও পরিকল্পনা গ্রহন করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা মেজর জেনারেল উবানের নেতৃত্বে একদল কমাণ্ডো। শেষমেষ পাকিস্তানীরা ওদিক দিয়ে পালায়নি এবং সেতুও ধ্বংস হয়নি। জেনারেল উবানের দল চট্টগ্রাম শহরে আসার কথা থাকলেও শেষমেষ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে দক্ষিণ চট্টগ্রামেই থেকে যায়।

চট্টগ্রামে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় ঢাকা থেকে আসা যৌথ বাহিনী। সেই সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর একাংশ আগ্রাবাদ হোটেলে আশ্রয় গ্রহন করেছিল। ঢাকায় যেমন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল রেডক্রস ঘোষিত নিরপেক্ষ জোন, সরকারীভাবে ঘোষিত না হলেও চট্টগ্রামে আগ্রাবাদ হোটেল ছিল বিদেশী নাগরিকদের আশ্রয় কেন্দ্র। রেডক্রসের বিদেশী কর্মীগন এই হোটেল থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। তাঁরা পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনে মধ্যস্থতার ভূমিকায় ছিলেন।

তাদামাসা হুকিউরা ছিলেন রেডক্রস কর্মী। পুরো মুক্তিযুদ্ধ কালে তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন। প্রধানত হাতিয়া অঞ্চলে কাজ করলেও ঢাকা চট্টগ্রামেও যাতায়াত ছিল কর্মসুত্রে। ঢাকার আত্মসমর্পন পর্বে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তারপর তিনি চট্টগ্রামের আত্মসমর্পন পর্ব প্রত্যক্ষ করার জন্য চট্টগ্রামে চলে আসেন ষোল তারিখ রাতেই।

রেডক্রস কর্মী তাদামাসা হুকিউরা ছাড়াও তখন আগ্রাবাদ হোটেলে ছিলেন পশ্চিম জার্মানীর কোখ, অস্ট্রিয়ার ইয়ানৎস এবং ফরাসী জাঁ পিয়েরে। ১৭ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পনে সম্মত হয়। কিন্তু শর্ত দেয় তারা আত্মসমর্পন করবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। সেই আবেদন নাকচ করে যৌথ বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পন করতে বলা হয়। আত্মসমর্পনের জন্য নেভাল বেইস ও ক্যান্টনমেন্ট এই দুই জায়গায় জড়ো হতে বলা হয়েছিল পাক বাহিনীকে।

ততক্ষণে পাকিস্তানী সৈন্যদের আগ্রাবাদ হোটেলে আশ্রয় নেবার সংবাদে হোটেলের চারপাশে হাজারখানেক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিবাহিনী দাবী জানাতে থাকে হোটেলে অবস্থান করা পাক বাহিনীকে তাদের হাতে তুলে দিতে যাতে তারা প্রকাশ্য গণ আদালতে বিচার করতে পারে। টের পেয়ে ভেতরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের ফাঁদে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো দশা হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তেজিত দেখে তাদামাসা অঘটনের আশংকা করলেন। শেষ মুহুর্তে যদি এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে যায় তাহলে সেটা পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। মুক্তিযোদ্ধারা হোটেল আক্রমণ করলে পাকিস্তানী একজন সৈন্যও রক্ষা পাবে না। আবার তাতে করে হোটেলে অবস্থানরত সব বিদেশীও মারা পড়তে পারে। কেননা হোটেলের ভেতর আত্মগোপন করা পাকিস্তানীরা হুমকি দিচ্ছে তারা হোটেলের বিদেশী অতিথিদের জিম্মি করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে। যদিও একই সময়ে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় কমাণ্ডারের সাথে রেডক্রসের আলোচনা চলছিল আত্মসমর্পনের বিষয়ে, কিন্তু সাধারন মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণ উত্তেজিত ছিল এবং তাদের হাতের স্বাধীন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন ব্যাপার ছিল।

পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ্য করে তাদামাসা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর সহকর্মী পিয়েরেকে শহরের কেন্দ্রস্থলে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। পিয়েরে দেরী না করে ভারতীয় কমাণ্ডার মেজর থাপারের কাছে পৌঁছে গেলেন একটি গাড়ি নিয়ে। পিয়েরের কাছে জরুরী বার্তা পেয়ে মেজর থাপার অনুমান করলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তাই দেরী না করে দ্রুততার সাথে মেজর থাপার তাঁর বাহিনী নিয়ে আগ্রাবাদের দিকে রওনা দিলেন। প্রায় ৩০ ট্রাক ভারতীয় সৈন্য আগ্রাবাদ হোটেলে পৌঁছে যাবার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং হোটেলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করে ভারতীয় বাহিনী। পাকিস্তানী সৈন্যদের কলিজায় পানি আসে।

মজার ব্যাপার হলো পাক বাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের চিরকাল শত্রুজ্ঞান করলেও সেদিন তাদের কাছেই আশ্রয় নিতে কতোটা আকুল হয়েছিল তার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন তাদামাসা ও তাঁর সহকর্মীগন। বেঁচে যাওয়া সেই পাক বাহিনী চিরকাল ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বলে মনে হয়।

অবশেষে কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ রেডক্রসের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করলো পাকিস্তানের তিন বাহিনী। চট্টগ্রামে সেদিন তিন বাহিনী মিলে মোট ৮৬১৮ জন পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পন করেছিল। আগ্রাবাদ হোটেল থেকে রাজাকার ও পাকিস্তানী মিলিয়ে ৭৫১ জনকে বন্দী করা হয়েছিল।


----------------------------------------------------------------------------------------
সুত্র :
১. রক্ত ও কাদা ১৯৭১ - তাদামাসা হুকিউরা
২. Phantoms of Chittagong : the "Fifth Army" in Bangladesh / Major General S.S. Uban

No comments: