Tuesday, September 23, 2025

শিক্ষা বনাম জীবিকা

আমার প্রথম চাকরির প্রথম দুবছর দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ করতাম। প্রথম ছমাস ছুটি বলে কোন শব্দ ছিল না। ছমাস পর থেকে মাসে একটা শুক্রবার ছুটি। সপ্তাহে নিয়মিত একদিন ছুটি পেতে প্রায় দুবছর লেগেছিল। নতুন কোম্পানি গড়ে তোলার প্রাথমিক কারিগর হিসেবে এই কষ্টটা সহ্য করার পুরস্কারও পেয়েছিলাম। অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখে গিয়েছিলাম। যেখানে আমার যাবার কথা নয় সেখানেও পৌছে গিয়েছিলাম। আমি একা ছিলাম না, আমার সাথে আরো কয়েকজন এই ধৈর্য পরীক্ষায় পাশ করেছিল। সেটা ব্যাপার না। ব্যাপার হলো আমি যখন ১৪ ঘন্টা কাজ করা নিয়ে কাহিল, তখন আমার নিয়োগকর্তা ১৮ ঘন্টা কাজ করতেন। মাঝে মাঝে আমরা ভাবতাম তিনি ঘুমান কখন? রাত বারোটায় অফিস থেকে গিয়ে ভোর ছটায় আবারো হাজির। আমরা প্রতিদিন সকাল সাতটায় অফিসে পৌঁছে আমাদের আগেই তাঁকে উপস্থিত দেখতাম। তখন থেকে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু মানুষগুলোর বসবাস পূর্ব এশিয়ায়। কিন্তু মাল্টি মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও এত পরিশ্রম করার পেছনে রহস্য কী? ব্যালেন্স শীটের অংকটা বছরের পর বছর বাড়িয়ে যাওয়া? নতুন নতুন কোম্পানি গড়ে তোলা? নাকি স্রেফ কাজের নেশা? তখন কিছুই বুঝিনি।

এখন আমি একটা স্বাধীন দেশের রাজা। যেখানে কাজ করি আমার ওপর খবরদারী করার কেউ নেই বললেই চলে। আমি কটায় ঘুম থেকে উঠলাম, কটায় ঘুমালাম সেটা নিয়ে কারো অভিযোগ নেই। কাজটা নিজের সময়মতো মতো করি। ভোরে উঠে অফিসে যাবার তাড়া নেই।  কিন্তু নিজের রাজ্যে এসে দেখলাম আমিও প্রায় ১৮ ঘন্টার কাজের চক্রে আটকে গেছি। প্রায়ই মনে হয় দৈনিক ২৪ ঘন্টা যথেষ্ট নয় দিনের সবগুলো কাজ শেষ করার জন্য। কাজের পর কাজ এসে জমা হতে থাকে নিজস্ব অনলাইন ওয়ার্কস্পেসের ফোল্ডারে। ত্রিশ বছর পর আমি পূর্ব এশিয়ার সেই ভদ্রলোককে একটু হলেও অনুভব করলাম। তিনি বলেছিলেন- ‘কাজ একটা নেশা, তোমাকে জাগিয়ে রাখবে ভোর থেকে মধ্যরাতের পরও। যদি কাজ ও তুমি পরস্পরকে পছন্দ করো’।

আমরা কী পরস্পরকে পছন্দ করি? হয়তো। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি। জীবন থেকে মানুষ অনেক শিক্ষা নেয়। এটা ছিল আমার বিলম্বিত শিক্ষার একটি। প্রাচীন ল্যাটিন ভাষায় বলা হতো Potius sero quam nunquam, ইংরেজিতে Better late than never.

কিন্তু একজন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে পছন্দের কাজ পাবে সেরকম কোনো ব্যবস্থা আছে? কাজ ও শিক্ষা এদেশে যোজন যোজন আলোকবর্ষ দূরে থাকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? শিক্ষাখাতে এত বাজেট রেখেও কেন পাঁচ দশকে আমরা একটা অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠি বহন করে যাচ্ছি? বিকলাঙ্গ শিক্ষার প্রতিফলন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবশালী লোকদের কমেন্ট সেকশনেই আছে।

আমাদের দেশে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অধিকাংশ তরুণের দুর্ভাগ্য হলো অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন একটা কর্মজীবন শুরু করা এবং অপছন্দের একটা কর্মজীবন কাটিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে যাওয়া।

এই বিকলাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে, জগাখিচুড়ি কারিকুলাম দিয়ে কখনোই একটা সুশিক্ষিত সুশৃংখল জাতিগোষ্ঠি গড়ে তুলতে পারবে না বাংলাদেশ।


Sunday, September 21, 2025

অদ্ভুত উটের পিঠে বাংলাদেশ.......

একজন সিনিয়র সচিব লিখেছেন ফেসবুকে। প্রকাশ্যে পাবলিক পোস্ট। পোস্টে উপস্থিত আছেন বর্তমান ও সাবেক অনেক সচিব, আমলা। তাদের মন্তব্য থেকেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এতদিন যা গুজব বলে উড়িয়ে দিতাম, এখন বোধকরি আর সম্ভব নয়। গভীর অন্ধকারে পতিত বাংলাদেশের ভবিষ্যত। চোরের বদলে ডাকাতই বাংলাদেশের ভাগ্য। সাক্ষ্য হিসেবে তুলে রাখলাম দুর্নীতির ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকুক।



কোটি কোটি টাকার সচিব!!!
লিখেছেন শামসুল আলম, সিনিয়র সচিব
---------------------------------------------

বর্তমান সরকারের সময়ে নগদ টাকায় সচিব হয়, এটা কোনো বাজে কথা নয়। চ্যালেঞ্জ করবেন না। এর প্রমাণ আমি নিজেই জানি। ছোট ছোট করে কয়েকটা ঘটনা বলি:
ঘটনা-এক
আমাকে যখন কেবিনেটে বসা আটকে দেয়া হলো, (গত ডিসেম্বরে ড. রশিদের দুদক চেয়ারম্যান, এবং আমার কেবিনেট সচিব হওয়া নির্ধারিত ছিল, প্রধান উপদেষ্টা আমার একটি নথিও সাক্ষর করেছেন), তখন একটা গ্রুপ আমাকে ফোন করেছিল, "স্যার আপনাকে কেবিনেটে বসিয়ে দেই, আমরা শত কোটি টাকা খরচা করবো, আপনি শুধু হ্যাঁ বলুন"। আমি বলেছি, “না। আমি ওই লাইনের লোক না। কিছু না হলেও আমি দুর্নীতির সাথে আপোষ করবো না!"
ঘটনা-দুই
আমি একদিন বসে আছি এক অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি রুমে, তিনি আমার ৬ ব্যাচ জুনিয়র। কথা বলছি। হঠাৎ করে আমাকে বলেই উঠে গেলেন। কোথায় গেল বুঝতে পারিনি। তবে পরে বুঝলাম আমার পেছন দিকে সোফায় বসে কথা বলে এসেছেন খুব নিরবে। আমি শুনতে পাইনি কিছুই। সিটে এসে আমাকে বললেন, "স্যার, ক্ষমা করবেন। দু’জন সমন্বয়ক এসেছিলেন, তাই কথা বললাম।" আরও বলল, "আমার সাথে চুক্তি করতে এসেছিল, আমাকে জ্বালানি সচিব করতে চায় মোটা টাকার অফারে। আমার একটা কালার পিডিএস দিতে হবে, একটা চুক্তিপত্রে সই করতে হবে, আর আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ডের কপি দিতে হবে।" আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি দিয়েছো?" বলল, “না স্যার, আমি দেইনি।” এরপর তার ফোন থেকে আরেকজনের স্যাম্পল দলিলের কপি দেখালো। “স্যার, এই যে দেখেন, একজনকে তারা ওইভাবে চুক্তি করে এক মন্ত্রনালয়ে সচিব করেছে। এইরকম চুক্তি করতে হতো। আমার চাকরি অনেক দিন আছে, আমি এই কাজে যাব না, স্যার”। আমি তাকে সাবাসি দিলাম। এখনও ওই অফিসারটি সচিব হতে পারে নি।
ঘটনা-তিন
মে মাসের ৩০ তারিখে আমার এক নির্ভরযোগ্য লোক একটা দলিল পাঠায়, সেটা বর্তমান বানিজ্য সচিব মাহবুবের ৩৫ কোটি টাকার চুক্তির দলিল। এতদিন এটা থামিয়ে রেখেছিলাম, দেখি ভেরিফিকেশন হোক। ভেরিফাই হয়ে এখন নিউজে পরিণত হয়েছে, তারপর আরো কিছু আসছে এগুলো নিউজ পেপারে।
ঘটনা-চার
১৩ ব্যাচের একজন অফিসার মাত্র তিন মাস সচিবগিরি করে উইড্র হয়ে ওএসডি অবস্থায় আছেন। বছরখানেক চাকরিও আছে। ওকে নিয়ে দুটি আলাদা সোর্স জানতে চায়, এই অফিসারটা কেমন। একটা প্রস্তাবে ৩০ কোটি, আরেকটা প্রস্তাবে ৩৬ কোটি- সচিব করার অফার আছে।
ঘটনা-পাঁচ
এর মাঝখানে, এক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফোন করলেন আমাকে সকাল সাড়ে ন’টার দিকে। তিনি আমাকে জানতে চাইলেন তার সচিব সম্পর্কে। কাস্টমস ক্যাডারের অফিসার, নতুন প্রমোশন পেয়ে সচিব হয়েছেন বিস্ময়কর ভাবে। তিনি জানতে পেরেছেন, এই সচিব ৩৫ কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে এখানে এসেছেন। একজন চরম দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঢাকায় পাঁচটা বাড়ি আছে, ওনার অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপ আছে, পরিবার থাকে সেখানে। উনি আসলে যাবেন এনবিআরে, এবং সেখানকার জন্য কয়েক’শো কোটি টাকার ডিল রেডি আছে।
ঘটনা-ছয়
একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরের ডিজি হিসেবে নিযুক্ত আছেন এরকম পনেরো ব্যাচের এক অফিসারের জন্য ৩০ কোটি টাকার অফার আছে। দুর্যোগ সচিব করা হবে। ওই অধিদপ্তরের এডভাইজার মহোদয়কে আমি আজকে জানিয়েছি যে, আপনার ডিজি সচিব হয়ে চলে যাচ্ছে।
ঘটনা-সাত
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার চুক্তিতে এবং আড়াই কোটি টাকা ক্যাশ দিয়ে। তারপরও চার মাসের বেশি থাকতে পারেনি, এটা এখন সচিবালয়ের সবাই জানে।
ঘটনা-আট
গেলো বছর শেষের দিকে শিপিং মিনিস্ট্রির সচিব বানাতে একজন অফিসারকে অফার দিয়েছিল একজন রিটায়ার্ড লেফটেনেন্ট জেনারেল এবং আলাদাভাবে এডিশনাল সেক্রেটারি এপিডি। ১২ কোটি টাকার ডিল। যারা টাকা খর্চা করবে, তারা পরে তুলে নিবে। কেবল সহযোগিতা করলেই চলবে। অফিসারটি রাজী হননি। পরে অবশ্য তিনি টাকা ছাড়াই সচিব হয়েছেন, এখনও আছেন দুর্বল জায়গায়। সংশ্লিষ্ট অফিসার নিজেই আমাকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন।
আর কয়টা বলব? কাজেই এই সরকারের সময়ে টাকা দিয়ে, অর্থাৎ কোটি কোটি টাকা দিয়ে সচিব হয়, এটা কোনো মিথ্যা কথা নয়। সত্য কথা। সম্পূর্ণ সত্য কথা।
এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না॥
----------------------------------------------------------------------------------
পোস্টের লিংক:
https://www.facebook.com/alampmobd/posts/pfbid0Ygso3kkiaL8LtJ8DEvbPvbG7Werqryvgqv9RcpBjELaNsPKgH4Sq9UpFiA8HXmmCl

পোস্টের স্ক্রিনশট:




দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য:

১. Inbox comment: স্যার, আপনার ফেসবুক পোস্ট দেখে কথা বলছি: আওয়ামী সরকারের চরম বঞ্চনার শিকার আমি ...তম ব্যাচের কর্মকর্তা উপসচিব হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের খুবই অগুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচিতে ৮ বছরের বেশি পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। বঞ্চনাকালে নীরবে বুৎপত্তি অর্জন করে বাংলাদেশের সেরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ পরিচিতি পাই (খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন)। এ সরকারের সময় অতিরিক্ত সচিব হই। আমার উপদেষ্টা আমাকে জানতেন, আমার জন্য হয়তো চেষ্টাও করেছেন দুর্যোগ সচিব করার জন্য। কিন্তু এখানে কী যেন কারিকুরিতে এ সরকারের সময়েই ওএসডি হওয়া আওয়ামী সচিব আবারও পদায়ন পায় দুর্যোগ সচিব হিসেবে। পুরো মন্ত্রণালয়ের কাজ ঝুলিয়ে দেয় সে। আমার সুনামকে হুমকি মনে করে উপদেষ্টাকে বুঝিয়ে আমাকে বিদায় করে দেয় মন্ত্রণালয় থেকে। আমাদের মুখ বন্ধ! কোথাও বলতেও পারি না। ২. Mahbub Kabir Milon একজন উপদেষ্টা তার দপ্তরের ডিজি নিয়োগ করবেন ফিট লিস্ট এর কয়েকজনের ভাইবা নিয়ে। তিনি দেশে ফেরেশতা হিসেবে খ্যাত। তিনি তার দপ্তরের ভাইবা নিচ্ছেন। সামনে বসা তিন সচিবসহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্কর্তা। প্রার্থি ৩/৪ জন। দশ মিনিট করে পরীক্ষা চলছে। সবাইকে একই প্রশ্ন। শেষের জনকে যখন বলা হল, তোমার চাকুরী জীবনের বড় এচিভমেন্ট বল। এটা আগের সবাইকেই জিজ্ঞাস করা হয়েছে। শেষের জন ছিলেন চরম দুর্নীতিবাজ। তিনি হাসিনার আমলের লক্ষ কোটি টাকার এক প্রকল্পের কথা বললেন। তিনি পিডি ছিলেন সেখানে। যে প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর দেশের সবাই জানে। এই প্রকল্পের নাম শোনার সাথে সাথেই উপদেষ্টা প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তুমি তো একটা চোর। মুখ দেখাও কেমন করে!! এত বড় দুর্নীতিবাজ হয়ে এসেছ ডিজি হবার জন্য!! রাগে গজড়াতে গজড়াতে উপদেষ্টা আর একটা কথাও না বলে টেবিল থেকে উঠে গেলেন। পরদিন সকালে শেষেরজনের ডিজি হিসেবে অর্ডার হল। স্বাক্ষী ৩ সচিবসহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই হল ফেরেশতাদের কাহিনী স্যার।





Thursday, September 11, 2025

নেপালের বিপ্লব বনাম সহিংসতা

আরেকটা বিপ্লবের ঘটনা ঘটে গেল নেপালে। এক বছর আগের বাংলাদেশের সরকার পতন আন্দোলনের মতো। প্রায় একই ফরমূলা। আগে শুনতাম হিন্দি সিনেমার নকল করে বাংলা সিনেমা তৈরি হয়। এখানে দেখলাম বাংলা সিনেমার নেপালী সংস্করণ।

নেপালের সিংহদরবারে অগ্নিসংযোগ করেছে সরকার বিরোধী আন্দোলনকারীরা। ধ্বংস হয়ে গেছে হাজার বছরের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদও হারিয়ে গেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো আন্দোলনের সাথে এই সহিংসতাগুলোর সম্পর্ক কী? কেন এমন ঘটছে?

যুগ যুগ ধরে গণ আন্দোলন হয়ে এসেছে দেশে দেশে। কিন্তু তার সাথে যে সহিংসতা যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিককালে, সেটা একটা আত্মঘাতী প্রবণতা। প্রকৃত শত্রুমিত্র না চিনে এরা কোনো না কোনো প্ররোচনায় এরা এই অনর্থক সহিংসতাগুলো ঘটাচ্ছে। এই প্রজন্মের একটা বড় অংশের ডিভাইস এবং সোশাল মিডিয়া আসক্তি এত ভয়াবহ, এরা সকল মানবিক যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলেছে। একসময় হয়তো আক্ষেপ করবে, কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে যাচ্ছে।

Monday, September 1, 2025

পলিটিক্যাল নেশন

 একটা সময় জানতাম রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করে। সরকার দেশ চালায়। সরকারে যে দলই থাকুক, পক্ষপাতিত্ব করেও সরকার দেশটাকে চালিয়ে নেবার চেষ্টা করে। নব্বই দশক পর্যন্ত এটা মোটামুটি ঠিক ছিল। একুশ শতকে আসার পর দেখা গেল সরকারের নানা অংশ রাজনীতি করছে। মানে সরকারের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন না করে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। আগে যেটুকু করতো সেটার একটা মাত্রা ছিল। একুশ শতকে এসে মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তারপর দেখা গেল এদেশের মানুষগুলো সরকারের মতো হয়ে গেছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকছে সে দলের মানুষগুলো সরকারের মুখপাত্র হয়ে কাজ করছে। ন্যায় অন্যায় কোনো ব্যাপার নয় সমর্থিত সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তকে রক্ষা করার ঢাল হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এখান থেকেই গণতন্ত্রের পরাজয়ের সূচনা হয়। মানুষ যখন নিজের ভালমন্দ বিচার না করে দলের ভালোমন্দ, দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যে কোনো মতবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। মানুষগুলো তখন আর মানুষ রইল না, একপাল অন্ধ ভেড়ার পালে রূপান্তরিত হলো। ধীরে ধীরে প্রায় পুরো রাষ্ট্রজুড়ে সাধারণ জনগণ বলে কিছু থাকলো না। সবারই একটা না একটা পক্ষ আছে। নিজের স্বার্থের চেয়ে সেই পক্ষটার স্বার্থ বড় হয়ে গেল।

একটা মানুষ ততক্ষণ মানুষ থাকে যতক্ষণ সে নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা রাখে। যখন সে নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ভেড়ার পালের অংশ হয়ে যায় তখন আসলে দেশটা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কারণ সে অতীত-বর্তমান-ভবিষৎ দেখার চোখ হারিয়ে ফেলেছে। সে সবকিছু দেখছে সমর্থিত দলের চশমায়। এই সমর্থন হলো এমন একটা প্রবণতা যেখানে প্রতিপক্ষের কোনো স্থান নেই। আমি যেটা সমর্থন করি একমাত্র সেটাই ঠিক। বাকি সবাই ভুল। পৃথিবীতে গণতন্ত্রের অর্থ হলো নিজ নিজ পছন্দের দলকে নির্বাচিত করা কিন্তু প্রতিপক্ষের মতামতকেও শ্রদ্ধা করা। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের অর্থ হলো শুধু আমার সমর্থিত দল সঠিক, তার বাইরে আর কোনো সত্য নেই। এই বিশ্বাসটা অনেক ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের মতো হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, যত শুদ্ধভাবেই হোক, তবু শান্তি আসবে না। কারণ সমস্যা আমাদের মগজে। 

আরেকটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে। মানুষগুলো দলের বাইরে কিছু ইনফ্লুয়েন্সারকে গুরুমান্য করে। তাদের হাতে নিজেদের ভাগ্য সমর্পন করেছে। নিজের কোনো বক্তব্য নেই। গুরুজি যেটা বলবেন সেটাই তার বক্তব্য। ভেড়ার পালের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী। এরা নিজেদের অস্তিত্বের কথাও ভুলে যায় ছয় ইঞ্চির একটা স্ক্রিনে ভেসে আসা ভিডিওবার্তা দেখে। স্মার্টফোনের যত উপকারিতা আছে, তার দ্বিগুন ক্ষতি করেছে এই সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার। বাংলাদেশে এটা রীতিমত মহামারী। ঘুম থেকে উঠে মানুষ এই ডিভাইসের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে আজকে কোন গুজবটা বিশ্বাস করবে। আমাদের শিক্ষার হার যাই হোক, শিক্ষার মান কতটা ভয়াবহ সেটা ওই ইনফ্লুয়েন্সারদের কমেন্ট বক্সেই প্রমাণিত। 


এদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই মানবতা সহনশীলতা এই মৌলিক বিষয়গুলো মেনে চলে না। জোরে চেচিয়ে কথা বলে নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মানুষগুলো এখন সেই সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে নিজের অজান্তেই। দাসত্ব করছে এমন কিছুর যেটা কখনোই মানুষের জন্য সম্মানজনক নয়। কে কাকে কোন কারণে ব্যবহার করছে সেটা মানুষের ধারণাই নেই। চোখের সামনেই অসংখ্য অরাজকতার ঘটনা দেখছে, সেটা প্রতিকার চাইতে গিয়ে আসল কারণ না খুঁজে রোবটের মতো প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায় মানুষ বিভক্ত। এত বিভক্ত, এত তিক্ত বহুমতকে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া পৃথিবীর কোনো শক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই দেশে কোনো দিনও শান্তি আসবে না। এটা নিয়ে হা হুতাশ করেও লাভ নেই। আপাতত বাংলাদেশের নিয়তি এটাই। এই শতকে কোনো পরিবর্তন আশা করি না। আগামী শতকে যদি কোনো পরিবর্তন আসে সেটা দেখার জন্য আমরা কেউ থাকবো না। হয়তো দেশটাও তখন থাকবে না।

নিজের অজান্তেই আমরা একটা অপ্রয়োজনীয় পলিটিক্যাল নেশনে পরিণত হয়েছি যেখান থেকে মুক্তির পথে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন সাজানো।