মানবজাতির সবচেয়ে বড় অংশ দুবেলা পেট ভরে খেতে পারলেই সন্তুষ্ট। তাদের আর কোনো চাওয়া নেই। শুধু খাদ্য। সেটাই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় অনেক জায়গায়। আবার যাদের যথেষ্ট খাদ্য আছে তাদের একটা অংশ নিজেদের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য দুনিয়া জুড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগাতে ব্যস্ত। ভূগোল দখলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ব্যস্ত থাকে আরেকটা অংশ। সারা পৃথিবীতে ইউরোপ, আমেরিকা আর পূর্ব এশিয়া নিজেদের ভালো বুঝতে পেরে যুদ্ধের খেলা থামিয়ে দিয়ে উন্নতি করে যাচ্ছে গত অর্ধশতাব্দী ধরে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার প্রায় পুরোটা এখনো নির্বুদ্ধিতার জগতে বাস করছে। এরা ধর্ম, গোত্র, জাতি ইত্যাদি নানান মতবাদে বিভক্ত হয়ে অশান্তি জারি রেখেছে বছরের পর বছর। বাংলাদেশে সেই নির্বোধদের একটা অংশ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। এই দেশের বড় অংশের মানুষ চোর, প্রতারক, ভন্ড। একইসাথে এরাই আবার প্রচণ্ড ধার্মিক। উপমহাদেশের প্রধান দুই ধর্ম হিন্দু আর মুসলমান এই মানুষগুলোর আশ্রয়। এরা নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা করে আবার পরস্পরের সাথেও দাঙ্গা করে। এরা নিজেদের কেবল শ্রেষ্ঠ বলার জন্য অগণিত খুনাখুনি করতে পারে। এরা নিজেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলতে চায়। এরা বোঝে না নিজেকে নিজে কেউ শ্রেষ্ঠ বললে সেটা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব বোঝায় না। অন্যেরা যখন শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃতি দেয় তখনই কেউ শ্রেষ্ঠ হতে পারে। নিজেকে নিজে শ্রেষ্ঠ বলা মূর্খতা এবং লজ্জার বিষয়। কিন্তু লজ্জার বদলে অহমিকা তাদের অন্ধ করে রেখেছে তাই নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবার অসুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এই অসুখে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ বাংলাদেশ ও ভারত।
Saturday, December 28, 2024
Sunday, December 22, 2024
মূর্খতার প্রতিযোগিতা
সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষের উদাহরণগুলো ধারণ করে না উপমহাদেশের অসভ্য নির্বোধ মূর্খ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো। সাধারণ শিক্ষিত মানুষের ভেতরেও সফলতার সাথে এইসব মূর্খতার সফল অনুপ্রবেশ ঘটাতে পেরেছে এরা। একশো বছর আগে উপমহাদেশে যেসব শিক্ষা সভ্যতা আলো প্রবেশ করেছিল, এই সময়ে সেই জায়গাগুলো কালিমালিপ্ত হয়ে গেছে। অন্তত কিছু মানুষের চোখে এইসব অন্ধতা গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। এদের হাস্যকর অন্ধযুক্তিগুলো নিয়ে এরা ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকবে বাকী পৃথিবী থেকে। মূর্খতার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
জুলাই মাসে যারা বিপ্লব করলো সে বিপ্লবে দেশের বিরাট অংশের মানুষ সমর্থন করেছিল। পর্বতসমান সমর্থন নিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ৫ আগষ্টের পর থেকে সেই সমর্থন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। গত ৫৩ বছরের ইতিহাসে যে কয়টি গনঅভ্যুত্থান হয়েছে তার কোনোটিতেই এমন হয়নি। এবার কেন এমন হলো। যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই জনপ্রিয় ছাত্র সমন্বয়কগুলো ধীরে ধীরে অপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো। দুমাস যাবার পর তাদের অবস্থা প্রায় গণধিকৃত হয়ে পড়েছে। কেন এমন হলো?
কারণ তারা একটা বিশাল প্রতারণা করেছে জাতির সাথে। মুখোশ পরে আন্দোলন করেছে। একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠির হয়ে কাজ করেছে। যে গোষ্ঠি বাংলাদেশে ঘৃণিত। ঘৃণিত বলেই তারা আন্দোলন করার সময় তাদের ব্যানারে রাস্তায় নামতে পারেনি। এমনকি তাদের নাম নিতেও কুন্ঠিত ছিল ৫ আগষ্টের পরেও। মানুষকে মিথ্যে কথা বলে প্রতারণা করে যখন স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে এবং আন্দোলনে গণমানুষের অংশগ্রহনকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করছে, তখনই মানুষ ঘৃণায় সমর্থন তুলে নিয়েছে। ফলে এই আন্দোলনের যে ফসল ঘরে তোলার কথা ছিল তার বদলে দেশজুড়ে চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। এই দেশকে সিরিয়া না হলেও মোটামুটি পাকিস্তানের মতো পঙ্গু অথর্ব রাষ্ট্রে পরিণত করবে। বাংলাদেশের গৌরব করার মতো কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এরা নিজেরাও ডুববে, বাংলাদেশকেও ডোবাবে। কিন্তু সেটা বুঝতে অনেক লম্বা সময় লেগে যাবে। কেননা আওয়ামী লীগের মতো এরাও দলকানা। এদের অন্ধতা মূর্খতা অতীতের সকল মূর্খতাকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ভবিষ্যতে এমন একটা বাংলাদেশ দেখবো, যেটা আগে কখনো কল্পনা করিনি। দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মানুষ বাস করে, একই সাথে এখানে আছে মানুষ নামের একদল পঙ্গপাল, যারা ভালোমন্দ না বুঝে মতলবাজ ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় গাধার জীবন বেছে নিতে পারে।
Friday, December 13, 2024
এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী
না সজনী,না,আমি জানি জানি,সে আসিবে না।
এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী,বাসনা তবু পূরিবে না।
জনমেও এ পোড়া ভালে কোন আশা মিটিল না॥
যদি বা সে আসে,সখী,কী হবে আমার তায়।
সে তো মোরে,সজনী লো,ভালো কভু বাসে না--জানি লো।
ভালো ক'রে কবে না কথা,চেয়েও না দেখিবে--
বড়ো আশা করে শেষে পূরিবে না কামনা॥
পাপিয়া সারোয়ারের কন্ঠে এই গানটা আমার কানে স্থির হয়ে আছে । তাঁকে কখনো মুখোমুখি দেখিনি। কিন্তু কৈশোর থেকে রেডিওতে বহুবার শুনেছি গানটা। গানটা আর কারো কন্ঠেই এত ভালো লাগেনি। ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে তিনি চলে গেলেন। একই দিনে আমার আরেকজন প্রিয় মানুষের প্রস্থান ঘটলো। সেও অনেক বাসনা পুরণ না করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
পাপিয়া সারোয়ার চলে যাবার খবরটা পেয়েছি লেখক ইমতিয়ার শামীমের পোস্ট থেকে। সেটাই তুলে রাখলাম এখানে।
সেই কৈশোরেই আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল, ‘জনমেও এ পোড়া ভালে, কোনো আশা মিটিল না’; জানা হয়ে গিয়েছিল, ‘এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী, বাসনা তবু পুরিবে না’; জানা হয়ে গিয়েছিল— কেননা এমন কোনও দিন ছিল না, যেদিন একজন পাপিয়া সরোয়ারের কণ্ঠ বেতারে শোনা যেত না, ইথারে ভেসে ভেসে ধরা দিত না আমাদের শ্রুতিজগতে।
গাঁয়ে আমার মা-বাবা বাড়ির পূবদুয়ারি যে ঘরটির দক্ষিণদুয়ারি একটি কোঠায় একদা আমি বাস করতাম, যে ঘর কিংবা কোঠার কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই, সেখানে কখনো লালরঙা রেডিওটায় ‘ হোল না লো হোল না লো সই ‘ বেজে উঠলেই বাড়ির ভেতরের উঠান থেকে ভেসে আসত কাজের মেয়ে কোমেলার তীব্র হাসি; কিন্তু কখনো সেই একই কণ্ঠ ‘নাই টেলিফোন নাই রে পিওন নাই রে টেলিগ্রাম’ গেয়ে উঠলে তাকে আর হাসতে দেখা যেত না।
তখন খুব বেশি মানুষজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন না, গাইতেন তো একেবারেই হাতেগোণা কয়েকজন। কিন্তু আমাদের অজ পাড়া গ্রামটিতে অদ্ভূত এক কারণে সবাই রবীন্দ্র সঙ্গীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। গাঁয়ের রাখালদেরও যখন-তখন দেখা যেত গরু চড়াতে চড়াতে গাইছে, ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগলপারা...’, গাইছে ‘ ভেঙে মোর ঘরের চাবী, নিয়ে যাবি কে আমারে...’। ছায়ানটের একেবারে প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন আমাদের এক ফুফাতো ভাই, যাকে আমরা ডাকতাম ঢাকার খোকন ভাই নামে। কী যে তাঁর হয়েছিল, লেখাপড়া বাদ দিয়ে গাঁয়ে গিয়ে থেকেছিলেন তিনি বছরের পর বছর। কামরুল হাসানের ব্রতচারী বিদ্যায় দীক্ষিত সেই ভাই সকাল বিকাল শুধু ব্যায়াম করতেন আর হারমোনিয়ামে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। আরও একটা কাজ ছিল তাঁর, গাঁয়ের পুকুর আর জলাভূমিতে ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরে বসে থাকতেন পারে। অমন গভীর মনযোগ দিয়ে মাছ ধরতে আমরা আর কাউকেই দেখিনি। কী অদ্ভূত, গোপীবাগের সেই খোকন ভাইয়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়াকে ভ্যাঙচাতে ভ্যাঙচাতেই আমরা গাঁয়ের আপামর জনগণ বেসুরো কিন্তু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়লাম রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে।
ওই বয়সে, খোকন ভাই যখন বলতেন, একেবারে মুখোমুখি বসে গান শুনেছেন পাপিয়া সারোয়ারের, তখন খুব অবাক হয়ে যেতাম—সত্যি বলছে তো?!
যেভাবে হুট করে এসেছিলেন, কয়েক বছর বাদে তেমনি হুট করে আবারও গোপীবাগমুখো হলেন খোকন ভাই। আমি বলি, সেদিন থেকে আমাদের গাঁয়ের মানুষজন হারাতে শুরু করল মাছ ধরার অপরিসীম ধৈর্য্য, হারাতে বসল জীবনের সুর ও রবির প্রাণশক্তি। তবু বেতারে পাপিয়া সারোয়ার কিংবা কাদেরী কিবরিয়ার কণ্ঠ ভেসে আসত, আর আমরা উপলব্ধি করতাম, ‘বাসনা তবু পুরিবে না।’
তারপর বয়স বেড়েছে, আরও কতজনের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেছি, কবে যে প্রিয় শিল্পীর গান বেছে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, শুনতে শুনতে কবে যে পাপিয়া সারোয়ারের কথা ভুলে গেছি, তা আর বলতে পারব না। কিন্তু এখন দেখছি, না, তাকে ভুলে যাইনি, হারিয়েও ফেলিনি; মনে করিয়ে দিলেন অন্তরতর তিনি; মনে করিয়ে দিলেন ‘বড় আশা করে শেষে পুরিবে না কামনা।’
পাপিয়া সারোয়ার
(২১ নভেম্বর ১৯৫২—১২ ডিসেম্বর ২০২৪)
Subscribe to:
Posts (Atom)