ভুলে যাওয়া একটি জাহাজ
জাহাজটিকে এই শহরের সবাই ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। সে তো আজকের কথা নয়। পার হয়ে গেছে দুটো আস্ত শতাব্দী। কত ওলটপালট হয়ে গেছে পৃথিবীর সমাজ-ভূগোল-ইতিহাসে। চট্টগ্রামে নির্মিত এমন আরো কত শত জাহাজ সাগর মহাসাগরে ছড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, তার হিসেব কেউ রাখেনি। এই জাহাজটিও তেমনি তলিয়ে গেছে স্মৃতির অতলে। এমনকি যারা এই জাহাজটি নির্মান করেছিল সেই কারিগরেরাও বিস্মৃত আজ। যে নির্জন বনভূমি তার বৃক্ষ দান করেছিল জাহাজটি নির্মানের জন্য- সেও হয়তো এতদিনে রূপান্তরিত হয়েছে জনবহুল নগরে।
সব মুছে গেলেও ইতিহাসের একটি খাতায় জাহাজটির নাম রয়ে গেছে। নামটি তুলে রেখেছিলেন চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তাঁর 'বন্দর শহর চট্টগ্রাম' গ্রন্থে। সেও অনেকদিন আগের কথা।
কয়েকদিন আগে ইতিহাস পাঠে নিমগ্ন এক পাঠকের চোখ আটকে গেল তাঁর বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠার একটি অংশে। প্রাচীন একটি জাহাজের নাম ও সামান্য দুটো তথ্য আছে সেখানে। তথ্যটি হলো - ১৮১৮ সালে জার্মান সরকার চট্টগ্রাম থেকে একটি জাহাজ নির্মান করিয়ে নিয়েছিল। জাহাজটির নাম ডয়েচল্যাণ্ড। জার্মানীর কোন এক জাদুঘরে এখনো সেই জাহাজটি বর্তমান। এই 'বর্তমান' থাকার তথ্যটিই পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে। কোন বিশেষ গুরুত্বের কারণে জাহাজটি এতকাল সংরক্ষিত করা হয়েছিল?
পাঠক জানে জাহাজ নির্মানে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হাজার বছরের। কিন্তু সেই জাহাজগুলো কেমন ছিল, ধরনধারণ কিছুই জানা নেই। এই শহরের কোথাও তার কোন নিদর্শন নেই। অন্য কোথাও আছে বলে শোনা যায়নি। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সবকিছুই। ইতিহাস পুস্তকের কিছু নীরস বিবরণ ছাড়া তার অস্তিত্ব কোথাও মেলে না। তাই এই জাহাজের বর্তমান থাকার খবরটি পাঠকের কৌতুহলকে উস্কে দিল প্রবলভাবে। তথ্যটি যাচাই করা দরকার। সত্যি সত্যি যদি ওই জাহাজ জার্মানীর কোন জাদুঘরে বেঁচে থাকে তাহলে তার হদিস বের করা অসম্ভব হবে না।
কিন্তু কেবলমাত্র একটা নামকে সম্বল করে কতদূর যাওয়া যাবে? কোন সে জাদুঘর, কোথায় তার ঠিকানা? জার্মানী তো ছোটখাট কোন দেশ নয়। এতদূর থেকে তার হদিস বের করা কতটুকু সম্ভব?
তবু একটা জেদ চেপে যায়। অনুসন্ধান শুরু হয়। দিনের পর দিন অনুসন্ধান চালাবার পর একটু একটু আলোর আভাস দেখা দিতে থাকে এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম তথ্যটি হলো জাহাজটির জন্ম হয়েছিল অন্য একটি নাম নিয়ে। সুতরাং সেই নাম দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। দ্বিতীয় তথ্যটি হলো জাহাজটি আসলে জার্মান সরকারের আদেশে নির্মিত হয়নি- জার্মান সরকারের হাতে পৌঁছানোর ত্রিশ বছর আগে জাহাজটি নির্মিত হয়েছিল এক বৃটিশ কোম্পানীর জন্য। অনুসন্ধান শেষ করে জানা গেল ১৮১৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করার পর জাহাজটি সমগ্র বিশ্বের সবগুলো মহাসাগরে দাপিয়ে বেরিয়েছিল দীর্ঘ ৪০ বছর সময় ধরে। সিঞ্চিত হয়েছিল বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায়। ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রীয় শক্তির চোখে সৃষ্টি করেছিল সমীহের ছায়া।
সেইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনায় যাবার আগে চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান বিষয়ে শতবর্ষ পূর্বে লিখিত একটি প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ পাঠ করা যাক। যাতে বোঝা যাবে এই নগরে শুধুমাত্র হাতুড়ি বাটালী দিয়ে সম্পূর্ণ মনুষ্যশ্রমে এদেশে কিভাবে সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরী হতো। বলাবাহুল্য মধ্যযুগে চট্টগ্রামে যেসব জাহাজ নির্মিত হতো তার নির্মান কৌশল কিংবা তা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে কোন বিবরণ কোথাও নেই বলে আক্ষেপ জাগে। তাই সৌভাগ্যক্রমে পাওয়া ১৯১৪ সালে চট্টগ্রামে নির্মিত "আমীনা খাতুন" নামক একটি জাহাজের জলে ভাসানোর স্মৃতিচারণ পড়ে সেই আক্ষেপ কিছুটা হলেও কাটতে পারে। এই স্মৃতিচারণে জাহাজ নির্মান কৌশলের যেসব বর্ণনা আছে তার সাথে ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ডের নির্মান কৌশল কতটুকু সাদৃশ্য আছে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু এই বিবরণটি আমাদেরকে এদেশের মানুষের হাতের শক্তি সামর্থ্যের মাত্রা সম্পর্কে ধারনা দিতে সক্ষম। কেননা বিশ শতকের সূচনাকালেও চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান শিল্পে মানুষের হাতই ছিল প্রধান হাতিয়ার। বিবরণটি প্রকাশিত হয়েছিল কোলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক 'প্রবাসী'র ১৩২১ সালের ভাদ্র সংখ্যায়। লিখেছিলেন মোহিনীমোহন দাস।
চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান : একটি প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ (১৯১৪)
গত ১ চৈত্র রবিবার চট্টগ্রামের ধনীশ্রেষ্ঠ সওদাগর শ্রীযুক্ত আবদুর রহমান দোভাষী সাহেবের 'আমীনা খাতুন' নামক একখানা বৃহৎ নতুন দেশীয় জাহাজ জলে ভাসান হইয়াছে। দোভাষী সাহেবের কন্যা আমীনা খাতুনের নামানুসারে এই জাহাজের নামকরণ হইয়াছে। বাণিজ্য-পোতার নামকরণ ব্যবস্থা আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর ধনপতি ও মনসা-পুঁথির চাঁদ সওদাগর প্রভৃতির প্রত্যেক সমুদ্রগামী পোতের বিশেষ বিশেষ নাম ছিল। ধনপতির সপ্তডিঙ্গার নাম "নাটশাল", "চন্দ্রবাল", "দুর্গাবর", "মধুকর", "শঙ্খচূড়", "জুয়ারেখী", ও "ছোটমুখী" ছিল। এই সমস্ত পোতারোহনে ধনপতি ও তৎপুত্র শ্রীমন্ত সিংহলে গমন করিয়াছিলেন।
এই জাহাজ ভাসানোর দৃশ্য দর্শনের জন্য বহুল জনসমাগম হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে বোমের কানফাটা আওয়াজ হইতেছিল। পূর্বে কামান দাগা হইত। মঙ্গলবাদ্যের মধ্যে পার্শ্ববর্তী স্থানবাসী ডোম রমণীরা "বরণকুলা" নিয়া "জয়কার" রবে শুভ কার্যের শুভ কামনা করিতেছিল।
কর্ণফুলী নদীতীরবর্তী এক উচ্চ ভূমিখণ্ডে (কোন 'ডকে' নহে) উক্ত জাহাজ নির্মিত হইয়াছিল। আমাদের দেশে সাধারণত বড় বড় নৌকাদি যেভাবে প্রস্তুত হয়, ইহাও সেই প্রকরণেই প্রস্তুত হইয়াছে। বড় বড় গাছের ঠেকনা দিয়া জাহাজকে খাড়া রাখা হইয়াছিল। কোন ডক কারখানা হইতে জাহাজাদি জলে ভাসান যেমন সহজ, ইহা তেমন সহজ বলিয়া মনে হয় নাই। কিন্তু আশ্চর্য। বেলা ৩টার সময় কর্নফুলি পূর্ণ জোয়ারে ভরিয়া উঠিলে মিস্ত্রীরা ক্রমে ক্রমে সব ঠেকনা ফেলিয়া দিতে লাগিল। লোকে মনে ভাবিল এত বড় জাহাজ ঠেকনা ছাড়া কেমন করিয়া থাকিবে-একদিকে হেলিয়া পড়িতে পারে। কিন্তু তাহা হইল না। মিস্ত্রীরা জাহাজের তলা হইতে দুইখানা খুব পালিশ লম্বা তক্তা ঢালুভাবে নদীর ধার পর্যন্ত সাজাইয়া রাখিয়াছিল এবং তাহা ঠিক সমভাবে দুইখানা চৌকা গাছ পালিশ করিয়া জাহাজের দৈর্ঘ্যের সমানে বড় বড় কড়া সংযোগে দড়ি দিয়া জাহাজের তলার দুই পার্শ্বে বাঁধিয়া দিয়াছিল। এই কাঠপাতগুলি এমনিভাবে কুলুপ ছিল যে একটি অন্যটির উপর দিয়া পিছলাইয়া যাইতে পারিবে। কিন্তু এপাশে ওপাশে সরিয়া যাইতে পারিবে না। উক্ত তক্তা ও গাছগুলিকে চর্বি দ্বারা অত্যন্ত পিচ্ছিল করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাহাতে এমন একটি কৌশলপূর্ণ কাষ্ঠনির্মিত 'চাবি' ছিল যে বিনা ঠেকনায়ও জাহাজটি স্থিরভাবে দাঁড়াইয়াছিল। ডাক্তার গোরলে ও তাহার পত্নী দুইটি দুগ্ধপূর্ণ বোতল জাহাজের অগ্রভাগে (গলুই) ভাঙিয়া দিবামাত্র প্রধান মিস্ত্রী একটি হাতুড়ির আঘাতে উক্ত "চাবি" ভাঙিয়া দিল এবং এক মিনিটের মধ্যে জাহাজ যাইয়া জলে পড়িল, -- যেন একটি উড়ন্ত চিল মৎস্য-লোভে যাইয়া জলে ছোঁ মারিল। এইরূপ একখানা বিরাটকায় জাহাজ এক মিনিটের মধ্যে ডাঙা হইতে জলে ভাসান যে কী কৌতুক-জনক ব্যাপার তাহা যিনি চাক্ষুষ করিয়াছেন তিনি ভিন্ন অন্যের বোধগম্য হইবে না। চোদ্দটি হাতির সমবেত শক্তিতে যে কার্য্যসাধন সম্ভব নহে, তাহা যে কী কৌশলে সাধিত হইল তাহা চিন্তার বিষয়। অশিক্ষিত কারিগর দ্বারা এই প্রকার বৃহৎ জাহাজাদি নির্মান- ব্যাপার ও জলে ভাসাইবার কৌশল যে অতি প্রশংসনীয় তাহা বলাই বাহুল্য। যাহারা কস্মিন কালেও কোন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করে নাই এমনকি কোন প্রকার কলের যন্ত্রাদির সাহায্য বিনা, মাত্র দেশীয় হাতুড়ি, বাটালি ও করাতের সাহায্যে এরূপ বিরাট জলযানসমূহ যাহারা নির্মান করিতে পারে, তাহারা ঐশী শক্তিসম্পন্ন সন্দেহ নাই। ইহারাই পূরাকালের 'বিশ্বকর্মা', অসাধারণ শক্তির দ্বারা যাহারা পূর্বকালে আশ্চর্য আশ্চর্য শিল্পদ্রব্য সকল নির্মান করিত, আজকাল 'ইঞ্জিনিয়ার' কথার ন্যায় 'বিশ্বকর্মা' শব্দ তাহাদেরই খেতাব ছিল।
এই জাহাজ-নির্মান কার্য্য উক্ত অশিক্ষিত কারিগরদিগের পুরুষানুক্রমিক ব্যবসায়। পিতার নিকট পুত্র - মামার নিকট ভাগিনেয় শিষ্যত্ব গ্রহন করিয়া এই কার্য্য শিক্ষা করিয়া আসিতেছে- ইহা তাহাদের কলেজ, ই্হাই তাহাদের ইউনিভার্সিটি। অথচ এই জাহাজ দর্শন করিয়া গবর্ণমেন্টের মেরিন সার্ভেয়ার স্বয়ং বলিয়াছেন যে, 'ইহা কোন অংশে বিলাতি জাহাজ অপেক্ষা নির্মানকৌশলে হীন নহে। গঠন ও পরিপাঠ্যও তদনুরূপ। ইহাতে মোটর বা ইঞ্জিন সংযোগ করিলেই স্টিম-শিপ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে'।
এই প্রশংসা চট্টগ্রাম আজ নূতন লাভ করে নাই। সমুদ্র সেবা, জাহাজ নির্মান এবং সমুদ্র-তৎপর বাণিজ্যের জন্য এই দেশ আবহমান কাল হইতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া আসিতেছে। এখনো এই দেশের উপকূল বিভাগে অনেক লোক আছে, যাহারা জলপথে পৃথিবী ভ্রমণ করিয়া, পৃথিবীর যাবতীয় বড় বড় বন্দর স্পর্শ করিয়া আসিয়াছে। ভারত-মহাসমুদ্রের মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান-নিকোবর, জাভা, সুমাত্রা, সিংহল, বর্মা, প্রভৃতি তো সাধারণের চলিত-কথায় নাবিকদিগের 'শ্বশুরবাড়ি' ছিল। ভারত-সমুদ্রের দ্বীপপুঞ্জ হইতে আরম্ভ করিয়া চীন, ব্রহ্মদেশ এবং মিশর পর্যন্ত তাহাদের বাণিজ্য সম্পর্ক অবারিত ছিল। তাম্রলিপ্তিকে অতিক্রমপূর্বক চট্টগ্রাম বাণিজ্য সম্পর্ক একচেটিয়া করিয়া লইয়াছিল। রুমের সম্রাট সেকেন্দ্ররিয়ার(Alexandria) ডক কারখানায় প্রস্তুত জাহাজ না-পছন্দ করিয়া এই চট্টগ্রাম হইতেই জাহাজ প্রস্তুত করাইয়া লইতেন। বিশ বাইশ বৎসর পূর্বেও এই কর্ণফুলি নদী সারিবদ্ধ সমুদ্রহংসীর ন্যায় দেশীয় জলযানে সমাচ্ছন্ন থাকিত।
এই শহরে দক্ষিণ দিকস্থ হালিশহর, পতেঙ্গা প্রভৃতি গ্রামে দেশীয় শিল্পীগণের অনেক জাহাজ নির্মান কারখানা ছিল। এই সমস্ত কারখানা দিবারাত্রি শিল্পীগণের হাতুড়ির ঠক্ঠক শব্দে মুখরিত থাকিত। এই শিল্পীগনের পূর্বপুরুষ ঈশান মিস্ত্রী একজন দক্ষ ও প্রসিদ্ধ কারিগর ছিল। তাহার নামানুসারে এই হাটের নাম আজও 'ঈশান মিস্ত্রীর হাট' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া আসিতেছে। উহা চট্টগ্রাম বন্দরের হালিশহরের নিকটবর্তী। এতদ্ব্যতীত আমরা একজন মুসলমান মিস্ত্রীর কথা শ্রুত হইয়াছি। তাহার নাম ইমাম আলী মিস্ত্রী ছিল। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ মৌজায় তাহার বাড়ি ছিল। অদ্যপি আগ্রাবাদে তাহার ইষ্টকগ্রথিত কবরস্থান বিদ্যমান রহিয়াছে। লোকে বলে, সে এমন ওস্তাদ কারিগর ছিল যে, মানুষ কাটিয়াও জোড়া দিতে পারিত। প্রসিদ্ধ হান্টার সাহেব লিখিয়া গিয়াছেন- "এই জাহাজ নির্মানের কারখানা ১৮৭৫ সন পর্যন্ত নিজের মাহাত্ম্য অক্ষুন্ন রাখিয়াছিল।"
ঐ সময়ের কিছু পূর্বে এক হিন্দু সওদাগরের 'বকল্যাণ্ড' নামক জাহাজ এই দেশের নাবিক দ্বারা পরিচালিত হইয়া স্কটল্যাণ্ডের 'টুইড' পর্যন্ত সফর দিয়া আসিয়াছে। ইংরেজ রাজত্বের উষা সময়ে এই দেশীয় জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপ বেষ্টন করিয়া সর্বপ্রথমে ইংলণ্ড দেশে বন্দরে উপস্থিত হইয়া লঙ্গর ফেলিল, তখন ইংলণ্ডের বিস্মিত নরনারীর কন্ঠ হইতে যে পরিব্যক্ত নিরাশার এবং ঈর্ষার আওয়াজ বাহির হইয়াছিল, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইতিহাসের এক কোণায় তাহা লিখিত আছে। আমাদের মস্তিষ্কের প্রসার ও বাহুর শক্তি এবং আত্মিক সাহসের পালতোলা মাহাত্ম্যতরণী এখন অদৃশ্য হইয়াছে। কলের জাহাজের প্রতিযোগিতায়, ভারতবর্ষের অভ্যেস জনিত শৈথিল্য এবং নিশ্চিন্ত নিদ্রাবশতায় তাহা অতর্কিতে অদৃশ্য হইয়াছে।
আমাদের বর্ণিত 'আমীনা খাতুন' নামক জাহাজ ৪০ জন শুদ্র মিস্ত্রি অবিরত এক বৎসর পরিশ্রম করিয়া প্রস্তুত করিয়াছে। ইহাদের সকলের বাড়ি উক্ত হালিশহর গ্রামে। প্রধান মিস্ত্রির নাম শ্রীকালীকুমার দে। গত ১৯১৩ ইং এপ্রিল মাসে তাহার নির্মাণকার্য আরম্ভ হয় এবং ১৯১৪ ইং মার্চ মাসের ১৫ তারিখে জলে ভাসান হইল। আনুমানিক ৩০০০০(ত্রিশ সহস্র) টাকা এই জাহাজ-নির্মানে ব্যয় হইয়াছে। ইহা ৫/৬ হাজার মণ মাল বহন করিতে সক্ষম। ইহা অপেক্ষা দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বৃহৎ জাহাজ অদ্যপি চট্টগ্রামের সওদাগরগণের অধিকারে থাকিয়া বন্দরের শোভাসম্পদ জ্ঞাপন করিতেছে। যে সমস্ত তক্তা দ্বারা এই জাহাজ তৈয়ারি হইয়াছে তাহা ৪/৫ ইঞ্চি পুরু। প্রবল আঘাতে বা সাধারণ কামানের গোলাতেও তাহা সহজে ভগ্ন হইবার নহে। স্থায়িত্ব সম্বন্ধেও নাকি বিলাতি জাহাজ অপেক্ষা আমাদের জাহাজই শ্রেষ্ঠ।
জাহাজ প্রস্তুতকালে সর্বপ্রথমে এই কারিগরেরা যে নক্সা প্রস্তুত করে তাহা এক বিরাট ব্যাপার। স্কেল করিয়া কাঁটা, কম্পাস, সেটস্কোয়ার দিয়া, পার্চমেন্ট বা ড্রয়িং কাগজে রং বেরং এর চিত্র করিয়া প্ল্যান করা তাহাদের সাধ্যে নাই, কাজেই যত বড় জাহাজ তৈয়ার হইবে তত বড় একখানা বাঁশের চাটাই(এক্ষেত্রে ৮০ফুট লম্বা ও ৪০ ফুট চওড়া একখানা চাটাই ব্যবহৃত হইয়াছিল) মাটিতে বিছাইয়া তাহার উপর চক খড়ি দ্বারা জাহাজের নক্সা-চিত্র অঙ্কিত করে এবং পুনরায় তাহাতে পাকা রং দিয়া দাগগুলি ফুটাইয়া তুলে। তৎপর সেই দাগে দাগে পিজবোর্ডের ন্যায় পাতলা তক্তা দ্বারা ফরম-সকল তৈয়ার করিয়া লয় এবং সেই ফরমার মাপে জাহাজ তৈয়ার করে। অথচ জাহাজ গড়িতে ইহাদের কোন প্রকার ব্যতিক্রম হয় না। পাশ্চাত্য শিক্ষিত 'বিশ্বকর্মা' গণের ন্যায় একবারের কাজ তিনবার ভাঙিয়া গড়া তাহাদের অভ্যাস নাই।
সর্বপ্রথমে জাহাজের দাঁড়া বা মেরুদণ্ড পত্তন করিয়া তাহা হইতে তক্তা গাঁথিয়া ক্রমে জাহাজের গর্ভ(hald) তৈয়ার হইলে পরে পাটাতন (deck), কেবিন ইত্যাদি ও হাল মাস্তুল প্রভৃতি তৈয়ার হয়। এই জাহাজগুলি সাধারণত ২টি মাস্তুল থাকে মধ্যেরটি main-mast সম্মুখেরটি fore-mast । আবশ্যক মত বাতাসের অবস্থা বুঝিয়া মাস্তুলের উপরও মাস্তুল চড়ান হয়। তাহাদের প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক নাম আছে। তাহার উপর রশারশি ইত্যাদি বাঁধিয়া পাল খাটানের বন্দোবস্ত করা হয়।
এই সমস্ত জাহাজ সর্বদাই দক্ষ নাবিকদিগের দ্বারা কেবল পাল খাটাইবার কৌশলে চালিত থাকে। ইহা কেবলই বাহির সমুদ্রেই(sea and ocean) চালিত হইয়া থাকে। গভীর ও বৃহৎ নদীপথেও কখনও কখনও দেখা যায়। কেবল পালের দ্বারা এই সমস্ত জাহাজ সময় সময় কলের জাহাজকেও পরাস্ত করিতে দেখা গিয়াছে। আমরা হালিশহরনিবাসী শ্রীযুক্ত আলী সওদাগরের নিজ মুখে শ্রুত হইয়াছি যে, তিনি তাহার সুবৃহৎ 'রহেমানী' নামাক জাহাজে চড়িয়া বহুবার ভারত মহাসাগরের উপকূলস্থ প্রায় সমস্ত বন্দর ও দ্বীপপুঞ্জ পরিভ্রমণ করিয়াছেন। একদা তিনি তাহার এই 'রহেমানী' লইয়া অনুকূল বায়ু ভরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এক দিবসে রেঙ্গুন পৌঁছাইয়াছিলেন। অতি দ্রুতগামী কলের জাহাজও তিনদিন রাত্রির কমে এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিতে পারে না। একথা স্মরণেও শরীর পুলকে নাচিয়া ওঠে - কিন্তু হায়, কোথায় সেই দিন! পূর্বকালে সমস্ত জাহাজই বিপক্ষের আক্রমণ ও জলদস্যুগণের কবল হইতে আত্মরক্ষার জন্য কামান-বন্দুক ও বারুদ-গোলায় পূর্ণ থাকিত। আজকালও চট্টগ্রামের প্রাচীন সওদাগরগণের গৃহে ভগ্ন ও অব্যবহার্য কামানসমূহ দৃষ্ট হইয়া থাকে।
ভারতীয় বন্দর সমূহের অধিকাংশ দেশীয় এবং বিলাতী কলের জাহাজই চট্টগ্রাম ও পূর্ববঙ্গের লস্করের বাহুল্য দৃষ্ট হইয়া থাকে। নাবিক বিদ্যায় যে ইহারা খুব দক্ষ এবং কর্মঠ ও কষ্টসহিষ্ণু ইহাই তাহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। পূর্ববঙ্গের লস্করেরা নৌচালনা বিদ্যায় যেরূপ পারদর্শী অন্য কোন দেশের লোক তেমন নহে। পূর্বকালে প্রত্যেক ক্ষমতাশালী রাজা রাজড়াদিগের "পাইক, শিক, সাদী, লস্কর" থাকিত। পুরাতন পুস্তকাদিতেও এই কথা দৃষ্ট হয়। এই "পাইক, শিক, সাদী, লস্কর" কথাটি কি? পাইক অর্থ পদাতিক; শিক বা শিকদার অর্থ বন্দুকধারী সৈন্য। সে সময় যে বন্দুক ব্যবহৃত হইত, তাহাকেই সাধারণত ছড়ি বন্দুক বা শিক বন্দুক বলিত এবং তাহা ব্যবহারে যাহারা সক্ষম ছিল তাহাদের উপাধিই শিক বা শিকদার। এই বন্দুক আমরা দেখিয়াছি। তাহা একটি লোহার নল বিশেষ। এই নালিকার ভিতর বারুদ পূর্ণ করিয়া একটি ছিদ্র পথে পলিতা দ্বারা আগুন দিয়া আওয়াজ করা হইত। দেখিতেও ইহা একটি শিক বা ছড়ির ন্যায়ই ছিল। একহাতে ধরিয়া অন্যহাতে আগুন দেওয়া হইত। ক্যাপ বা কার্টিজ তখন ছিল না। এই শিকদার কথা ক্রমে দেহরক্ষী হইতে ঘরের গোলামে পর্রবসিত হইয়াছে। সাধারণ কথায় "সিং" শিকদাররূপে ব্যবহৃত হয়। আর "সাদী" মানে অশ্বারোহী, "লস্কর" নৌসৈন্য। এখন এই লস্কর মানে হইয়াছে সাধারণ নাবিক। বঙ্গদেশ হইতে নৌ-যুদ্ধ তিরোহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় লস্কর শব্দের নৌ-সৈন্য অর্থে সৈন্য কথাটুকু বাদ পড়িয়া থাকিবে। তখন লস্করদিগকেও যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হইতে হইত, নতুবা বিপক্ষে বা দস্যুর আক্রমন হইতে জাহাজ রক্ষা করা কঠিন ব্যাপার ছিল। পাশ্চাত্যে নাবিক(Sailor) সকলেই নৌ-সৈন্য বিশেষ। আমাদের কায়স্থ ভদ্রদিগের মধ্যেও লস্কর উপাধি দেখা যায়। তাহাদের পূর্ব-পুরুষ নৌবিদ্যা বিশারদ ছিলেন বলিয়াই বোধ হয় এই পদবী লাভ হইয়া থাকিবে।
নাবিকদিগের মধ্যে প্রধান বা প্রথম, - "মালুম" যন্ত্র সাহায্যে দিক নিরূপন ও সময় এবং স্থান নির্দেশ করিয়া থাকে; দ্বিতীয় "সারেং" জাহাজ পরিচালনা করে; তৃতীয় "সুকানি বা ছয়ানী" হাইল ঠিক রাখে, এবং চতুর্থ "খালাসীগণ" অন্যন্য কার্যে ব্যাপৃত থাকে।
কেবল চট্টগ্রাম কেন, সমস্ত ভারত হইতে এই শিল্প ক্রমে লুপ্ত হইয়া যাইতেছে। বিগত ২০/২৫ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামে এই একখানা জাহাজ তৈয়ার হইল।
[চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান, মোহিনীমোহন দাস প্রবাসী ১৩২১, ভাদ্র]
চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মানের এই বিবরণটুকু আমাদের আলোচ্য জাহাজটির একশো বছর পরের হলেও এতে চট্টগ্রামের আদিম জাহাজ নির্মান কৌশলের ছাপগুলো তখনো স্পষ্ট ছিল। বিশেষ করে এদেশের অশিক্ষিত কারিগরেরা শুধুমাত্র তাদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও কৌশল দিয়ে এই শিল্পকে বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সুসংহত অবস্থায় টিকিয়ে রেখেছিলেন শতশত বছর ধরে, তার একটি পরিষ্কার দৃষ্টান্ত এখানে খুঁজে পাওয়া যায়।
এবার ফিরে যাওয়া যাক ১৮১৮ সালে আমাদের মূল আলোচিত জাহাজ ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ডের ইতিহাসে। এই জাহাজটির জীবদ্দশাকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে নাম ও মালিকানা পরিবর্তনের ভিত্তিতে।
Alfred যুগ (১৮১৮-১৮৪৫)
১৮১৮ সময়কালে বৃটিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান Fraser Living & Co. চট্টগ্রাম শহরের জাহাজ নির্মাতা James McRae এর সাথে মহাসাগরে চলাচল উপযোগী আধুনিক একটি জাহাজ নির্মানের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। তৎকালে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট জাহাজ নির্মাতা হিসেবে James McRae ছিলেন খুবই সুপরিচিত ব্যক্তি। বর্তমান সদরঘাটের কর্ণফুলী নদীর তীরে ছিল তাঁর জাহাজ নির্মান কারখানা। সেই সময় জেমস ফিনলে সহ নানান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাঁর কাছ থেকে জাহাজ তৈরী করে নিতো।
তবে ফ্রেজার লিভিং নতুন যে জাহাজটির জন্য চুক্তি করে তখন তার একটি বিশেষত্ব ছিল। নতুন জাহাজটি হবে আর দশটি জাহাজের চেয়ে আলাদা। অনেক মজবুত এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই জাহাজকে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী করে তৈরী করতে হবে। জাহাজটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন শক্ত হবে যেন মাঝ দরিয়ায় জলদস্যুদের মোকাবেলা করা যায়। তাই শক্তিশালী কামান বসানোর ব্যবস্থাও রাখা হয় জাহাজটিতে।
স্থানীয় মিস্ত্রী ও কারিগরকে লাগিয়ে রাতদিন খেটেখুটে জাহাজটি যখন নদীতে ভাসানোর উপযোগী করা হয় তখন কী এর কারিগরদের চোখে গর্বের হাসি ফুটেছিল? চট্টগ্রামে তৈরী সরের জাহাজ বহুকাল যাবত বিশ্বখ্যাত। শোনা যায় মধ্যযুগের তুরস্কের সুলতানও একসময় এখান থেকে সরের জাহাজ বানিয়ে নিয়েছিলেন। হয়তো সম্রাট জেনেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার চেয়ে চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজ আরো উন্নত।
১৮১৮ সালে চট্টগ্রামের কর্নফুলী তীরে সদ্য নির্মিত তিন মাস্তুলের সেই জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছিল Alfred নামে। Alfred শুরুতে মূলত বাণিজ্যিক কার্গো জাহাজ হিসেবে দূরপ্রাচ্য এবং ভারতের বিভিন্ন বন্দরে পণ্য বহন করতো। ভাড়া খাটতো ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাজেও। ফ্রেজার লিভিং কোং এর মালিকানায় দশ বছর চলার পর ১৮২৮ সালে জাহাজটি হাতবদল হয়ে চলে যায় লণ্ডনের J Flint নামে এক কোম্পানীর হাতে। জে.ফ্লিন্টের হয়ে আরো সতের বছর বিভিন্ন মহাসাগরে চলার পর ১৮৪৫ সালে দক্ষিন আমেরিকার ভ্যালপারাইসোতে জাহাজটির উপর নজর পড়ে জার্মানীর শীর্ষ জাহাজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান JC Godeffroy & Sons এর।
Cesar Godeffroy যুগ (১৮৪৫-১৮৪৮)
JC Godeffroy & Sons নামের জার্মান এই কোম্পানীর বিশ্বব্যাপী দেড়শো জাহাজের কারবার ছিল। Alfred তখন ইউরোপ থেকে দক্ষিণ আমেরিকার রুটে চলাচল করতো। সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যের শাখা ছিল জার্মান কোম্পানীটির। দুনিয়ার সেরা জাহাজ সংগ্রহে যাদের আগ্রহ বরাবরই বেশী এই জাহাজটি তাদের নজর কাড়বে এটাই স্বাভাবিক। পছন্দ হওয়ামাত্র জার্মান কোম্পানী জাহাজটি কিনে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
কেনার পর জাহাজটির নতুন নামকরণ করার সিদ্ধান্ত হয়। কোম্পানীর বহরে এই জাহাজটি ছিল সবচেয়ে সেরা বলে বিশেষ যত্ন নিয়ে এর নামকরণ করা হয় কোম্পানীর শীর্ষ ব্যক্তি Cesar Godeffroy এর নামে। কিন্তু এই নাম নিয়ে বেশীদিন চলতে পারেনি জাহাজটি। সেই সময়ে সীমান্তবর্তী দুটো শহরের দখল নিয়ে জার্মানী এবং ডেনমার্কের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৮৪৮ সালে সেই উত্তেজনা রূপান্তরিত হলো সর্বাত্মক যুদ্ধে (ইতিহাসে শ্লেজউইগ-হলস্টেন যুদ্ধ ১৮৪৮-৫১ নামে পরিচিত)। সেই যুদ্ধে নৌশক্তিতে জার্মানীর চেয়ে এগিয়ে ছিল ডেনমার্ক। সীমান্ত যুদ্ধে জার্মানীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল প্রুশিয়াসহ বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের বাহিনী। তবু জার্মান সরকার যুদ্ধের কাজে সাধারণ নাগরিকদের কাছেও সাহায্য চাইল। সরকারের ডাকে সাড়া দিল সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা। জার্মানীর হামবুর্গে সভা করে দেশপ্রেমিক জার্মান ব্যবসায়ীরা তাদের সর্বস্ব দিয়ে সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত হলো। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল শীর্ষ জাহাজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান JC Godeffroy & Sons. দেশের চরম দুর্দিনে তাদের সেরা জাহাজটিকে জার্মান সরকারকে উৎসর্গ করলো তারা। এবং সেই সেরা জাহাজটি ছিল Cesar Godeffroy.
Deutschland যুগ (১৮৪৮-১৮৫৮)
জার্মান নৌবাহিনীর হাতে যাবার পর জাহাজটিকে যুদ্ধের উপযোগী করে সংস্কার শেষে আবারো নতুন নামকরণ করা হয়। এবারের নাম Deutschland, আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ড। এই জাহাজ এখন সামরিক কাজে ব্যবহার করা হবে তাই এটার নামের সাথে ফ্রিগেট যোগ করা হয়। কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। জাহাজের সংস্কার কাজগুলো তার জন্য ঠিক উপযুক্ত ছিল না। জাহাজটিকে ৩২ কামানে সজ্জিত করতে গিয়ে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল সেইসব পরিবর্তন জাহাজটির পূর্বতন সক্ষমতাকে নষ্ট করলো। ফলে জাহাজটি যুদ্ধে নামার পর ডেনিশ যুদ্ধজাহাজের সাথে পাল্লা দিতে অক্ষম দেখা গেল। বিফল হয়ে জার্মান বাহিনী যুদ্ধের বদলে জাহাজটিকে প্রশিক্ষণ জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে ।
যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তিন বছরের মাথায়। অতঃপর ১৮৫২ সালে Deutschlandএর মালিকানা আবারো বদলে যায়। Roessingh & Mummy নামের একটি শিপিং কোম্পানী জাহাজটি কিনে নেয়। এই পর্বে জাহাজটি ইংল্যাণ্ড এবং চীনের মধ্যে কয়লা পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত এই কাজে নিয়োজিত থাকার পর জাহাজটির নাম লয়েডস রেজিস্টার থেকে মুছে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে ৪০ বছর। সেই যুগে এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকার রেকর্ড খুব কম জাহাজেরই ছিল। এর পরেও জাহাজটিকে চীনা নৌবাহিনী আরো কয়েক বছর ব্যবহার করেছিল বলে জানা যায়।
ব্রেমারহাভেন মিউজিয়ামের ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ড
জাহাজটি সম্পর্কে অনুসন্ধানের শেষ পর্ব ছিল একটি তথ্য যাচাই করা। নিশ্চিত হওয়া যে জাহাজটি আসলেই বর্তমানে জার্মানীর কোনও জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বলা চলে, এটিই ছিল সবচেয়ে কঠিন পর্ব। নানাভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে সেই জাদুঘরটির নামও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। জার্মানীর উত্তরের শহর ব্রেমারহাভেনে অবস্থিত বিখ্যাত নৌ জাদুঘরটির নাম German Maritime Museum. তাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা পাওয়া গেলেও তাতে যোগাযোগ করার কোন ঠিকানা ছিল না। ফলে ওয়েবসাইটের একটি অংশে ট্যুরিস্টদের জন্য রাখা প্রশ্ন বুথের মাধ্যমে মিউজিয়ামের ট্যুরিস্ট সেকশানের কাছে বার্তা পাঠানো হয় ইমেইল ঠিকানা সহ। সাধারণত এমন বার্তার জবাব আসার সম্ভাবনা খুব কমই থাকে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে পরদিনই যখন জবাব এসে হাজির হলো। ইমেইল মারফত জবাব দিয়েছিলেন ট্যুরিজম বিভাগের Frank Sleine, তিনি মিউজিয়াম কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেন আমার অনুসন্ধান বিষয়ে। তারপর ডয়েচল্যাণ্ড সংক্রান্ত আমার প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে নিশ্চিত করে জানালেন ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ডের একটি প্রতিকৃতি সত্যি বহুকাল ধরে তাদের জাদুঘরে রাখা ছিল। তবে ২০০৭ এর পর সেটি কোথাও সরিয়ে ফেলা হয় কিংবা নষ্ট হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত আর কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। এটুকুই যথেষ্ট। জানার ছিল আবদুল হক চৌধুরীর বইয়ের সেই তথ্যটি সঠিক কিনা। সঠিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেল।
এবার মিউজিয়াম সুত্রে প্রাপ্ত সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি শেয়ার করছি। চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান শিল্পের গল্প শুনেছিলাম ঠিক, কিন্তু সেই জাহাজগুলো দেখতে কেমন ছিল, তা দেখার কোন সুযোগ কখনো হয়নি। এই প্রথম সেই সুযোগ আসলো। সেই জাহাজটির কয়েকটি দুর্লভ পেইন্টিং এখনো টিকে আছে। যে পেইন্টিং জার্মান ভাষার উইকিপিডিয়ায় সংরক্ষন করা হয়েছে। ছবিগুলো আমাদের জাহাজ নির্মান শিল্প নিয়ে জমে থাকা গর্বকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বাংলাদেশের গৌরবময় সোনালী অতীতের আরেকটি ছোট্ট নিদর্শন এই জাহাজটি।
গভীর সমুদ্রে ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ড [ Painting by Lüder Arenhold (1854-1915) ]
ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ডের অভ্যন্তরভাগ (ছবিসুত্র : উইকিপিডিয়া)
ফ্রিগেট ডয়েচল্যাণ্ডের মূল ফিচার
Tons burthen : 681
Length : 136 ft 3 in (41.5 m) (keel)
Beam : 35 ft 2 in (10.7 m)
Propulsion : Sail
Notes : Teak-built
একজন James McRae এবং উপনিবেশ আমলে চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান শিল্প
আগেই বলা হয়েছে এই জাহাজটির নির্মাতা ছিলেন James McRae, তিনি চট্টগ্রামবাসী এক ইংরেজ। চট্টগ্রামের স্থানীয় মিস্ত্রী ও কারিগরদের হাতে জাহাজটির নির্মান সম্পন্ন হলেও নির্মাতা হিসেবে James McRae এর নামই আছে সকল রেকর্ডে। কারণ তিনিই প্রতিষ্ঠান প্রধান। তার হাতে চট্টগ্রামে আরো বেশ কিছু জাহাজ নির্মিত হয়েছিল উনিশের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে। পুরোনো শিপিং রেকর্ডে বেশ কয়েকটি জাহাজের নির্মাতা হিসেবে তার নাম পাওয়া গেছে যেমন - Thetis (1813), Aurora (1816), Ann and Amelia (1816), Dunvegan Castle (1819). তবে এই জাহাজগুলোর চেয়ে আলফ্রেড বা ডয়েচল্যাণ্ডের বিশেষত্ব হলো এর দীর্ঘায়ু।
উনিশ শতকের প্রথমভাগে তৈরী কাঠের তৈরী একটা সরের জাহাজ এত দীর্ঘদিন সমুদ্রে চলাচল করা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। তখনকার দিনে নানান ঘটনা দুর্ঘটনা সয়ে একটি জাহাজ দশ বছর চলাটাও বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু এই জাহাজ এক নাগাড়ে ৪০ বছর সচল ছিল পৃথিবীর সবগুলো মহাসাগরে। ডয়েচল্যাণ্ডকে সেই কারণেই অনন্য সাধারণ একটি জাহাজ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
জেমস মেকরে নামের জাহাজ নির্মাতা এই ভদ্রলোক সম্পর্কে খুব বেশী তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে এই অঞ্চলের একজন শীর্ষ জাহাজ নির্মাতা ছিলেন ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কেননা ১৮১৮ সালে John Cheape এর আঁকা চট্টগ্রাম শহরের এক প্রাচীন মানচিত্র অনুসারে শহরের অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান তাঁর অধিকারে ছিল। তার বাড়ি হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে ফেয়ারী হিলকে(বর্তমান কোর্ট বিল্ডিং পাহাড়ে), তাঁর একটি বাগান দেখানো আছে সার্সন রোড থেকে কাজির দেউড়ি পর্যন্ত রাস্তার উত্তরদিকের সমগ্র এলাকা জুড়ে। তাঁর কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ জাহাজ নির্মানের কারখানা দেখানো হয়েছে বর্তমান সদরঘাট জেটি এলাকায়। সম্ভবত পদ্মা অয়েল কোম্পানীর বর্তমান হেড অফিস এবং তার আশপাশের পুরো জায়গাটি জুড়ে তাঁর জাহাজ নির্মানের কারখানা ছিল।
জাহাজটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সম্পর্কে এটুকু তথ্য মিললেও তার মূল কারিগর, ডিজাইনার, মিস্ত্রী এবং অন্য কলাকুশলী সম্পর্কে সম্পর্কে কোন তথ্য মেলে না। তাই বলে আমাদের গৌরব কী স্তিমিত থাকতে পারে? মোটেও না। তথ্য অনুসন্ধান করে যা পাওয়া গেছে তাতে আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছি ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রামের কারিগরেরা কী মানের জাহাজ নির্মানে সিদ্ধহস্ত ছিল। সে আমার পলিবিধৌত সমগ্র বাংলাদেশেরই গৌরব।
তথ্যসুত্র :
* East India Company Ships Register : Anthony J Farrington, Catalogue of East India Company Ships' Journals and Logs 1600-1834, 1999, British Library, 0712346465, p17
* Lloyd's Register (1820)
* British Library- Alfred: Deck Log, IOR/L/MAR/B/140N : 13 Mar 1827-8 Mar 1828
* Jean Cesar VI. Godeffroy, www.mein-altes.hamburg
* Wikipedia : Deutschland (Schiff, 1818)
* German Maritime Museum, Bremerhaven, Germany
* Chittagong City Map 1818 by John Cheape (5 October 1792 – 30 March 1875)
* চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান - মোহিনীমোহন দাস, মাসিক প্রবাসী, ভাদ্র ১৩২১